দেশের মানুষ গণভোটে জানিয়ে দিয়েছেন, মহাজনদের চাপিয়ে দেওয়া কঠোর আর্থিক নীতির শর্ত মেনে চলতে তাঁরা নারাজ।
মহাজন মানে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ইউরোপিয়ান সেন্ট্রাল ব্যাঙ্ক আর আন্তর্জাতিক অর্থ ভাণ্ডার। সত্যি কথা বলতে, গত পাঁচ বছর তাদের শর্ত মেনেই চলেছে গ্রিস। এক সময়ের অমিতব্যয়ী আর্থিক নীতির জন্য প্রায়শ্চিত্তই যদি বলেন, সম্ভবত তার পরিমাণ সেই আর্থিক পাপের চেয়ে বেশিই হয়ে গেছে। দেশের আয় কমেছে প্রায় সাতাশ শতাংশ। প্রতি চার জন কর্মক্ষম মানুষের মধ্যে এক জন বেকার। বহু সংসার চলেছে বুড়ো বাপ-মায়ের পেনশনের ওপর। সেই পেনশনও গত পাঁচ বছরে কমেছে ৪৩ শতাংশ। অসংখ্য মানুষের মাথার ওপর ছাদ নেই, দু’বেলা খাবার নেই। ডাস্টবিনে উচ্ছিষ্টের সন্ধান করছেন অনেকে। সন্তানকে ফেলে যাচ্ছেন চার্চের সিঁড়িতে— যদি খেয়েপরে বেঁচে থাকতে পারে।
এর ওপর আরও এক দফা কড়াক়়ড়ি মানতে মানুষ প্রস্তুত নন। রবিবারের গণভোটে ভোট দিলেন দেশের ৬৩ শতাংশ মানুষ। তাঁদের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশই আর্থিক কড়াকড়ির নতুন শর্ত মানতে নারাজ। গ্রিসের প্রধানমন্ত্রী আলেক্সিস সিপ্রাসও চেয়েছিলেন, গণভোটের ফল যেন ‘না’-ই হয়। কিন্তু, এর পর কী? গ্রিসের এই মহানাটিকার পরবর্তী অঙ্কে কী অপেক্ষা করছে?
এই প্রশ্নের নিশ্চিত উত্তর আথেন্স-এও নেই, বার্লিনেও নেই। ফ্র্যাঙ্কফুর্টে ইউরোপিয়ান সেন্ট্রাল ব্যাঙ্কের, অথবা ব্রাসেলস-এ ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদর দফতরও জানে না, কোথাকার জল কোথায় গড়াবে। কী হতে পারে, আপাতত গোটা দুনিয়া তা আঁচ করার চেষ্টা করছে। গ্রিসের ইউরোয় থাকা নিয়েও প্রশ্ন, সংশয় ছাড়া নিয়েও। কোন পথে কী কী প্রশ্ন:
দু’পক্ষেরই থাকবে: নতুন করে আর্থিক কড়াকড়ি আরোপের আদেশ অগ্রাহ্য করবে গ্রিস, কিন্তু ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্যপদ ছাড়বে না। নতুন করে আলোচনা হবে, অ্যাঞ্জেলা মর্কেলরা নতুন (এবং অপেক্ষাকৃত সহজ) শর্ত দেবেন, আলেক্সিস সিপ্রাস মেনে নেবেন। এবং, গ্রিসের ঋণের বোঝা কাটছাঁট করা হবে, ঋণ পরিশোধের সময়সীমা বাড়ানোও হবে।
এটাই সবচেয়ে সম্ভাব্য সমাধানসূত্র। ভুললে চলবে না, গ্রিস হল যাকে বলে ‘টু বিগ টু ফেল’। এবং, আজ যদি ইউরোপ বিপাকে পড়া গ্রিসকে সম্পূর্ণ ত্যাগ করে, তার ফল বহুমুখী। প্রথমত, অজস্র বৃদ্ধ-শিশু-শারীরিক প্রতিবন্ধীর তীব্রতর আর্থিক সংকটের নৈতিক দায় এড়ানোর উপায় ইউরোপের থাকবে না। দ্বিতীয়ত, এক বার ইউরোপীয় ইউনিয়নে ভাঙন ধরলে পর্তুগাল বা সাইপ্রাসের মতো দেশও যে সেই পথেই হাঁটবে না, তার কোনও নিশ্চয়তা নেই। এই দেশগুলো বেরিয়ে গেলেও যে বিরাট আর্থিক সমস্যা, তা নয়। কিন্তু, এ ভাবে ভাঙন ধরলে ইউরোপীয় ইউনিয়নের মাহাত্ম্যটাই আর থাকবে না। ইতিহাসের পাতায় নিজেদের নামের পাশে কালির সেই অনপনেয় দাগ লাগাতে মর্কেল বা ওলাঁদ রাজি হবেন বলে মনে হয় না।
গ্রিসের অর্থমন্ত্রী, এবং কট্টর বামপন্থী ইয়ানিস ভারুফাকিসের পদত্যাগ এই জল্পনাকে আরও উসকে দিয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের মহা রাগ ভারুফাকিসের ওপর। তিনিই নাকি গ্রিসকে টেনে নিয়ে যাচ্ছেন অসম্ভবের পথে। তাঁর পদত্যাগের পর গ্রিসের সঙ্গে ইউরোপীয় ইউনিয়নের আলোচনার পথ সুগম হবে বলেই অনুমান। তবে, বুধবারের আগে বড় কোনও সিদ্ধান্ত সম্ভবত হচ্ছে না। মঙ্গলবার রাতে ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলির প্রধানমন্ত্রীদের বৈঠক।
গ্রিস ইউরো ছাড়বে: ‘ইকনমিস্ট ইনটেলিজেন্স ইউনিট’ বলছে, গ্রিসের ইউরো ছাড়ার সম্ভাবনা ষাট শতাংশ। গ্রিস ফিরে যাবে দ্রাখমায়। মুদ্রার দাম কমাবে, যাতে আন্তর্জাতিক রফতানির বাজারে গ্রিসের পণ্য সস্তা হয়। এবং, একই সঙ্গে ঘোষণা করবে, বকেয়া ঋণ শোধ করার সামর্থ্য তার নেই।
গত দেড় দশকে অন্তত দুটি দেশ নিজেদের বাঁচাতে এই পথে হেঁটেছে। আর্জেন্টিনা আর আইসল্যান্ড। একটা বড় ফারাক, দুটো দেশের কোনওটাই ইউরোর মতো বহু-দেশ-এক-মুদ্রা ব্যবস্থায় ছিল না। কিন্তু, বাকি গল্পটা এক। দুটো দেশেরই মুদ্রার দাম দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার তুলনায় অনেক বেশি ছিল। মুদ্রার দাম কমিয়ে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতার ক্ষমতা বাড়িয়ে, এবং অন্য দিকে ঋণদাতাদের ঋণের পরিমাণ কাটছাঁট করতে বাধ্য করিয়ে দুটো দেশই সংকট কাটিয়ে উঠতে পেরেছে। কাজেই, গ্রিস হাঁটতেই পারে সেই রাস্তায়।
গ্রিসের গণভোটও বোঝাপড়ার পথ জটিল করে তুলেছে বলে অনেকের মত। বলা হচ্ছে, এই ভোটের পর সিপ্রাসের পক্ষেও যেমন খুব বেশি কিছু মেনে নেওয়া সম্ভব নয়, তেমনই মর্কেলদের ওপরও ঘরোয়া রাজনীতির চাপ থাকবে। তাঁরা গ্রিসের শর্ত মেনে নিলে দেশের ভোটারদের অসন্তোষ বৃদ্ধির সম্ভাবনা যথেষ্ট। সেই ঝুঁকি নিতে তাঁরা রাজি হবেন কি?
যদিও ইইউআই বলছে এটাই সবচেয়ে সম্ভাব্য পরিণতি, তবুও কয়েকটা প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। প্রথম কথা, ইউরোপীয় ইউনিয়ন বা ইউরো মুদ্রা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার কোনও নির্দিষ্ট পদ্ধতি এখনও অবধি নেই। ফলে, গ্রিস বেরোতে চাইলেই আইনত তা পারবে কি না, বা পারলেও সেটা কত দিনের মধ্যে, জানা নেই। প্রক্রিয়াটি জটিল হবে, অনুমান করা চলে। দ্বিতীয়ত, ইউরো থেকে বেরোলে অন্তত প্রথমটায় যে অস্থিরতা তৈরি হবে, তার আঁচ গোটা ইউরোপেই পড়বে। ফলে, ইউরোপীয় ইউনিয়ন সে ঝুঁকি নেবে কি না, সংশয় আছে। তৃতীয়ত, গ্রিসের অবস্থা নিয়ে মহাজনদের মধ্যেও মতভেদ আছে। কিছু দিন আগে পর্যন্তও ইউরোপিয়ান কমিশন গ্রিসের প্রতি দুর্বল ছিল। সেই দুর্বলতা এখন খানিক কেটেছে। কিন্তু, দিনকয়েক আগেই আন্তর্জাতিক অর্থ ভাণ্ডার একটা রিপোর্ট প্রকাশ করেছে, যাতে স্পষ্ট লেখা, এখনই গ্রিসের পক্ষে ঋণ শোধ করা সম্ভব নয়। তাকে আরও সময় দেওয়া প্রয়োজন। কাজেই, এখনই আইএমএফ গ্রিসের হাত ছাড়তে রাজি হবে কি না, সংশয় রয়েছে।
গল্পটা কোন পথে এগোবে, সেটা নির্ভর করছে আরও কয়েকটি প্রশ্নের ওপর।
এক) গ্রিসের হাতে নগদের পরিমাণ এখন নিতান্তই কম। দেশে মোট ৫০ কোটি ইউরো রয়েছে। ইসিবি আপৎকালীন ঋণ দেওয়া বন্ধ রেখেছে বলে গ্রিসে ব্যাঙ্কও বন্ধ রয়েছে আজ অবধি। কিন্তু, ঘোষণা অনুযায়ী, কাল ব্যাঙ্ক খুলছে। ব্যাঙ্ক থেকে টাকা তোলার ওপর ঘোর কড়াকড়ি রয়েছে। তবুও, এই সামান্য টাকায় দিনকয়েকও চলবে না। প্রশ্ন হল, নতুন করে টাকা জোগাবে কে? ইসিবি টাকা না দিলে গ্রিসে ব্যাঙ্ক ফেল করা সময়ের অপেক্ষা (অবশ্য, একটা অন্য পথ আছে, যেটার কথা এর পরেই বলব)। এবং, এক বার ব্যাঙ্ক ফেল করলে সংকট আরও অনেক গভীর হবে। ইসিবি সেই ঝুঁকি নেবে কি?
দুই) গ্রিস যদি ইউরোপীয় ইউনিয়ন ছাড়তেই মনস্থ করে, রাশিয়া (এবং চিন) কি তার পাশে দাঁড়াবে? এখনকার মতো অবস্থা সামাল দিতে যত টাকা প্রয়োজন, তার ব্যবস্থা করবে? ভ্লাদিমির পুতিন হাওয়ায় তেমন সম্ভাবনা ভাসিয়ে রেখেছেন। কথাটি ইউরোপের নেতারাও বিলক্ষণ জানেন। একেবারে ঘরের মধ্যে রাশিয়ার প্রতিপত্তি বাড়তে দিতে তাদের যথেষ্ট আপত্তি থাকাই স্বাভাবিক। ফলে, গ্রিসের শর্তেই তার পাশে দাঁড়ানোর চাপ থাকবে ইউরোপের ওপর।
তিন) গ্রিস যদি ইউরো ছাড়ে, আন্তর্জাতিক শেয়ার বাজারে কতখানি ধাক্কা লাগবে? অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ২০০৭-০৮ সালের সংকটের তুলনায় অভিঘাত অনেক কম হবে, কারণ ইতিমধ্যেই শেয়ার বাজার এই ঝুঁকির হিসেব কষে নিয়েছে, এবং সূচকে তার প্রভাব পড়েছে। নতুন করে খুব বড় ঝটকা লাগার সম্ভাবনা নেই।
চার) এখনও অবধি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র শুধু দূর থেকে দেখেছে, কোনও অবস্থান নেয়নি। এই সংকটে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ কোনও বিপদ নেই বলেই সম্ভবত এমন নির্লিপ্ত অবস্থান ওবামার। কিন্তু, ‘বড় ভাই’ এক বার মাঠে নামলে সব হিসেব নতুন করে লেখার প্রয়োজন হতেই পারে।
মোটমাট, গ্রিস তার ঐতিহাসিক চরিত্রের সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই এক মহানাটকীয় মোড়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। শুধু, এটা একবিংশ শতকের গ্রিক ট্র্যাজেডি-তে পরিণত হয় কি না, সেটাই দেখার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy