Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

পিটিয়ে খুনে আঙুল হবু ডাক্তারদের দিকে

প্রাণ বাঁচানো যাঁদের কাজ তাঁদের বিরুদ্ধেই উঠছে প্রাণ নেওয়ার অভিযোগ। রবিবার সকালে নীলরতন সরকার হাসপাতালের চিকিৎসক-ছাত্রদের হস্টেল থেকে এক যুবকের মৃতদেহ উদ্ধার হয়। ময়নাতদন্তের প্রাথমিক রিপোর্টে বলা হয়েছে, রড-বাঁশ জাতীয় বস্তু দিয়ে পিটিয়ে মারা হয়েছে ওই যুবককে। প্রাথমিক তদন্তের পরে পুলিশের অনুমান, এই ঘটনায় জড়িত রয়েছেন হাসপাতালেরই ডাক্তার-ছাত্রদের একাংশ। প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণেও তার সমর্থন মিলেছে বলে জানিয়েছে পুলিশের একটি সূত্র।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৭ নভেম্বর ২০১৪ ০৩:০২
Share: Save:

প্রাণ বাঁচানো যাঁদের কাজ তাঁদের বিরুদ্ধেই উঠছে প্রাণ নেওয়ার অভিযোগ।

রবিবার সকালে নীলরতন সরকার হাসপাতালের চিকিৎসক-ছাত্রদের হস্টেল থেকে এক যুবকের মৃতদেহ উদ্ধার হয়। ময়নাতদন্তের প্রাথমিক রিপোর্টে বলা হয়েছে, রড-বাঁশ জাতীয় বস্তু দিয়ে পিটিয়ে মারা হয়েছে ওই যুবককে। প্রাথমিক তদন্তের পরে পুলিশের অনুমান, এই ঘটনায় জড়িত রয়েছেন হাসপাতালেরই ডাক্তার-ছাত্রদের একাংশ। প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণেও তার সমর্থন মিলেছে বলে জানিয়েছে পুলিশের একটি সূত্র।

পুলিশ সূত্রের খবর, হাসপাতালের ভিতরে এমন ঘটনার পরেও কর্তৃপক্ষ রবিবার রাত পর্যন্ত পুলিশের কাছে অভিযোগ জানাননি। বাধ্য হয়ে পুলিশ স্বতঃপ্রণোদিত ভাবে খুনের মামলা রুজু করে তদন্তে নেমেছে। কলকাতা পুলিশের ডিসি (ইএসডি) ধ্রুবজ্যোতি দে বলেন, “প্রাথমিক তদন্তে মনে করা হচ্ছে, ওই যুবককে খুন করা হয়েছে। এই ঘটনায় একাধিক লোক জড়িত ছিল বলে সন্দেহ। দোষীদের খুঁজে বের করতে তদন্ত শুরু হয়েছে।” পুলিশ সূত্রের দাবি, এই ঘটনায় হস্টেলের দুই ক্যান্টিন কর্মীকে জেরা করা হয়েছে। কয়েক জন চিকিৎসক-ছাত্রের সঙ্গেও কথা বলেছেন তদন্তকারীরা।

রবিবার সকাল সাতটা নাগাদ এক অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তি এন্টালি থানায় ফোন করে জানান, এনআরএস হাসপাতালের চিকিৎসক-ছাত্রদের হস্টেলের চার তলায় বছর তিরিশের এক যুবক থামের সঙ্গে দড়ি বাঁধা অবস্থায় পড়ে রয়েছেন। আটটা নাগাদ পুলিশ হস্টেলে গিয়ে গেঞ্জি-লুঙ্গি পরা যুবককে উদ্ধার করে হাসপাতালেরই জরুরি বিভাগে নিয়ে যায়। চিকিৎসকেরা জানান, যুবক মারা গিয়েছেন। এই ঘটনায় খুনের মামলা রুজু করলেও রাত পর্যন্ত কাউকে গ্রেফতার করেনি পুলিশ। জানা যায়নি নিহতের পরিচয়ও। তবে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, এ দিন ভোরের দিকে মোবাইল চুরির অভিযোগে ওই যুবককে পাকড়াও করে রড-বাঁশ দিয়ে বেধড়ক মারেন ১০-১২ জন। তাতেই ওই যুবকের মৃত্যু হয়।

কেন মারা হল ওই যুবককে?

হাসপাতালের একটি সূত্র বলছে, হস্টেলে নিরাপত্তার ব্যবস্থা প্রায় নেই বললেই চলে। বছর তিনেক ধরে প্রায়ই মোবাইল, ল্যাপটপ চুরির অভিযোগ আসছিল। তা নিয়ে হস্টেলের বাসিন্দাদের ক্ষোভও ছিল। ওই সূত্রের দাবি, এ দিন ভোরে হস্টেলের ভিতরে ওই যুবককে ঘোরাফেরা করতে দেখে কয়েক জন ডাক্তার-ছাত্র তাঁকে পাকড়াও করেন। তাঁর কাছ থেকে এক জনের মোবাইল ফোনও মেলে। এর পরেই তাঁকে হস্টেলের চার তলায় ক্যারম খেলার ঘরের সামনে থামে বেঁধে শুরু হয় মার। নাম না প্রকাশের শর্তে হাসপাতালের এক চিকিৎসক-ছাত্র বলেন, “হস্টেলের সিনিয়র দাদারাই ওই যুবককে মারধর করছিল। তলপেটেও বাঁশ দিয়ে মারা হয়।”

একই অভিযোগ করেছেন ওই হস্টেলে নির্মাণকাজে যুক্ত রবিউল নামে এক শ্রমিক। তিনি বলেন, “সকাল ছ’টা নাগাদ কাজে এসে দেখি হস্টেলের ১০-১২ জন বাঁশ-লাঠি দিয়ে ছেলেটাকে মারছে। কিছুক্ষণ পরে ছেলেটা নেতিয়ে পড়ে। পরে পুলিশ এসে ছেলেটাকে নিয়ে যায়।” ঘটনায় রীতিমতো আতঙ্ক ছড়িয়েছে ওই শ্রমিকদের মধ্যে। বিকেলে কাজ সেরে ফেরার পথে তাঁদেরই এক জন বললেন, “পরের দিন কাজে আসব কি না, বলতে পারছি না।”

এ দিন এনআরএস হাসপাতালের মর্গেই নিহত যুবকের সুরতহাল এবং ময়নাতদন্ত করা হয়। পুলিশ সূত্রের খবর, ময়নাতদন্তের পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট মেলেনি। তবে ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক পুলিশকে জানিয়েছেন, ওই যুবকের যৌনাঙ্গ-সহ একাধিক জায়গায় আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। কয়েকটি জায়গা থেকে রক্তক্ষরণও হয়েছে। যুবকের দেহের ভিতরেও কিছু আঘাতের চিহ্ন মিলেছে। এক পুলিশকর্তা বলেন, “মৃত্যুর বিস্তারিত কারণ জানার জন্য দেহাংশ (ভিসেরা) ফরেন্সিক পরীক্ষায় পাঠানো হয়েছে।”

প্রাথমিক সন্দেহের তির যাঁদের দিকে, সেই হবু ডাক্তারদের কাউকে কিন্তু পুলিশ রাত পর্যন্ত জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করেনি। অনেকেই বলছেন, এনআরএস হাসপাতালের ছাত্র সংগঠন শাসক দলের দখলে রয়েছে। প্রশ্ন উঠছে, সে কারণেই কি পুলিশ এগোতে পারছে না? অনেকে প্রশ্ন তুলছেন, জুনিয়র ডাক্তারদের একাংশের বিরুদ্ধেই যখন অভিযোগ, তখন সেখান থেকে ময়নাতদন্ত করলে তার রিপোর্ট নিরপেক্ষ হবে কি?

পুলিশ সূত্রে অবশ্য বলা হচ্ছে, এই ঘটনার প্রাথমিক তদন্তের ভার এন্টালি থানার হাতে। তার ফলে নিয়ম মেনেই এনআরএস মর্গে ময়নাতদন্ত হওয়ার কথা। তেমনই হয়েছে। কিন্তু ময়নাতদন্তের রিপোর্টে খুনের কথা বলা হলেও রাত পর্যন্ত কেউ গ্রেফতার হল না কেন?

পুলিশকর্তাদের ব্যাখ্যা, এনআরএস শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং হাসপাতাল। রাত পর্যন্ত নিহতের পরিচয় জানা যায়নি। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষও অভিযোগ জানাননি। ফলে মামলা দায়ের করতে দেরি হয়েছে। তবে এক পুলিশকর্তার বক্তব্য, “খুনের মতো গুরুতর অপরাধ হয়েছে। ফলে এই মামলায় গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করতেই হবে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কতটা সাহায্য করেন, সেটাই দেখার।” পুলিশের অন্য একটি সূত্র বলছে, সামনের মাস থেকে ডাক্তারির পরীক্ষা শুরু হচ্ছে। তাই গ্রেফতারের ক্ষেত্রে সতর্ক হয়েই এগোতে হবে তাঁদের।

কী বলছেন কর্তৃপক্ষ? এনআরএস মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের অধ্যক্ষ মঞ্জু বন্দ্যোপাধ্যায়ের সতর্ক মন্তব্য, “সামনের মাস থেকে পরীক্ষা শুরু হচ্ছে। তাই এখনই তড়িঘড়ি মন্তব্য করব না।” অধ্যক্ষ জানান, আজ, সোমবার এই ঘটনার তদন্তে ৭ সদস্যের একটি কমিটি গড়া হবে। ঘটনা নিয়ে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কাছে রিপোর্ট চেয়েছেন রাজ্যের স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়।

এ দিন ঘটনার পরেই ওই হস্টেলের দুই ক্যান্টিন কর্মীকে থানায় নিয়ে যায় পুলিশ। দীর্ঘ ক্ষণ জেরার পর তাঁদের ছেড়ে দেওয়া হয়। সবাইকে ছেড়ে ওই দু’জনকে জেরার জন্য নিয়ে যাওয়া হল কেন? পুলিশের ব্যাখ্যা, যেখান থেকে দেহ উদ্ধার করা হয়েছে, তার পাশেই একটি ছোট ক্যান্টিন রয়েছে। সেখানে হস্টেলের বাসিন্দাদের জন্য নুডলস ও চা-কফি বানানোর ব্যবস্থা রয়েছে। বেণু অন্ডিয়া ও প্রদীপ গিরি নামে ওই দুই যুবক সেখানেই কাজ করেন। এই ঘটনায় তাঁরা কী জানেন, সেটা জানতেই তাঁদের এন্টালি থানায় নিয়ে গিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে।

এ দিন গণপিটুনির ঘটনা চাউর হতেই অঘোষিত বন্ধ জারি হয়ে যায় ডাক্তারদের হস্টেলে। নিতান্ত প্রয়োজন ছাড়া কেউই নীচে নামছিলেন না। বিভিন্ন তলার বারান্দা থেকে নীচে সংবাদমাধ্যমের কর্মীদের নজরে রাখছিলেন অনেকে। অচেনা কেউ যাতে উপরে না উঠতে পারে, তার জন্য গেটে মোতায়েন করা হয় পুলিশও। যা দেখে হাসপাতালের এক কর্মীর মন্তব্য, এই নিরাপত্তা সব সময় থাকলে তো চোরেরা ভিতরে ঢুকতেই পারত না!

এ দিন একটি অনলাইন সংস্থার হয়ে হস্টেলে বই সরবরাহ করতে এসেছিলেন এক যুবক। তিনি জানালেন, বহু ছাত্রই বইয়ের বরাত দিয়েছিলেন। কিন্তু এ দিন দুপুরে ফোন করে বেশির ভাগ লোককেই পাননি তিনি। তাঁর কথায়, “কাল রাতেও সবাই বলল, রবিবার দুপুরে আসুন। বই নেব। এখন বলছে, তাঁরা নাকি হস্টেলেই নেই!” বই নিতেই নেমেছিলেন এক ছাত্র-চিকিৎসক। ঘটনার কথা জিজ্ঞাসা করতেই বললেন, “আমি দেরি করে ঘুম থেকে উঠেছি। কিছু জানি না।” তার পর একটু থেমে বললেন, “আপনারা যা জানেন, আমিও তা-ই জানি।” কথা শেষ করেই হস্টেলের ভিতরে চলে গেলেন তিনি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE