জুটিতে লুটি। রাজকোটে পূজারা-মুরলী। ছবি: পিটিআই।
আনুষাঙ্গিকের বিবরণ বা দিনের দুই ভারতীয় বীরের ক্রিকেট-বর্ণনায় পরে ঢোকা যাবে। মুখ্য ব্যাপারগুলো সর্বপ্রথমে মিটিয়ে ফেলা যাক। রাজকোটের স্কোরকার্ড ভুলে যান। ফলো অন পার করাটা কোনও ব্যাপার না। মাত্র উনিশ রান আর লাগবে।
কিন্তু বাকিটাই আসল। ২১৮। অ্যালিস্টার কুকের ইংল্যান্ডের অতিকায় প্রথম ইনিংস স্কোরকে ছুঁয়ে ভারতকে নিশ্চিন্ত-তটভূমিতে পৌঁছে দিতে যা প্রয়োজন। পরের দিকে রবিচন্দ্রন অশ্বিন, ঋদ্ধিমান সাহারা থাকবেন। টেস্ট সেঞ্চুরি যাঁদের কাছে অধরা কোহিনুর নয়। রবীন্দ্র জাডেজা আবার নামবেন ঘরের মাঠের চেনা পিচে। ক্ষমতার বিচারে পারা উচিত। ড্র হয়ে যাওয়া উচিত রাজকোট টেস্ট। কিন্তু তার পরেও পারা আর না পারার মধ্যবর্তী স্বল্প শূন্যস্থানে ভেবেচিন্তে দু’টো নাম লিখতে হচ্ছে।
প্রথম জন, অজিঙ্ক রাহানে।
দ্বিতীয় জন, বিরাট কোহালি।
শুক্রবার সন্ধেয় ভারতীয় ড্রেসিংরুমে ঢোকার সময় ভারত অধিনায়ক নট আউট ২৬। রাহানে আজ ড্রেসিংরুম থেকে বারই হননি, শনিবার সাতসকালে বেরোবেন। ক্রিকেট-পরিসংখ্যান বলছে, চলতি বছরে রাজকোটে আট নম্বর টেস্টটা খেলছেন রাহানে। দশ ইনিংসে তিন বার নট আউট থেকে রান ৫৯০। আর গড়? মোহাবিষ্ট হওয়ার মতো ৮৪! বিরাট সেখানে সমসংখ্যক ম্যাচে একটা ইনিংস বেশি খেলেছেন। ৫৮৬ রান। গড় ৫৮.৬০। এবং এ দিনের দুই সতীর্থ যোদ্ধার মতো শনিবাসরীয় কুরুক্ষেত্রে যদি এঁরা দুই সমান বলশালী ইনিংস খেলে দেন, স্বাচ্ছন্দ্যের ড্র অনায়াসে আসছে।
বিরাট কোহালিকে এ দিন ফেরার সময় দেখে একটু যেন অপ্রসন্ন মনে হল। দিনের শেষ দশটা মিনিটের জন্য হয়তো। আসলে ওই শেষের দশটা মিনিটই চেতেশ্বর পূজারা-মুরলী বিজয়ের মহাকাব্যিক ইনিংসের পরেও ভারতের আকাশে মৃদু অস্বস্তির মেঘ এনে দিল। দু’বলের গ্যাপে দু’টো উইকেট বেরিয়ে গেল। বিজয় গোটা দিন অমিত-সংযমে ব্যাট করেছেন, পূজারার মতো অসাধারণ সেঞ্চুরি করে যুদ্ধে ভারতের অনন্য প্রত্যাবর্তন ঘটিয়েছেন। তার পর তাঁর আউট নিয়ে কথা বলাটা মূর্খামি। কিন্তু অমিত মিশ্রকে ‘নাইট ওয়াচম্যান’ করে পাঠানোর স্ট্র্যাটেজিটা খাটল না। অমিত দু’বলের মধ্যেই তো ফরোয়ার্ড শর্ট লেগে ক্যাচ তুলে চলে গেলেন! ভারত দ্রুত ৩১৮-২ থেকে ৩১৯-৪।
যদিও তা যথেষ্ট ভরসা করার মতো। দুর্ধর্ষ সেঞ্চুরির পর আউট হয়ে যখন ফিরছেন পূজারা, মুরলী বিজয়কে দেখা গেল দৌড়োচ্ছেন। এবং প্রায় বাউন্ডারি লাইন পর্যন্ত পূজারার কাঁধ জড়িয়ে তাঁকে ছেড়ে এলেন বিজয়! দেখলে, ছবিটা সম্পূর্ণ করে দিতে ইচ্ছে করবে। শুধু পূজারা নয়, সমগ্র ভারতবর্ষের উচিত আজ পূজারা-বিজয় দু’জনকে একসঙ্গে জড়িয়ে ধরা। টেনশনের গিরিখাদ থেকে দেশকে এঁরা দুই আজ টেনে তুলেছেন। একজন ঘরের মাঠের উদ্বোধনী টেস্টেই সেঞ্চুরি করে বেরিয়ে গিয়েছেন। অন্য জনের গত ষোলো টেস্ট সেঞ্চুরি-বিচারে নিষ্ফলা মরুভূমি গিয়েছে। মুরলী বিজয়, ভারতীয় ক্রিকেটের ‘মঙ্ক’ গত বছর ফতুল্লায় বাংলাদেশ টেস্টের পর সেঞ্চুরি পেলেন আজ এসে, টিমের মোক্ষম প্রয়োজনের মুহূর্তে। ক্যাপ্টেন কুকের টিমকে কিন্তু তিন সেঞ্চুরি যোগ্য প্রত্যুত্তর দিয়ে দিল ভারত। দিয়ে দিল মাত্র চব্বিশ ঘণ্টার ব্যবধানে!
এবং দু’জনের ধৈর্য-সংহারের ক্যানভাসটাও ক্রিকেটপ্রেমীকে সমান মুগ্ধ করবে। এ দিন খেলা শুরুর পাঁচ মিনিটের মধ্যে গৌতম গম্ভীর আউট। ভারত ৬৮-১। ঘাড়ে পাঁচশোর চাবুক থাকলে যে কোনও টিম এর পর চাপে কাঁপতে শুরু করবে। কিন্তু পূজারারা দেখালেন, কেন তাঁরা বিশ্বের শ্রেষ্ঠ টেস্ট টিমের বাসিন্দা। চেতেশ্বর পূজারাকে মাস ছ’য়েক আগেও লোকে জানত, ভাল ব্যাটসম্যান। দারুণ টেকনিক। কিন্তু স্ট্রাইক রেটটা মোটেও সুবিধের নয়। অথচ আজ পূজারা শুরু করলেন পঁচাত্তরে, শেষ করলেন ষাটে! যে বেন স্টোকসকে নিয়ে এত নাচানাচি বিলিতি মিডিয়ার, যাঁর রিভার্স সুইংকে মোটামুটি ওয়াকার ইউনিসের সমগোত্রীয় করে ফেলা হয়েছে ইতিমধ্যে, তাঁকে এ দিন দেখামাত্র প্রহার শুরু করে দিলেন পূজারা। স্টোকসের একটা ওভার থেকে তো তিনটে বাউন্ডারি নিলেন। কুক বাধ্য হলেন স্টোকসকে সরিয়ে নিতে। কিন্তু নতুন হিংস্র স্ট্র্যাটেজি নিয়ে আবির্ভূত হলেন।
শর্ট বল। গায়ে-টায়ে না, সোজা মাথায় মারো!
এক নয়, দুই নয়, তিন-তিন বার ক্রিস ওকস হেলমেটে মারলেন পূজারার! একবার ভাইজারে। একবার ইয়ার-ফ্ল্যাপে। শেষ বার তার একটু উপরে। আঘাত কতটা মারাত্মক দেখার জন্য ভারতীয় টিমের সাপোর্ট স্টাফ ছুটে মাঠের ভিতরে ঢুকে গিয়েছিলেন, কিন্তু পূজারাকে দেখা গেল হাত দিয়ে তাঁকে ফিরিয়ে দিতে! ফিল হিউজ কাণ্ডের পর ঠিক কতটা অকুতোভয় হলে এ জিনিস সম্ভব? বুকের খাঁচা কতটা নিশ্ছিদ্র হলে এর পরেও ফ্রন্টফুটে আসতে পারে মানুষ, খেলতে পারে অনন্য ড্রাইভ? ইয়র্কশায়ারে কাউন্টি খেলার সময় থেকে ইংরেজ মিডিয়া অদ্ভুত একটা নামে ডাকে পূজারাকে। ‘চেতেশ্বর’ নামটা উচ্চারণে অসুবিধে হয় বলে তারা ডাকে, স্টিভ পূজারা বলে। এ দিন রাজকোটে যে মানসিক-বর্মের উদাহরণ পেশ করলেন পূজারা, তা স্মিথ বা ওয়, যে কোনও স্টিভের সঙ্গে তুলনীয় হতে পারে।
কুক আরও একবার চেষ্টা করেছিলেন। শর্ট বলের হিংস্র থিওরি থেকে সরে এসে দারুণ এক কূটনৈতিক চাল দিয়ে। পূজারা ওই সময় ড্রাইভ অসম্ভব ভাল মারছিলেন। আচমকা দেখা গেল, অফসাইডে ছ’জন ফিল্ডারকে সার্কেলের ভেতর তুলে আনলেন কুক। তিন জন আবার কভার অঞ্চলে, একটা শর্ট গালি দাঁড় করিয়ে। বল করতে ডাকলেন স্টুয়ার্ট ব্রডকে। যিনি ক্রমাগত অফস্টাম্পের বাইরে ফেলতে শুরু করলেন। বার্তা পরিষ্কার— যাও, মারো। দেখাও কত ভাল ড্রাইভ তুমি মারতে পারো। একবার মিসটাইমড মানে তোমার মৃত্যু!
ব্রড ওই স্পেলে পাঁচ ওভার বল করে মাত্র এক রান দিলেন। কিন্তু পূজারাকে দিয়ে আধখানা ড্রাইভও মারাতে পারলেন না! পূজারা ২৯৮ মিনিট ব্যাট করলেন। বিজয় আরও বেশি— ৪৮৫। কিন্তু তবু দু’টোর মধ্যে তুলনা করতে গেলে ‘স্টিভ’ পূজারাকে একটু বেশি আকর্ষণীয় লাগে। বিজয়ও ছক্কার পর ছক্কা হাঁকিয়ে মইন আলির স্পিনকে নিষ্ক্রিয় করে দিয়েছেন। কিন্তু ইংরেজ-পাশবিকতা বা বুদ্ধিমত্তা কোনওটার বিরুদ্ধেই পূজারার চেয়ে তাঁকে বেশি লড়তে হয়নি। তাই রাজকোট-আত্মজের ইনিংস বেশি আকর্ষণীয় লাগে। তাতে রোম্যান্টিকতা বেশি, নাটকীয়তাও।
তবে সে যাই হোক। ২০৯ রানের যুগলবন্দির কীর্তিও তো কম নয়। প্রখ্যাত ক্রিকেটলিখিয়ে নেভিল কার্ডাস একবার লিখেছিলেন, একটা সময়ের পর কেউ আর স্কোর, রেজাল্ট কিছু মনে রাখে না। মনে রাখে চরিত্রকে, স্মরণ করে তার প্রতিচ্ছবি। টেস্ট যদি শেষ পর্যন্ত ড্র-ও হয়, রেজাল্ট ভুলে পূজারা-বিজয়ের যুগলবন্দির কীর্তি লোকে বোধহয় সে ভাবেই মনে রেখে দেবে। আজ থেকে বহু বছর পরেও হয়তো তারা স্মরণ করবে দু’জনের ইনিংস, বলে দেবে ভারতের মাঠে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে ঠিক কী ভাবে রুখে দাঁড়িয়েছিল দুই ভারতীয়!
স্কোর
ইংল্যান্ড ৫৩৭ ও ভারত
(প্রথম ইনিংস, আগের দিন ৬৩-০-র পর)
মুরলী ক হামিদ বো রশিদ ১২৬
গম্ভীর এলবিডব্লিউ বো ব্রড ২৯
পূজারা ক কুক বো স্টোকস ১২৪
কোহালি নআ ২৬
মিশ্র ক হামিদ বো আনসারি ০
অতিরিক্ত ১৪
মোট ৩১৯-৪
পতন: ৬৮, ২৭৭, ৩১৮, ৩১৯।
বোলিং: ব্রড ২০-৭-৫৪-১, ওকস ২৩-৫-৩৯-০,
মইন ২২-৬-৭০-০, আনসারি ১৭.৩-১-৫৭-১,
রশিদ ১৬-১-৪৭-১, স্টোকস ১০-১-৩৯-১।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy