মারুতি যাদব। ফাইল চিত্র।
পৃথিবীতে তখন প্রথম বারের জন্য বিশ্বযুদ্ধের ঘনঘটা। যুদ্ধের আগুনে পুড়ছে এশিয়া, আফ্রিকা। আগুন পৌঁছে গিয়েছে ইউরোপেও। জার্মান শক্তির মোকাবিলা করতে রীতিমতো নাকাল ফ্রান্স আর ইংল্যান্ডের যৌথ মিত্র শক্তি। ফ্রান্সের একদম উত্তর প্রান্তে আর্তোয়া শহরে পৌঁছে গিয়েছে দুর্ধর্ষ জার্মান সেনা। তাঁদের লক্ষ্য, বেলজিয়াম দিয়ে সরাসরি ফ্রান্সের অন্দর মহলে ঢুকে পড়া। সেই একপেশে লড়াইয়ে মিত্রশক্তিকে কচুকাটা করছিল জার্মানি। এই যুদ্ধে ফ্রান্স সীমান্তে মোতায়েন ব্রিটিশ সেনার কোনও অফিসার বেঁচে ফিরতে পারেননি। শুধু অফিসার নয়, এক তৃতীয়াংশ সেনাকেও নিকেশ করেছিল জার্মান সেনা। সীমান্ত রক্ষা করার আশা যখন ছেড়ে দিয়েছে মিত্র শক্তি, ঠিক তখনই মাত্র ১৩ জন সেনাকে সঙ্গে নিয়ে যুদ্ধের গতি ঘুরিয়ে দিয়েছিলেন এক ভারতীয়। লড়াইটা পৌঁছে দিয়েছিলেন প্রতিপক্ষের ক্যাম্পে। ফ্রান্সের সীমান্ত রক্ষায় হাবিলদার মারুতি যাদবের সেই লড়াইকে সম্মান জানাতে তাঁকে দেশের তৃতীয় সর্বোচ্চ সামরিক সম্মানে ভূষিত করেছিল ফ্রান্স।
১১ নভেম্বর, ১৯১৮। আজ থেকে ঠিক একশো বছর আগে সকাল এগারোটায় উত্তর ফ্রান্সের কোম্পেনিও জঙ্গলে শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ বন্ধ করতে চুক্তিবদ্ধ হয় মিত্রশক্তি আর জার্মানি। দুনিয়া জুড়ে টানা চার বছরের সর্বগ্রাসী যুদ্ধের পর অবশেষে থামে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের দামামা। স্বস্তি ফিরেছিল ইউরোপে। তার পর থেকেই সারা পৃথিবীতে এই দিনটিকে স্মরণ করা হয় যুদ্ধবিরতি দিবস হিসেবে। যদিও দুর্দম্য জার্মান শক্তিকে বশে আনতে ভারতীয় জওয়ানদের ভূমিকা কতটা ছিল, সেই ইতিহাস অবহেলিতই থেকে গিয়েছে। তারই একটা উদাহরণ, ফ্রান্সের নিউ চ্যাপেলে জার্মান শক্তিকে রুখতে হাবিলদার মারুতি যাদবের লড়াই।
১৯১৫, ফ্রান্সের উত্তর সীমান্তে জার্মানিকে আটকাতে মোতায়েন ব্রিটিশ আর্মির বেশ কয়েকটি কোম্পানি। ব্রিটিশ আর ফরাসি সেনার যৌথবাহিনীর সঙ্গে মুখোমুখি লড়াই চলছে জার্মান সেনার। যুদ্ধক্ষেত্রে কী চলছে, সেই খবর তখনও এসে পৌঁছয়নি পেছনের খাড়কি সেনাশিবিরে। ব্যাটলফিল্ডে মিত্রশক্তির হাত আরও শক্ত করছে পেছনের সেনাশিবির থেকে যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠানো হয় এক দল ভারতীয় সেনাকে। রণক্ষেত্রে যখন এসে পৌঁছয় ভারতীয় সেনা, তখন বোঝা যায় লড়াই হচ্ছে একপেশে। জার্মান বাহিনী রীতিমতো কচুকাটা করেছে ফ্রান্স আর ইংল্যান্ডের যৌথবাহিনীকে। যদিও হাল ছাড়েননি মারুতি যাদব। ১৩ জন সেনাকে সঙ্গে নিয়ে তাঁর দুর্ধর্ষ লড়াইতে কিছুক্ষণের জন্য পিছু হঠে জার্মান সেনা। শুধু তাই নয়, শত্রুপক্ষের দুর্ভেদ্য সুরক্ষা বলয় ভেঙে পাল্টা আক্রমণও শানিয়েছিলেন পুণেতে বড় হওয়া এই লড়াকু জওয়ান। সেই সময়টাতেই নিজেদের কিছুটা গুছিয়ে নিতে পেরেছিল মিত্রসেনা। শুধু এই যুদ্ধেই মারা গিয়েছিলেন পাঁচ হাজার ভারতীয় সেনা।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে মধ্যপ্রাচ্যে মোতায়েন ভারতীয় সেনাদের সাইকেল বাহিনী। ছবি: আনন্দবাজার আর্কাইভ
আরও পড়ুন: মাত্র ২৯ বছরেই মার্কিন কংগ্রেসে, মাথাব্যথা এখন বাড়িভাড়া!
ফ্রান্সের সীমান্ত রক্ষায় ভারতীয় জওয়ানদের এই লড়াই ভুলে যায়নি ফরাসিরা। মারুতি যাদবকে দেশের তৃতীয় সর্বোচ্চ সামরিক সম্মান দিয়েছিল ফ্রান্স সরকার। পাশাপাশি, নিউ চ্যাপেলে ভারতীয় সেনাদের জন্য একটি স্মারকও বানানো হয় যুদ্ধের পর।
আরও পড়ুন: পার্লামেন্ট ভাঙা ‘স্বৈরাচার’, কোর্টে যাবেন রনিল
ফ্রান্সের নরম্যান্ডিতে বিশ্বযুদ্ধে নিহত সেনাদের সমাধিক্ষেত্র। ছবি: রয়টার্স।
শুধু মারুতি যাদব, বা ফ্রান্স সীমান্তের এই একটি যুদ্ধ নয়। সারা পৃথিবীতেই ব্রিটিশ আর্মির হয়ে লড়েছিলেন ভারতীয়েরা। ইউরোপ, ভূমধ্যসাগর, মধ্যপ্রাচ্য সর্বত্রই হাজির ছিলেন ভারতীয় জওয়ানেরা। শুধু হাজির থাকা নয়, অনেকের মতেই এই বিশ্বযুদ্ধে জার্মান অশ্বমেধের ঘোড়া থামানো গিয়েছিল ভারতীয় জওয়ানদের রক্তেই। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে বিভিন্ন ফ্রন্টে লড়াই করেছেন দশ লক্ষেরও বেশি ভারতীয় সেনা। তার মধ্যে মারা গিয়েছিলেন ৭৫,০০০-এরও বেশি। যদিও এই যুদ্ধে ভারতীয়দের ভূমিকা বরাবরই ছোট করে দেখাতে চেয়েছে ইংল্যান্ড। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইন্ডিয়ান আর্মির সেনাপ্রধান বা কম্যান্ডার ইন চিফ স্যার ক্লডি আউচিনলেক অবশ্য বলে ফেলেছিলেন, ‘‘ভারতীয় সেনারা না থাকলে পর পর দু’টি যুদ্ধের ধাক্কা সামাল দেওয়ার ক্ষমতা ছিল না ইংল্যান্ডের।’’
(আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, আন্তর্জাতিক চুক্তি, আন্তর্জাতিক বিরোধ, আন্তর্জাতিক সংঘর্ষ- সব গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক খবর জানতে চোখ রাখুন আমাদের আন্তর্জাতিক বিভাগে।)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy