Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

‘সিন্ধুর পিছনে সময় নষ্ট না করতে বলেছিল অনেকে, আমি জানতাম ও পারবে’

ভারতীয় ব্যাডমিন্টনে ‘সিন্ধু যুগ’ শুরু হওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই বোমা ফাটালেন পুল্লেলা গোপীচন্দ! অলিম্পিক্সে রুপো জিতে ইতিহাস গড়া মেয়েকে নাকি বাতিলের দলেই ফেলে দিতে চেয়েছিলেন অনেকে!

রুপো জেতার পর গুরু-শিষ্য। ছবি: পিটিআই।

রুপো জেতার পর গুরু-শিষ্য। ছবি: পিটিআই।

রতন চক্রবর্তী
রিও দে জেনেইরো শেষ আপডেট: ২১ অগস্ট ২০১৬ ০২:৩৬
Share: Save:

ভারতীয় ব্যাডমিন্টনে ‘সিন্ধু যুগ’ শুরু হওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই বোমা ফাটালেন পুল্লেলা গোপীচন্দ! অলিম্পিক্সে রুপো জিতে ইতিহাস গড়া মেয়েকে নাকি বাতিলের দলেই ফেলে দিতে চেয়েছিলেন অনেকে!

রজতকন্যা সিন্ধুর কোচের কথায়, ‘‘অস্ট্রেলিয়ান ওপেনে প্রথম রাউন্ডে হেরে ফেরার পর অনেকেই বলেছিলেন, সিন্ধুর পিছনে সময় নষ্ট না করতে। বলেছিলেন, ওকে দিয়ে কিছু হবে না। আমি কিন্তু বিশ্বাস করেছিলাম ও পারবে।’’

অলিম্পিক্সের পোডিয়ামে উঠে রুপোর পদক পরেছেন তাঁর ছাত্রী। তাঁর সুবাদেই উড়েছে তেরঙ্গা। স্টেডিয়াম উত্তাল হয়েছে সিন্ধু-ঢেউয়ে। সেই ঐতিহাসিক মুহূর্তের কয়েক ঘণ্টা পর রিওসেন্ট্রোর হলের বাইরে সাংবাদিকদের সামনে যখন ছাত্রীকে নিয়ে কোচ হাজির হলেন, অসম্ভব তৃপ্ত দেখাচ্ছিল তাঁকে।

গোপী বললেন, ‘‘সিন্ধুর পরিশ্রম আর শেখার জেদটা দেখে মনে হয়েছিল ও অলিম্পিক্স পদক আনার ক্ষমতা রাখে। তাই ওর উপর বাজি ধরেছিলাম। অলিম্পিক্সকে লক্ষ্য করে ছ’মাসের একটা রুটিন তৈরি করেছিলাম। কাঁটায় কাঁটায় ভোর সাড়ে চারটেয় ও আসত আমার অ্যাকাডেমিতে। এক দিনও ওর আসতে চারটে পঁয়তাল্লিশ হয়নি। প্রতিদিন দশ-বারো-তেরো ঘণ্টা করে পরিশ্রম। যা বলেছি তা-ই করেছে। ওকে দিয়েই আমার দিনের কাজ শুরু হতো। সারা দিন একসঙ্গে থাকায় ওর সঙ্গে একটা একাত্মতাও তৈরি হয়েছে। আমি বিশ্বাস করি, শুধু কোচিং করালেই চ্যাম্পিয়ন তৈরি হয় না। সারা দিন তার সঙ্গে থাকতেও হয়।’’

কোচ যখন ছাত্রীর সাফল্যের নেপথ্যের কথা বলছিলেন, সদ্য রুপোজয়ীকে ঘিরে তখনও চলছিল সমর্থকদের উন্মাদনা। কেউ মিষ্টি নিয়ে এসেছেন। কেউ আবার শুধু তাঁর সঙ্গে একটা ছবি তোলার জন্য আকুল। এক জনের আব্দার, সিন্ধুকে পা মেলাতে হবে ‘চ্যাম্পিয়ন, চ্যাম্পিয়ন’ গানের সঙ্গে! সেই সঙ্গে স্পনসরদের অনুরোধ। শান্ত স্বভাবের মেয়েটা অবশ্য এ দিন নিরাশ করেননি কাউকে। দ্বিধা সত্ত্বেও, আড়ষ্ট ভাবে নেচেওছেন খানিকটা।

মা-বাবা দু’জনেই এক সময় জাতীয় দলে ভলিবল খেলেছেন। সব মিলিয়ে খেলার পরিবেশেই বড় হয়েছেন সিন্ধু। নিজের কথা বলার সময় কোচের পাশাপাশি মা-বাবার অবদানের কথাটাও তাই বার বার উঠে আসছিল তাঁর মুখে। সাধারণত খেলার বাইরে অন্য বিষয়ে খুব একটা কথা বলতে চান না সিন্ধু। বার বার বলছিলেন, ‘‘একটা মনে রাখার মতো সপ্তাহ কাটল। যখন শুরুতে ড্র-টা খুব কঠিন হয়ে পড়ল, তখনই আমি আর কোচ ঠিক করেছিলাম, একটা একটা করে ম্যাচ ধরে এগোতে হবে। সেটাই করেছি। তিন নম্বর সেটে ১০-১০ হয়ে যাওয়ার পর দু’তিনটে খারাপ পয়েন্ট নষ্ট করায় শেষটা আর পারলাম না।’’

কখন বুঝলেন ম্যাচ হাতের বাইরে চলে গিয়েছে?

প্রশ্ন শুনে গম্ভীর হলেন সিন্ধু। বললেন, ‘‘আমি কখনও হাল ছাড়ি না। যতক্ষণ না ম্যাচ শেষ হচ্ছে ততক্ষণ লড়ে যাই।’’ কোর্টের বাইরে তাঁর জীবন কেমন? সব কিছু ভুলে গিয়ে কী করে লক্ষ্যে স্থির রইলেন— জানতে চাইলে প্রথমটায় গুটিয়ে গেলেন। তার পর বললেন, ‘‘গত তিন মাস আমার ফোনটা কোচের কাছে। আজ ওটা ফেরত পেলে বাবা-মায়ের সঙ্গে কথা বলব। কী ভাবে সেলিব্রেট করা যায় ঠিক করব। এত দিনে কোপাকাবানা যাওয়া হয়নি। ওখানে যাওয়ার ইচ্ছে আছে।’’

বেশ কয়েকটা প্রশ্নের পর রজতকন্যার কাছে জানা গেল তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের পসন্দ-নাপসন্দের কথাও। জানালেন, তিনি সিনেমা দেখতে ভালবাসেন। প্রিয় নায়ক রণবীর কপূর আর হৃতিক রোশন। পছন্দ করেন আইসক্রিম খেতে। আর ভালবাসেন হায়দরাবাদের বিরিয়ানি। ‘‘কতদিন যে এ সব খাওয়া হয়নি! স্বাদগুলোই ভুলে গিয়েছি!’’ বলছিলেন সিন্ধু।

কেন ভালবাসার খাবার থেকে মুখ ফিরিয়েছেন, তা-ও স্পষ্ট করে দিলেন তিনি। বললেন, ‘‘চারদিকে ডোপিং নিয়ে যা হচ্ছে! গত ৩ বছর কোচ আমাকে বাইরের খাবার খেতে বারণ করে দিয়েছিলেন। স্যারের বাড়িতে তৈরি বা নিজের বাড়ির খাবার বাদে বাইরে কোথাও কিছুই খাইনি। এখানে এসে গেমস ভিলেজেও স্যারের সঙ্গেই খেয়েছি যা খাবার। আর কিছু খাইনি। কেউ যদি খাবারে কিছু মিশিয়ে দেয়, এই ভয়ে সতর্ক থেকেছি।’’

লন্ডনে সাইনা নেহওয়ালের ব্রোঞ্জ না রিওতে সিন্ধুর রুপো— দুই শিষ্যের দুই সাফল্য। তবে কোনটা বেশি তৃপ্তি দিয়েছে গুরুকে? গোপী বললেন, ‘‘দু’টোই। গতবারটা প্রথম ছিল। তার জন্য আলাদা আনন্দ ছিল। আর এ বারেরটা ভারতের মানুষের চাহিদা ছিল। সিন্ধুর কেরিয়ারের পক্ষেও অত্যন্ত জরুরি ছিল।’’

সাইনা আর সিন্ধুর মধ্যে এগিয়ে রাখবেন কাকে?

স্পষ্টতই প্রশ্ন এড়িয়ে গেলেন কোচ। বললেন, ‘‘এত দিন পরিশ্রমের পর আজ সিন্ধুর আনন্দের দিন। ওকে আনন্দ করতে দিন। এ সব প্রশ্নের উত্তর না হয় পরে দেওয়া যাবে।’’

সিন্ধুকে বিশ্বের এক নম্বরে দেখার জন্য অপেক্ষায় রয়েছে তামাম ভারতবাসী। কবে আসবে সেই দিন?

পর পর দুই অলিম্পিকে দেশকে পদক পাইয়ে দেওয়া কোচ বললেন, ‘‘ওর বয়স কম। সিন্ধু টেকনিক্যালি যে ভাবে এগোচ্ছে তাতে অপেক্ষা করুন। দেখতে পাবেন।’’

গোপীর হাত ধরে সিন্ধুর পথ চলা শুরু সেই ২০০৪ থেকে। চার বছরেই গোপী বুঝেছিলেন মেয়েটা অনেক দূর পর্যন্ত যাবে। গোপীর কথায়, ‘‘ও কিন্তু ধাপে ধাপে উন্নতি করেছে। গত ক’বছরে কমওয়েলথ, বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপের মতো আসর থেকে পরের পর পদক নিয়ে এসেছে। গত ক’মাস ওর খারাপ সময় চলেছিল। রিওতে সেটা কেটে গেল বলেই মনে হচ্ছে।’’

ছাত্রীর পদকজয়ের পাশাপাশি আরও একটা সুখবর অপেক্ষা করছিল গোপীর জন্য। ইতিহাস তৈরি করা এই ব্যাডমিন্টন কোচের জীবনী এ বার আসতে চলেছে সেলুলয়েডে! প্রযোজক অভিষেক নামা সেই ছবি তৈরির কাজে হাত দিয়েছেন। গোপাচন্দের জীবনের ওঠাপড়া, লড়াই, চোট পেয়ে সার্কিট থেকে সরে যাওয়া, অ্যাকেডেমি তৈরি করা আর একে একে সাইনা-সিন্ধুদের তুলে আনা— সব গল্পই থাকছে ছবিতে। জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত তেলুগু পরিচালক প্রবীণ সত্তারু বলছিলেন, ‘‘মিলখা, মেরি কমের জীবনের মতোই চড়াই-উতরাই রয়েছে গোপীর জীবনেও। স্ক্রিপ্ট পড়ে গোপী সম্মতি দিয়েছেন। নভেম্বর থেকে শুরু হবে ছবির কাজ।’’ এখনও পর্যন্ত ঠিক হয়েছে, ছবিতে গোপীর ভূমিকায় অভিনয় করবেন আর এক প্রাক্তন খেলোয়াড় সুধীরবাবু।

অলিম্পিক্সে দুই ছাত্রীর পদক। জীবন নিয়ে সিনেমা। তৃপ্তির পাশাপাশি ইতিহাসেও নাম উঠে গিয়েছে। এর পর কী? ‘‘টোকিওয় সিন্ধুর হাতে সোনা চাই।’’ বললেন গোপী। জানালেন, সামনের চারটে বছর সেই কাজটার পিছনেই লেগে থাকবেন তাঁরা।

তৃপ্তি দিয়েছে রুপো। তবে সোনার স্বপ্ন যে এখনও অধরা, মনে করিয়ে দিলেন ভারত সেরা কোচ! তাই আপাতত শিষ্যকে নিয়ে স্বর্ণ-সন্ধানেই নামতে চান তিনি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Pullela Gopichand PV Sindhu Rio Olympics
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE