Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

ভারতের অপমান বাড়তে দিল না বৃষ্টি

গ্রিন পার্ক প্রেসবক্স বারান্দায় মিডিয়াকে নির্নিমেষ মাঠের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে কৌতুক আর চাপতে পারলেন না এক কানপুর ক্রিকেট কর্তা। মিটিমিটি হেসে বলে ফেললেন যে, মিডিয়া অহেতুক সময় নষ্ট করছে।

নিষ্ফলা দিনে বিরাটদের আউটের আবেদন। শুক্রবার কানপুরে। ছবি: পিটিআই।

নিষ্ফলা দিনে বিরাটদের আউটের আবেদন। শুক্রবার কানপুরে। ছবি: পিটিআই।

রাজর্ষি গঙ্গোপাধ্যায়
কানপুর শেষ আপডেট: ২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ০৪:০৩
Share: Save:

ভারত: ৩১৮

নিউজিল্যান্ড: ১৫২-১

গ্রিন পার্ক প্রেসবক্স বারান্দায় মিডিয়াকে নির্নিমেষ মাঠের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে কৌতুক আর চাপতে পারলেন না এক কানপুর ক্রিকেট কর্তা। মিটিমিটি হেসে বলে ফেললেন যে, মিডিয়া অহেতুক সময় নষ্ট করছে। চার দিক শুকিয়ে যতই খটখটে রোদ উঠুক, যতই সময় নিন ম্যাচ রেফারি, আজকের মতো ম্যাচ শেষ। আর হবে না। কানপুর ক্রিকেট মাঠ দেখে-দেখে তিনি আজ পক্ককেশ, খুব ভাল জানেন এ মাঠের নিকাশিব্যবস্থার ইতিহাস।

শুনে প্রথমে কারও বিশ্বাস হয়নি, করার কোনও কারণও ছিল না। বৃষ্টিটাই তো অত মারাত্মক কিছু হয়নি। ঝমঝমে নয়, ঝিরঝিরে। মিনিট চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ ধরে চলেছে ঠিকই, কিন্তু তীব্রতা এমন কিছু ছিল না। তার উপর মাঠ ঢাকা। আর হালফিল ইডেনের মতো অত্যাধুনিক কভার না থাক, গোটা চার-পাঁচ সুপার-সপার তো থাকবে। তা হলে? দুপুর তিনটেয় কোন যুক্তিতে নিশ্চিত ভাবে বলে দেওয়া যেতে পারে যে, ম্যাচ আজকের মতো শেষ! আর হবে না।

ঘড়ি ধরে ঠিক পঁয়তাল্লিশ মিনিটের মধ্যে গ্রিন পার্ক স্তব্ধ করে পাবলিক অ্যাড্রেস সিস্টেমে ঘোষণাটা হয়ে গেল। এবং চার-পাঁচটা কেন, আধখানা সুপার-সপারও মাঠ শুকোতে বেরোতে দেখা গেল না! ভারতের পাঁচশো টেস্টের মঞ্চে যা অকল্পনীয়। ঐতিহ্য বিচারে এত বড় একটা টেস্ট ম্যাচ আয়োজন হচ্ছে যে মাঠে, সেখানে ক্রিকেট-পরিকাঠামোর ন্যূনতম ব্যবস্থা থাকবে না? একটা গোটা সেশন কিনা স্টেডিয়াম পার্শ্ববর্তী গঙ্গাবক্ষে নিক্ষেপ হবে? কেউ কেউ বললেন, দু’টো সুপার-সপার আছে। কিন্তু প্রয়োজনের সময় সে সব কোথায়, জিজ্ঞেস করেও কোনও সদুত্তর পাওয়া গেল না। এর পর গনগনে প্রশ্ন উঠে পড়া অত্যন্ত স্বাভাবিক যে, এত মর্যাদার এক টেস্ট ম্যাচ তা হলে এখানে দিল কেন বিসিসিআই? যেখানে বৃষ্টি হলে মাঠের জল শুকোনোর জন্য একটা সুপার-সপারও পাওয়া যায় না? ভারতে মাঠ তো কম নেই। আধুনিকতার ঐশ্বর্যও আছে প্রচুর মাঠে। পাঁচশোতম টেস্ট ম্যাচটা ইডেন বা ওয়াংখেড়েতে হলে কী অসুবিধে ছিল? অন্তত ইতিহাসের পাতায় তো লেখা থাকত না যে, ভারতের পাঁচশো নম্বর টেস্ট ম্যাচের একটা সেশন সম্পূর্ণ মুছে দিয়েছিল কানপুর-কলঙ্ক!

নিখাদ ক্রিকেটপ্রেমী হিসেবে ভাবলে, এমন রাগ বা বিতৃষ্ণা মনে জন্মানো খুব স্বাভাবিক। কিন্তু বাস্তবের অনুবীক্ষণ যন্ত্রের তলায় পাঁচশো নম্বর টেস্টকে ফেললে মনে হবে, ভালই হল! ভালই হল বৃষ্টি এসে। নইলে ঐতিহাসিক টেস্টে ভারতের লাঞ্ছনা আরও কতটা সুদূরবিস্তৃত হত কে জানে?

এমন নির্মম পাল্টা চাবুক যে বেশ কয়েকটা বছর দেশের মাঠে সহ্য করেনি ভারত। গত চারটে বছর বটেই। চার বছর আগের অ্যালিস্টার কুক-কেভিন পিটারসেনের ইংল্যান্ডের পর কেউ আবার এত বড় আক্রমণ করল ভারতের স্পিন-দুর্গে।

গ্রিন পার্কের দ্বিতীয় দিন চা বিরতিতে নিউজিল্যান্ড কিনা ১৫২-১! দুই শ্বেতাঙ্গ ব্যাটসম্যান কিনা অনায়াসে অশ্বিনদের স্পিন-ইন্দ্রজাল নির্বিষ করে হাফসেঞ্চুরির স্টেশনে দাঁড়িয়ে? গত কয়েক বছরে মাইকেল ক্লার্কের অস্ট্রেলিয়া, হাসিম আমলার দক্ষিণ আফ্রিকাকে ধ্বংস্তুপে পর্যবসিত হতে দেখার পর বিশ্বাস হয় এমন দৃশ্য? কানপুরের জঘন্য ড্রেনেজ সিস্টেমের মতোই এ-ও তো সমান অকল্পনীয়! দুঃস্বপ্নেরও অতীত!

ভারতের ব্যাটিং কোচ সঞ্জয় বাঙ্গার সাংবাদিক সম্মেলনে বেখাপ্পা প্রশ্নটা শুনে একটু যেন রেগেই গেলেন। অমিত মিশ্র নিয়ে প্রশ্নটা উড়ে গিয়েছিল বাঙ্গারের দিকে। মিশ্রর মতো স্পিনার ভল্টে থাকা সত্ত্বেও তিন স্পিনারে গেল না কেন ভারত? এখন তাঁর অভাব কতটা টের পাওয়া যাচ্ছে? শুনে তিতকুটে ভাবে বাঙ্গার বললেন যে, ম্যাচের ছ’টা সেশনও এখন হয়নি। নিউজিল্যান্ড ইনিংসে মাত্র পঁয়তাল্লিশ ওভার খেলা হয়েছে। আর ওই পঁয়তাল্লিশ ওভারে ভারতীয় বোলাররা যে খারাপ করেছেন, তা তিনি অন্তত মনে করেন না। আর তাই, ভারতীয় শিবিরে এ জাতীয় কোনও বিদঘুটে ভাবনাচিন্তার উদয় হয়নি।

বাঙ্গার বলছেন ঠিকই। কিন্তু সাংবাদিক সম্মেলনের অনেক আগে থেকে প্রশ্নটা উঠছিল। লাঞ্চের পরপরই বিভিন্ন সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে বলাবলি শুরু হয়ে যায় যে, মিশ্রকে পাঁচশোতম টেস্টে না খেলিয়ে বড় ভুল করে ফেলল ভারত। অনায়াসে একজন ব্যাটসম্যান কমিয়ে পাঁচ বোলারে যাওয়া যেতে পারত। বা উমেশ যাদবকে বসিয়ে তিন স্পিনার-এক পেসার ফর্মুলায়। কিন্তু মিশ্রকে এই টেস্টে প্রয়োজন ছিল।

খুব ভুলও নয়। তিন স্পিনারে নিউজিল্যান্ডও গিয়েছে। তা ছাড়া স্লো টার্নারে লেগস্পিনারে লগ্নি করা সব সময় ভাল। কিছুই না, লেগস্পিনারের টার্ন পেতে উইকেট-চরিত্রের প্রয়োজন পড়ে না। ভারতের আজ আরও মুশকিল হয়ে গেল, স্লো টার্নারে রবীন্দ্র জাডেজা নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ায়। ঘূর্ণিতে জাডেজার আর্ম বল যতটা মারাত্মক দাঁড়ায়, স্লো টার্নারে ততটা নয়। রবিচন্দ্রন অশ্বিনও তাই অন্যান্য ম্যাচে সতীর্থ স্পিনারদের থেকে যে সাপোর্টটা পেয়ে থাকেন, এ দিন পেলেন না। তবে তাঁকে আর একটু ভাল ভাবে ব্যবহার করা যেত বোধহয়। একটা সময় দেখা গেল, অশ্বিন ছ’ওভার বল করেছেন। কিন্তু জাডেজাকে দিয়ে ততক্ষণে তেরো ওভার করানো হয়ে গিয়েছে।

কিন্তু এটুকু দিয়ে ভারতের ব্যর্থতার ব্যাখ্যা মিটিয়ে ফেললে তা অর্ধসত্য থেকে যাবে। বাহবা দিতে হবে নিউজিল্যান্ডকে। প্রশংসা করতে হবে তাদের স্পিন খেলার স্ট্র্যাটেজির। ২০০৪ সালে ভারত সফরে এসে হরভজন সিংহদের বিরুদ্ধে প্রতিআক্রমণের যে স্ট্র্যাটেজি নিয়েছিলেন ম্যাথু হেডেন, নিউজিল্যান্ড দেখা গেল সেই একই মন্ত্রে দীক্ষা নিয়ে ভারতে ঢুকেছে। মানে স্পিনার দেখলেই সুইপ মারো! কেন উইলিয়ামসন নিজে এতটাই প্রতিভাবান যে, সুইপ খেলে তাঁকে স্পিনার-বধের রাস্তায় যেতে হয় না। স্বাভাবিক ফুটওয়ার্কেই তা ম্যানেজ হয়ে যায়। দীর্ঘদেহী প্রাক্তন অস্ট্রেলীয় ওপেনারের ‘সুইপ থিওরি’-তে যেতে বরং দেখা গেল টম ল্যাথামকে। জাডেজা-অশ্বিন প্রত্যেকের জন্য এক ওষুধ। এবং লো বাউন্স উইকেটে তাতে কোনও অসুবিধেও হল না।

শোনা গেল একশো নয়, দু’শো শতাংশ প্রস্তুতি নিয়ে নাকি ভারতে ঢুকেছে নিউজিল্যান্ড। রস টেলরের মতো কেউ কেউ, যাঁদের গত ভারত সফরের অভিজ্ঞতা আছে তাঁরা যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন উইলিয়ামসনের টিমকে নিজ-অভিজ্ঞতা দিয়ে সাহায্য করতে। অশ্বিনদের ভিডিও দেখাটা স্বাভাবিক, নিউজিল্যান্ড দেখেওছে। কিন্তু টিম উইলিয়ামসনকে নাকি সবচেয়ে সাহায্য করেছে নিউজিল্যান্ড বোর্ডের একটা সিদ্ধান্ত। ভারত সফরের আগে দিন সাতেকের ছুটি দিয়ে দেওয়া। ক্রিকেটারদের বলে দেওয়া বাড়ি যাও। পরিবারের সঙ্গে সময় কাটাও। তার পর ঝরঝরে হয়ে ফেরো ভারত সফরের জন্য।

কারণ যেটাই হোক, লাভ তো হচ্ছে। টেস্ট ম্যাচের এখনও পর্যন্ত পাঁচটা সেশনের মধ্যে চারটেই কিন্তু উইলিয়ামসনদের। কানপুর টেস্টে শেষ পর্যন্ত কী হবে, সিরিজের ভাগ্যেই বা কী লেখা থাকবে, পরবর্তী ব্যাপার। কিন্তু সফরকারীদের মনোভাবে, স্পিনের বিরুদ্ধে শস্ত্রশিক্ষায় একটা বার্তা খুব পরিষ্কার।

নিউজিল্যান্ড কিন্তু ভোগাবে!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

India New Zealand Test series
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE