পদক পাননি, কিন্তু ছুঁয়েছেন আকাশ। প্রথম বার ভল্ট দেওয়ার মুহূর্তে দীপা। রবিবার। ছবি: রয়টার্স
রাত জেগে টিভির সামনে জেগে বসে থাকা ভারতবাসী শোকে মুহ্যমান। আর চুরমার হওয়া পদকের স্বপ্নটা ছিল যাঁকে ঘিরে, সেই মেয়েই হাসছেন! ‘‘অলিম্পিক্সের মতো আসরে এর চেয়ে বেশি আর কী করা সম্ভব! সেরাটা দিয়েছি। প্রতিদিন উন্নতি করেছি। তিন মাসের অনুশীলনে বিদেশে না গিয়ে, শুধু আমার স্যারের সাহায্যে যা করেছি, অনেক। ওরা তো চার-পাঁচ বছরের অনুশীলন করে এখানে এসেছে। পদক তো ওরা পাবেই!’’
কোনও হতাশা নেই দীপা কর্মকারের। কোনও হাহুতাশ নেই। তাঁকে প্রশ্ন করা হল, মিলখা সিংহ, পিটি উষা, জয়দীপ কর্মকার, অভিনব বিন্দ্রার সঙ্গে আপনিও তো আজ থেকে এক আসনে বসে পড়লেন— যন্ত্রণাময় ওই ‘চতুর্থ’ স্থানটায় আটকে গিয়ে! শুনে দীপা বললেন, ‘‘ওঁরা নমস্য। আমি এখনও সেই জায়গায় আসিনি। যদি কোনও দিন অলিম্পিক্স থেকে পদক নিয়ে যেতে পারি, তা হলে ওঁদের সঙ্গে আমার নাম উচ্চারণ করবেন।’’
পদক তো প্রায় পেয়েই গিয়েছিলেন? এত ক্ষণে কিছুটা যেন উদাস লাগল ত্রিপুরার বাঙালি কন্যাকে। কিছুক্ষণ চুপ থেকে সামলে নিলেন আবেগ। তার পর বললেন, ‘‘যা হয়েছি, তাতেই আমি তৃপ্ত। আমি খুশি, আমার কোচ খুশি। এর বেশি স্কোর করা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। প্রোদুনোভায় সবথেকে বেশি স্কোর কিন্তু আমার। একটা সমস্যাই রয়ে গেল। বাবার কাছে শুনতে হবে, কেন চার নম্বর হলি? পাঁচ-ছয় হলে আফশোস থাকত না।’’
আর্টিস্টিক জিমন্যাস্টিক্সের ভল্ট ফাইনাল শুরুর আধ ঘণ্টা আগেই ভর্তি বারহা ক্যারিওকা জিমন্যাস্টিক্স এরিনা। শুধু পতাকা হাতে ভারতীয়রা নন, আজ দীপার সমর্থকদের মধ্যে ছিলেন অনেক ব্রাজিলীয়ও!
দীপা এ দিন তাঁর পোশাকটা বদলেছিলেন। নীল পোশাকে এরিনায় ঢুকে ব্যাগটা রেখেই ছটফট করছিলেন। জার্সির ওপর সূর্যের ছটা। একের পর এক নাম ঘোষণা হচ্ছিল বিশ্বের নামী জিমন্যাস্টদের। দীপার নামটা যখন ঘোষণা হল, তখন ফেটে পড়ল স্টেডিয়াম। দীপা দুটো হাত তুলে গ্রহণ করলেন অভিবাদন।
আট জনের মধ্যে ছ’নম্বরে নাম ছিল দীপার। যখন ভল্ট দিতে এলেন, তাবড় জিমন্যাস্টরা চোদ্দো পয়েন্টের বেশি উঠতে পারেননি। কিন্তু দীপাও যেন তৈরি ছিলেন সবাইকে চমকে দিতে। তাঁর মুখে কোনও টেনশনের ছাপ ছিল না। স্ট্র্যাটেজি পাল্টে তালিকায় প্রথমেই ছিল আজ সুকাহারা ভল্ট। প্রথম ভল্টে তাঁর ল্যান্ডিংও হল দারুণ। জায়ান্ট স্ক্রিন স্কোর দেখাল— ১৪.৮৬৬। হাততালির ঝড়।
এর পর সেই প্রোদুনোভা। যে ভল্টের উপর ভর করেই রিওয় পৌছেছিলেন দীপা। দৌড়তে শুরু করলেন দীপা। কিন্তু সেরা অস্ত্রের প্রয়োগ করতে গিয়েই সামান্য গণ্ডগোল হয়ে গেল। ল্যান্ডিং-এর সময় শরীর ঠেকে গেল ম্যাটে। প্রায় বসে পড়লেন দীপা। একটু আগেই প্রোদুনোভা ভল্ট দিতে গিয়ে পড়ে গিয়েছিলেন উজবেকিস্তানের অকসানা চুসোভিতিনা। তাঁর চেয়ে অনেক ভাল ল্যান্ডিং। দীপাও হাসছিলেন। জড়িয়ে ধরেছিলেন কোচ বিশ্বেশ্বর। জায়ান্ট স্ক্রিন এ বার দেখাল, দ্বিতীয় ভল্টে তাঁর স্কোর ১৫.২৬৬। চূড়ান্ত স্কোর— ১৫.০৬৬। স্কোর বোর্ড বলছে, সুইস মেয়ে স্টেইনগ্রুবার তখনও পর্যন্ত প্রথম স্থানে। তাঁর পরেই দীপা।
একটা ব্রোঞ্জ বা রুপো কি হবে না? আশার সঙ্গে তখন চিন্তাও কাটেনি গোটা দেশের, কারণ দীপার পরেই আসবেন বিশ্বের দুই সেরা জিমন্যাস্ট। রাশিয়ার মারিয়া পাসেকা এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সিমোন বাইলস— যাঁকে বলা হচ্ছে জিমন্যাস্টিক্সের মাইকেল ফেল্পস। ভল্ট ফাইনালের আগেই যাঁর ঝুলিতে দু’টো সোনা চলে এসেছে। স্কোর দেখেই নিজের কিট গোছাতে শুরু করলেন দীপা। আস্তে আস্তে কোচের কাছে চলে এলেন। এবং আশঙ্কা সত্যি করেই সেই বাইলস আর পাসেকাই তুলে নিলেন সোনা আর রুপো। স্টেইনগ্রুবার ব্রোঞ্জ। তাঁর পয়েন্ট ১৫.২১৬। ব্যবধান ০.১৫। প্রোদুনোভার পরে বসে পড়াটাই তা হলে কাল হল? দীপা বলছেন, ‘‘এ সব যে কোনও সময় হতে পারে। বারবার বলছি, আমি যা করেছি তাতে আমি তৃপ্ত। আমাকে যখন আপনারা প্রথম তিনে দেখছেন, তখনও বিশ্বের সেরা দুই জিমন্যাস্টের ভল্ট বাকি। আমি জানতাম আমার পক্ষে এর চেয়ে ভাল কিছু করা সম্ভব নয়।’’
এখন কী করবেন? ‘‘কয়েক দিন বিশ্রাম নেব। তার পর কোচের সঙ্গে কথা বলে ঠিক করব পরবর্তী রাস্তা।’’ দস্যি মেয়ের মতো দীপা যোগ করলেন, ‘‘একটু আইসক্রিম খাব, একটু ঘোড়ায় চড়ব। কিছুই তো ঘোরা হয়নি। তবে আমি কিন্তু আবার আসব। টোকিও যেন তৈরি থাকে।’’
দীপা এ বার ফিরবেন। জিমন্যাস্টিক্সের মতো যে খেলার মানচিত্রে কোথাও ছিল না ভারত, সেই খেলাকেই ‘স্বাধীনতা’ দিয়ে। ৪ যেখানে একটা সংখ্যা মাত্র!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy