ওই রিপোর্ট বলছে, শুধু উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজেই জানুয়ারি থেকে ৫ মাসে এনসেফ্যালাইটিসের উপসর্গ নিয়ে ৩৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু রাজ্য স্বাস্থ্য দফতর সূত্রে জানানো হয়েছে, উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ বা দার্জিলিং, জলপাইগুড়ির জেলা স্বাস্থ্য বিভাগ থেকে সে সময়ে কোনও জরুরি রিপোর্ট বা সতর্কীকরণ বার্তা পাঠানো হয়নি স্বাস্থ্য ভবনকে। স্বাস্থ্য ভবনের দাবি, তাই তারা সংক্রমণ রুখতে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানাতে পারেনি। পরিস্থিতি জটিল হয়ে পড়েছে সে কারণেই। মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে বৃহস্পতিবার বিকেল থেকে শুক্রবার রাত পর্যন্ত আরও ৫ জনের মৃত্যু হয় এনসেফ্যালাইটিসে।
নবান্নে মুখ্যমন্ত্রীর সাংবাদিক বৈঠকে সাসপেন্ড করার ঘোষণার কিছু আগেই উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী গৌতম দেব ও উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের আধিকারিকদের নিয়ে বৈঠকও করেন সুপার অমরেন্দ্রনাথ সরকার। বৈঠকের পরে তিনি জানান, রোগ সংক্রমণের হার কমে আসছে এবং রোগ নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। তার ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই সাসপেন্ডের ঘোষণার পরে তাঁর সংক্ষিপ্ত মন্তব্য, “পদ্ধতি অনুযায়ী নিয়মিত তথ্য পাঠানো হয়। তবে আলাদা করে বাড়তি গুরুত্ব দেওয়ার জন্য বলা হয়েছিল কি না, দেখতে হবে।”
একই সুর দার্জিলিং জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক সুবীর ভৌমিকেরও, “যেখানে তথ্য পাঠানোর কথা, নিয়মিত পাঠানো হয়েছে। তাতে সমস্যা হয়েছে কি না, খোঁজ নেব।” জলপাইগুড়ির মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক জগন্নাথ সরকার তথ্য পাঠানো নিয়ে মুখ খুলতে চাননি। কাউকে সাসপেন্ড করার কথাও তিনি জানেন না বলে দাবি করেছেন।
এনসেফ্যালাইটিস পরিস্থিতি গত সপ্তাহ থেকে জটিল হওয়ার পরে বিরোধী দলের বিভিন্ন নেতা উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ এবং জলপাইগুড়ি হাসপাতালে গিয়ে আক্রান্তদের দেখে এসেছেন। কিন্তু এনসেফ্যালাইটিসের সংক্রমণ চলাকালীন এ মাসেই মুখ্যমন্ত্রী পাহাড় সফরে এসেছিলেন তিন দিনের জন্য। তার আগের দিন ১৫ জুলাই, বন্ধ চা বাগান নিয়ে শিলিগুড়িতে বৈঠক করেন চার মন্ত্রী। স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য-সহ খাদ্য সরবরাহমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক, শ্রমমন্ত্রী মলয় ঘটক ছাড়াও উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী গৌতমবাবু বৈঠকে ছিলেন। তখন স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী কেন এনসেফ্যালাইটিস নিয়ে বৈঠক করেননি অথবা উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজে যাননি, প্রশ্ন তোলেন বিরোধীরা। এ দিন মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “আমি দার্জিলিঙে গিয়েছিলাম, তখনও আমাকে কিছু জানানো হয়নি। তার আগের দিনই চন্দ্রিমা (ভট্টাচার্য)-সহ চার জন মন্ত্রী শিলিগুড়িতে বৈঠক করেছেন। সে সময়েও জেলার স্বাস্থ্য বিভাগ বা মেডিক্যাল কলেজ থেকে তাঁদের কিছু জানানো হয়নি। এ ভাবে সংক্রমণের খবর চেপে যাওয়া অন্যায় হয়েছে।” চা বাগানের স্বাস্থ্য পরিষেবা নিয়ে উত্তরকন্যার বৈঠকে ছিলেন সুপার অমরেন্দ্রবাবুও। সেখানেও তিনি স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে কিছু জানাননি।
কিন্তু তথ্য পাঠানো ছাড়া বিষয়টি আলাদা ভাবে স্বাস্থ্য দফতরের নজরে আনার প্রয়োজন ছিল বলে মনে করছেন রাজ্যের স্বাস্থ্যকর্তারা। ৩০ জুন মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে রোগী কল্যাণ সমিতির বৈঠক হয়। সেখানে গৌতম দেব কর্তৃপক্ষের সঙ্গে দীর্ঘ সময় বৈঠক করলেও এ ব্যাপারে একটি কথাও কেউ জানায়নি বলে মন্ত্রীর অভিযোগ। পরিস্থিতি নিয়ে আজ, শনিবার উত্তরকন্যায় স্বাস্থ্য দফতরের বৈঠক রয়েছে। স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী চন্দ্রিমা দেবী, স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিকর্তাও ওই বৈঠকে থাকবেন।
দুই জেলার স্বাস্থ্য বিভাগ এবং মেডিক্যাল কলেজের আধিকারিকদের একাংশের দাবি, রোগ সংক্রমণের তথ্য নিয়মিত স্বাস্থ্য দফতরে পাঠানো হয়। মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল থেকে যেমন সেই তথ্য স্বাস্থ্য দফতরে পৌঁছয় তেমনই মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিকের দফতর থেকে আধিকারিকরা সেই তথ্য প্রতি মাসেই পাঠান। কত রোগীর কোন রোগে মৃত্যু হচ্ছে তার রিপোর্ট রাজ্যে পাঠানো হয়। এনসেফ্যালাইটিস সংক্রমণ নিয়েও মৃত্যুর খবর যথাসময়ে রাজ্যকে জানানো হয়। মেডিক্যাল কলেজে যে রোগ পরীক্ষার কিটস ফুরিয়ে গিয়েছে, তারও রিপোর্ট পাঠানো হয়েছিল। তবু এ বিষয়ে রাজ্যের স্বাস্থ্য দফতরের আধিকারিকরাই খুব একটা আগ্রহী হননি বলে জেলার স্বাস্থ্য বিভাগের আধিকারিকদের একাংশের পাল্টা অভিযোগ। রাজ্য স্বাস্থ্য দফতরের সেই দায়িত্বপ্রাপ্ত আধিকারিকরাও কেন শাস্তি পাবেন না, সেই প্রশ্ন তুলেছেন উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজের অনেকেই। স্বাস্থ্য ভবন অবশ্য এই অভিযোগকে আমল দিতে চায়নি।
বৃহস্পতিবার রাতে জলপাইগুড়ি-আলিপুরদুয়ারের তৃণমূল নেতা সৌরভ চক্রবর্তীকে আক্রান্তদের পাশে দাঁড়ানোর নির্দেশ দেন দলীয় নেতৃত্ব। তার জেরেই তড়িঘড়ি উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের কাছে তৃণমূল যুব কংগ্রেস সেবাকেন্দ্র খুলেছে। প্রথম দিনেই উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা রোগীর আত্মীয়স্বজন ভিড় করেন সেখানে।
অজানা জ্বরের সংক্রমণ ঠেকাতে ২০০১ সালে সিপিএম যে অতিরিক্ত পরিকাঠামো তৈরি করেছিল, ক’দিন থেকেই উঠছে সেই প্রসঙ্গ। কলকাতা থেকে অতিরিক্ত ২৫ জন চিকিৎসককে উড়িয়ে এনে সে বার স্বাস্থ্য শিবির হয়েছিল শিলিগুড়িতে। এ দিন দলীয় স্তরে স্বাস্থ্য পরিকাঠামো তৈরিতে উদ্যোগী হল তৃণমূল। উত্তরবঙ্গ উন্নয়নমন্ত্রী গৌতম দেবকে এ দিন উত্তরবঙ্গ হাসপাতালে গিয়ে দফায় দফায় চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মী ও রোগীর পরিজনদের সঙ্গে কথা বলেন।