Advertisement
২৩ এপ্রিল ২০২৪

আজ দেশবাসী তো তোমাদের থেকে মাত্র ৬০ মিনিট চাইছে

দিল্লিতে শেষ দুপুরে তাঁকে ধরা গেল। তখন সবে দাড়ি কামাচ্ছেন। দ্রুত বেরিয়ে যেতে হবে স্টুডিওয়। কাল ভোরেই আবার নিজের বাড়ি ভোপাল। মধ্যপ্রদেশ সরকার রাজ্যের হকি মানচিত্রে তাঁর জন্য গুরুত্বপূর্ণ এলাকা নির্দিষ্ট করেছে। তিনি হলেন সরকারি অ্যাকাডেমির টেকনিক্যাল অ্যাডভাইসার। অশোক কুমার ধ্যানচাঁদ। সত্তর দশকে মোহনবাগান ও ভারতীয় হকির গ্ল্যামার বয়। বহু বছর বাদে সাক্ষাৎকার দিলেন প্রিয় শহর কলকাতার কাগজে। দিল্লিতে শেষ দুপুরে তাঁকে ধরা গেল। তখন সবে দাড়ি কামাচ্ছেন। দ্রুত বেরিয়ে যেতে হবে স্টুডিওয়। কাল ভোরেই আবার নিজের বাড়ি ভোপাল। মধ্যপ্রদেশ সরকার রাজ্যের হকি মানচিত্রে তাঁর জন্য গুরুত্বপূর্ণ এলাকা নির্দিষ্ট করেছে। তিনি হলেন সরকারি অ্যাকাডেমির টেকনিক্যাল অ্যাডভাইসার। অশোক কুমার ধ্যানচাঁদ। সত্তর দশকে মোহনবাগান ও ভারতীয় হকির গ্ল্যামার বয়। বহু বছর বাদে সাক্ষাৎকার দিলেন প্রিয় শহর কলকাতার কাগজে।

গৌতম ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ০৮ অগস্ট ২০১৬ ০৪:১১
Share: Save:

দিল্লিতে শেষ দুপুরে তাঁকে ধরা গেল। তখন সবে দাড়ি কামাচ্ছেন। দ্রুত বেরিয়ে যেতে হবে স্টুডিওয়। কাল ভোরেই আবার নিজের বাড়ি ভোপাল। মধ্যপ্রদেশ সরকার রাজ্যের হকি মানচিত্রে তাঁর জন্য গুরুত্বপূর্ণ এলাকা নির্দিষ্ট করেছে। তিনি হলেন সরকারি অ্যাকাডেমির টেকনিক্যাল অ্যাডভাইসার। অশোক কুমার ধ্যানচাঁদ। সত্তর দশকে মোহনবাগান ও ভারতীয় হকির গ্ল্যামার বয়। বহু বছর বাদে সাক্ষাৎকার দিলেন প্রিয় শহর কলকাতার কাগজে।

প্রশ্ন: আপনার বাবা ধ্যানচাঁদ বেঁচে থাকলে কাল আয়ারল্যান্ডের ম্যাচ দেখলে কী বলতেন?

অশোক কুমার: কালকে ম্যাচ দেখার পর ঠিক সেটাই মনে হচ্ছিল যে, বাবা বেঁচে থাকলে কী বলতেন? বাহাত্তরের মিউনিখ অলিম্পিক্সে পাকিস্তানের সঙ্গে সতেরোটা পেনাল্টি কর্নার মিস করে আমরা হেরেছিলাম। বাড়ি ফেরার পর বাবা ম্যাচটা নিয়ে কথা তুলতেই আমি বলি যে, দুর্ভাগ্য এতগুলো পেনাল্টি কর্নার পেয়েও জেতা গেল না। বাবা গর্জে উঠে বলেছিলেন, দুর্ভাগ্য বোলো না। বলো ব্যর্থতা। আমার মনে হয় আজকে বেঁচে থাকলে বাবা বোধহয় বলতেন, টিমের কোচিং পারফেক্ট হয়ে কী হবে, যদি তোমাদের খেলাটাই ইমপারফেক্ট হয়?

প্র: কলকাতা মাঠ অবশ্য আপনাকে শুধু ধ্যানচাঁদের ছেলে হিসেবেই মনে রাখেনি। মনে রেখেছিল, ড্রিবলের জাদুকর অশোক কুমার হিসেবে। পঁচাত্তরের ওয়ার্ল্ড কাপ ফাইনালে আপনি পাকিস্তানের সঙ্গে জয়সূচক গোল করার পর কলকাতা বলেছিল, এ কিন্তু আমাদেরই ঘরের প্লেয়ার।

অশোক কুমার: কলকাতার সেই দিনগুলো সত্যি ভুলতে পারি না। জিন্দেগি কিতনা খুবসুরত থা। বাহাত্তর সাল নাগাদ কলকাতা ছেড়ে চলে যাই। কিন্তু মোহনবাগানে খেলা দিনগুলো, হকি ঘিরে সমর্থকদের প্যাশন, বাবাকে মোহনবাগান মাঠে বিশাল সংবর্ধনা... কলকাতা একটা অন্য জিনিস।

প্র: আপনি বোধহয় জানেন না, কলকাতায় হকিতে এখন কোনও লোকই হয় না। বেটন কাপ ফাইনাল বলে বস্তুটা জাস্ট উবে গিয়েছে।

অশোক কুমার: শুনে খুব আশ্চর্য লাগছে। আমার মতে, কলকাতাই তো ভারতীয় হকিকে তুলেছিল। কলকাতাই তো ভারতীয় হকিকে পরিচালনা করেছে। পঙ্কজ গুপ্তকে খুব মনে পড়ে। ও রকম ডাকসাইটে কর্মকর্তা আমি দেখিনি।

প্র: আপনি যখন সত্তর দশকে মোহনবাগানের হয়ে মাঠ কাঁপাচ্ছেন, সেই সময় আপনার টিমের সেন্টার হাফের ছেলে একান্তই ছোট। তাঁকে মনে পড়ে?

অশোক কুমার: (হাসি) ইয়েস খুব মনে পড়ে। ভেস পেজের হাত ধরে ছেলেটা আসত। একেবারে কচি বয়স তখন ওর। কোথা থেকে কোথায় সময় চলে যায়। সেই পুঁচকে ছেলেটা কী না আজ সাতটা অলিম্পিক্স খেলে ফেলল!

প্র: লিয়েন্ডার পেজের সঙ্গে শেষ কবে দেখা হয়েছে?

অশোক কুমার: বিশ্বাস করবেন? দেখাই হয়নি! বহু বছর কলকাতা যাওয়া হয় না। আশির দশকে ভেস পেজ কলকাতায় একটা ইনভিটেশনাল হকি টুর্নামেন্ট করেছিল। সেই সময় লিয়েন্ডারের সঙ্গে দেখা হয়েছিল কি না, মনে নেই। সত্যি বলতে কী, লিয়েন্ডারকে টিভিতেই দেখি আর কাগজে পড়ে গর্বিত হই। আশ্চর্য লাগে যে, এত বছর ওর সঙ্গে দেখাই হল না।

প্র: লিয়েন্ডারের প্রথম রাউন্ডের ব্যর্থতা টিভিতে দেখলেন?

অশোক কুমার: দেখিনি। আমি তখন চ্যানেলে বলছিলাম। তবে আমার যেন মনে হয়, লিয়েন্ডারের অলিম্পিক্সকে আরও সিরিয়াসলি নেওয়া উচিত ছিল। যতই তুমি ছ’টা অলিম্পিক্স খেলে থাকো, প্রত্যেকটা অলিম্পিক্স একটা আর একটার চেয়ে আলাদা। এটা কোনও কথা হল যে জাস্ট এলে, এক দিন প্র্যাকটিস করলে আর নেমে পড়লে! অলিম্পিক্স এত সহজ? লিয়েন্ডারের বোঝা উচিত ছিল ও অভিনব বিন্দ্রার ইভেন্টে নামছে না। এমন একটা স্পোর্ট খেলছে যেটা খুব ফিজিক্যাল। যেখানে স্থানীয় আবহাওয়ার সঙ্গে মানিয়ে নেওয়াটা খুব ইম্পর্ট্যান্ট।

প্র: ইন্ডিয়া-আয়ারল্যান্ড দেখে কী বুঝলেন?

অশোক কুমার: বুঝলাম আমাদের টিমের সবচেয়ে দুর্বল জায়গাটা ফরোয়ার্ড লাইন। এখানেই আমারা কমজোরি।

প্র: আর?

অশোক কুমার: আর একটা হল কোচ দোনমনায় ভুগছেন যে সর্দার সিংহকে সেন্টার হাফ খেলাবেন, না মনদীপকে? মনদীপ আগের টুর্নামেন্টগুলোয় সেন্টার হাফ খারাপ খেলেনি। তাই ওর একটা দোলাচল হচ্ছে কাকে কোথায় রাখব? নাকি সর্দারকে শিফট করব? আমার মতে ইন্টারন্যাশনাল স্পোর্টে দোলাচলের কোনও জায়গা নেই। যে কোনও একটা সিদ্ধান্ত নাও। আর সেটা স্ট্রংলি আঁকড়ে থাকো।

তিনটে পেনাল্টি কর্নার আমরা কাজে লাগিয়েছি সেটা যেমন গু়ড সাইন, তেমন অশুভ দিক হল অপোনেন্টের গোলে একটাও শট হয়নি। একটাও ফিল্ড গোল হয়নি।

প্র: সোমবার রাতে জার্মানির সঙ্গে কী বুঝছেন?

অশোক কুমার: জার্মানরা অবশ্যই ওদের অলিম্পিক্স চ্যাম্পিয়নশিপের খেতাব ধরে রাখার জন্য ঝাঁপাবে। আয়ারল্যান্ড যে ভাবে আমাদের বিরুদ্ধে স্পেস তৈরি করেছে, সেটা টিভিতে দেখে ওদের চোখ চকচক করা উচিত। এতটা জমি জার্মানরা পেয়ে গেলে ওদের থামানো কঠিন হবে।

প্র: আপনি যে ভাবে বলছেন, তাতে তো কালকের ম্যাচ নিয়ে আর আশাই নেই মনে হচ্ছে।

অশোক কুমার: আমার সেটা মনে হয় না। কালকে ষাট মিনিট তো ছেলেদের নিজেদের প্রমাণের জায়গা। আজকে ভারত সরকার এক-একজন ছেলের ট্রেনিংয়ের পিছনে কোটি টাকা করে খরচ করছে। ভারতীয় হকির ইতিহাসে কখনও হয়নি। আজ ছেলেরা ষাট মিনিটে জবাব দিক যে, আজকেই ওদের উত্তর দেওয়ার সময়। আজকের ষাট মিনিটই হোক ওদের ধন্যবাদ জানানোর ভাষা।

প্র: আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে, চক দে ফিল্মটা দেখছি। আদৌ ছেলেদের এ ভাবে চাগানো যায়, যদি না তারা ফিজিক্যালি ফিট থাকে?

অশোক কুমার: নিশ্চয়ই যায়। আমার এখনও এই ছেষট্টি বছর বয়সে হিটলার বা নেপোলিয়নের বক্তৃতার ক্লিপিংস দেখলে রক্ত গরম হয়ে যায়। মনে হয় আমি একজন যোদ্ধা। যুদ্ধ জয়েই আমার একমাত্র অধিকার। খেলতে হবে তো ষাট মিনিট।

প্র: আপনি ভারতীয় কোচ হলে ছেলেদের কী বলতেন?

অশোক কুমার: ঠিক এটাই বলতাম যে, তোমার জীবন থেকে দেশবাসী মোটে ষাট মিনিট চেয়েছে। বলেছে, জার্মান ধ্বংস করে ফেরো। এটুকু পারবে না?

প্র: একটা জিনিস অন্য সব খেলার মতোই হকিতেও তর্কের বিষয়।

অশোক কুমার: বলুন।

প্র: আপনার বাবা হকির জাদুকর হিসেবে স্বীকৃত। লোকে আজও ওঁর তীব্র গতিতে বল কন্ট্রোলের কথা বলে। কিন্তু সেটা ছিল স্বাভাবিক ঘাসের মাঠে। অ্যাস্ট্রোটার্ফে এমন শক্তিশালী জার্মান টিমকে হারাতে পারতেন উনি?

অশোক কুমার: হা হা। এটা কী রকম জানেন? পেলেকে জিজ্ঞেস করা তুমি আজকের দিনে গোল করতে পারতে? বা ব্র্যাডম্যানকে বলা আপনি মশাই রান পেতেন? শুনুন, গ্রেটরা সব আমলেই গ্রেট। গ্রেটনেসের সংজ্ঞাই হল, যে কোনও পরিবেশে অ্যাডজাস্ট করে শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করে। বাবাও তাই করতেন। অ্যাস্ট্রোটার্ফের জন্য নিজেকে আলাদা তৈরি করতেন। বাবার মতো খেলতে পারিনি। কিন্তু একটা কথা শিখেছি। স্পোর্টসে আসল জিনিস হল পারফেকশন। আপনি ধারাবাহিক ভাবে নিখুঁত কি না। আপনার লক্ষ্যভেদ যদি নিখুঁত হয়, তা হলে আমলটা কী, কোন শতাব্দী, কোন সারফেস, এ সব নিয়ে ভাবার দরকার পড়ে না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Rio Olympics Hokey Ashok Kumar Dhyanchand
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE