Advertisement
২৩ এপ্রিল ২০২৪

নিউমোনিয়া থেকে সাবধান

শীত এখনও রয়েছে। অন্য রোগের মতো এ সময়ে বয়স্কদের নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা বাড়ে। যত্নে রাখা দরকার শিশুদেরও। জানাচ্ছেন চিকিৎসক কার্তিক পাতরশীত এখনও রয়েছে। অন্য রোগের মতো এ সময়ে বয়স্কদের নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা বাড়ে। যত্নে রাখা দরকার শিশুদেরও।

সময়মতো চিকিৎসাই পারে রোগের জটিলতা দূর করতে। মত চিকিৎসকের। নিজস্ব চিত্র

সময়মতো চিকিৎসাই পারে রোগের জটিলতা দূর করতে। মত চিকিৎসকের। নিজস্ব চিত্র

শেষ আপডেট: ২৪ জানুয়ারি ২০১৯ ০৩:৩৩
Share: Save:

প্রশ্ন: নিউমোনিয়া কী? কী কারণে নিউমোনিয়া হয়?

নিউমোনিয়া হল ফুসফুসের সংক্রমণ। এই রোগে ফুসফুসে প্রদাহ সৃষ্টি হয়। অনেক ক্ষে‌ত্রে জলও জমতে পারে। সাধারণত ব্যাকটেরিয়া কিংবা ভাইরাসের সংক্রমণে নিউমোনিয়া হয়। যেমন, স্ট্রেপ্টোকক্কাস নিউমোনি নামের ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ নিউমোনিয়া রোগের একটি অন্যতম প্রধান কারণ। এ ছাড়া, ছত্রাকঘটিত কারণেও অনেক সময় নিউমোনিয়া হতে পারে।

প্রশ্ন: নিউমোনিয়া কি অনেক ধরনের হতে পারে?

ভাইরাসঘটিত বা ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ থেকে নিউমোনিয়া হতে পারে। ছত্রাক থেকেও নিউমোনিয়া হয়। এদের আবার রকমফের রয়েছে।

প্রশ্ন: নিউমোনিয়ার লক্ষণ কী?

নিউমোনিয়ার প্রাথমিক লক্ষণ হল জ্বর। তার সঙ্গে কাশি। পাশাপাশি, শ্বাসকষ্টও থাকে। সংক্রমণ যত বাড়ে, শ্বাসকষ্টও বাড়তে থাকে। বুকে ব্যথা হতে পারে। বুকের ব্যথার এই ধরন তবে একটু আলাদা। সাধারণত, গভীর শ্বাস নেওয়ার সময়ে এই বুকের ব্যথা অনুভূত হবে। ফুসফুসের প্রদাহের কারণে এই ব্যথা হয়। এ ছাড়া, মাথায় যন্ত্রণা, ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়া, খাওয়ায় অনীহা, সারাক্ষণ বমি বমি ভাবও আনুষঙ্গিক লক্ষণের মধ্যে পড়ে।

প্রশ্ন: সামান্য ঠান্ডা লাগা থেকেও কি নিউমোনিয়া হতে পারে?

আসলে শীতকালে তাপমাত্রা কম থাকায় উপযুক্ত আবহাওয়া পেয়ে নিউমোনিয়া সৃষ্টিকারী ব্যাকটেরিয়া কিংবা ভাইরাস আরও বেশি সক্রিয় হয়ে ওঠে। সামান্য ঠান্ডা লাগা থেকেও কেউ কেউ নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হতে পারেন। তবে সকলেই যে সামান্য ঠান্ডা লাগলেই নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হবেন তা নয়। যাঁদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তুলনামূলক বেশি, তাঁদের ক্ষেত্রে সামান্য ঠান্ডা লাগা থেকে নিউমোনিয়া সাধারণত হয় না।

তবে যাঁদের প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল, বিশেষ করে শিশু কিংবা প্রবীণ মানুষের ক্ষেত্রে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশ বেশিই।

প্রশ্ন: সাধারণ জ্বর, সর্দি বা কাশির সঙ্গে নিউমোনিয়ার উপসর্গের পার্থক্য কী? কী করে বুঝব?

নিউমোনিয়ার প্রথম দিকে সাধারণ জ্বর, সর্দি এবং সঙ্গে কাশির উপসর্গই দেখা যায়। তবে কিছু দিন পর থেকেই এই উপসর্গগুলির প্রকোপ বাড়তে থাকে। দেখা যায়, জ্বর কিছুতেই কমছে না। সঙ্গে শ্বাসকষ্ট বাড়ছে। কাশিও একই ভাবে বাড়ছে। বুকের ব্যথাও থাকছে। সাধারণ সর্দি-কাশি হলে ওষুধ দেওয়ার পর দ্রুত চিকিৎসায় সাড়া পাওয়া যায়। এ ক্ষেত্রে তেমন হয় না।

প্রশ্ন: কোন বয়সের মানুষের আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি?

যে কোনও বয়সের মানুষই নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হতে পারে। তবে ওই যে বললাম, সাধারণত দেখা যায়, শিশু এবং বয়স্ক ব্যক্তিরাই বেশি এই রোগে আক্রান্ত হন। চার বছর বা তার কম বয়সের শিশু এবং ষাট বছর বা তার চেয়ে বেশি বয়সের ব্যক্তিদের নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে।

প্রশ্ন: কোন অবস্থায় বুঝব, বিষয়টা আরও গুরুতর হয়ে উঠেছে?

রোগীর জ্বর কমতেই চাইবে না। শ্বাসকষ্ট বাড়বে। বুকে ব্যথা থাকবে। কাশির সাথে কফ উঠলে কফে অল্প রক্তও মিশে থাকতে পারে। রোগী স্বাভাবিক থাকছে নাকি বেশির ভাগ ঝিমিয়ে পড়ছে, তা-ও লক্ষ রাখতে হবে। বয়স্কদের ক্ষেত্রে বিশেষত ফুসফুসের কোনও স্থানে সংক্রমণ হয়েছে কিনা, তা জানা দরকার।

প্রশ্ন: রোগ নির্ণয় কী ভাবে সম্ভব?

উল্লেখ করা লক্ষণগুলি দেখা দিলে দেরি না করে চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে। একমাত্র তাঁর পক্ষেই বোঝা সম্ভব যে আক্রান্ত ব্যক্তির সাধারণ ভাবে ঠান্ডা লাগার শিকার, না তিনি নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত। তার পরে নিশ্চিত হওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় কয়েকটা পরীক্ষা করাতে হয়। যেমন, অনেক সময় এক্স-রে, সিটি স্ক্যান করে দেখা হয়। তবে রোগী বিশেষে কী ধরনের পরীক্ষা করতে হবে, সেটা চিকিৎসকই ঠিক করতে পারবেন।

প্রশ্ন: প্রাথমিক ভাবে রোগীর বাড়ির লোকের কী কর্তব্য?

জ্বর না ছাড়লে বা শ্বাসকষ্ট বাড়ছে বুঝতে পারলে, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া দরকার। এর পরে চার-পাঁচ দিনেও রোগী চিকিৎসায় না সাড়া দিলে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। নিউমোনিয়া হলে রোগীকে পরিমিত জল খাওয়ানো উচিত। জলশূন্যতা বা ডিহাইড্রেশন নিউমোনিয়া রোগীর জন্য খারাপ। সময়মতো চিকিৎসা শুরু হলে জটিলতা বাড়ার সম্ভাবনা অনেকটাই কমে।

প্রশ্ন: সাধারণত নিউমোনিয়া সারতে কত দিন সময় লাগে?

রোগী কত তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠবেন, এটা নির্ভর করে আক্রান্তের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কেমন, তার উপরে। প্রাথমিক ভাবে চিকিৎসা শুরুর এক সপ্তাহের মধ্যে প্রকোপ কিছুটা কমে। রোগ পুরোপুরি সারতে মোটামুটি দু’সপ্তাহ সময় লাগে। কখনও অবশ্য তার বেশিও লেগে যেতে পারে। সবটাই নির্ভর করছে, সংক্রমণ কতটা হয়েছে, তার উপরে। সঙ্গে অবশ্যই রোগীর প্রতিরোধ ক্ষমতাও এখানে গুরুত্বপূর্ণ।

প্রশ্ন: ছোট বাচ্চাদের ক্ষেত্রেও কি উপসর্গ একই রকম হয়, না আলাদা ভাবে কিছু নজরে রাখা উচিত?

যে সমস্ত বাচ্চারা এখনও কথা বলতে শেখেনি অথবা অল্প কথা বলতে পারলেও নিজের সমস্যার কথা বুঝিয়ে বলতে পারে না, তাঁদের ক্ষেত্রে কয়েকটি বিষয় অবশ্যই নজরে রাখা উচিত। যেমন, ঠান্ডা লাগলেও বাচ্চাটি স্বাভাবিক রয়েছে কি না, অর্থাৎ, দুর্বল হয়ে পড়ছে কি না, ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করছে কি না, অতিরিক্ত ঘ্যানঘ্যান করছে কি না, সাধারণ ভাবে খেলাধুলো করছে কি না এবং সর্বোপরি তার শরীরে নিউমোনিয়ার উপসর্গ দেখা দিচ্ছে কি না, তা নজর করতে হবে।

প্রশ্ন: শীতকালে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে। সে ক্ষেত্রে বাচ্চাদের কী ভাবে যত্ন নেওয়া উচিত?

শুধু শীত নয়, বর্ষাকালেও বাচ্চারা নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হতে পারে। দেখতে হবে, কোনও ভাবেই যেন বাচ্চার ঠান্ডা না লাগে। সেটাই বাবা-মায়ের প্রাথমিক কর্তব্য হওয়া উচিত। উপযুক্ত পোশাক পরানো, ঠান্ডা আবহাওয়া থেকে দূরে রাখা দরকার। বর্ষাকালেও একই ভাবে যত্ন নিতে হবে।

প্রশ্ন: বয়স্ক ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে কী কী সাবধানতা অবলম্বন করা উচিত?

একই ভাবে বয়স্ক ব্যক্তিদেরও ঠান্ডা লাগানো চলবে না। শরীর সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে। উপসর্গের দেখা দিলেই দেরি না করে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া দরকার। এ ছাড়া, কেউ যদি অপুষ্টিতে ভোগেন, কিংবা যদি কোনও ব্যক্তির আগে থেকেই ফুসফুসে কোনও সমস্যা থেকে থাকে, তাঁদের আরও বেশি সাবধানে থাকা দরকার।

প্রশ্ন: নিউমোনিয়া প্রতিরোধে কী ব্যবস্থা নেওয়া উচিত?

যে কোনও ভাবে ঠান্ডা থেকে দূরে থাকতেই হবে। যাঁদের নিউমোনিয়া সংক্রমণের অতিরিক্ত সম্ভাবনা রয়েছে, যেমন ফুসফুসের অন্যান্য রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি, হৃদ্‌যন্ত্র, লিভারের রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি এমনকি, যাঁদের ডায়াবেটিস রয়েছে, তাঁরাও চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে নিউমোনিয়া প্রতিরোধক টিকা নিতে পারেন। এ ছাড়া, ধূমপান এবং মদ্যপান থেকে দূরে থাকা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকা, স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া, নিয়মিত শরীরচর্চার অভ্যাস তৈরি করতে পারলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সার্বিক ভাবে বাড়ে।

প্রশ্ন: নিউমোনিয়া প্রতিরোধের কি কোনও টিকা রয়েছে? কত দিন পর্যন্ত এই টিকা কাজ করে? কত দিন অন্তর এই টিকা নেওয়া যেতে পারে?

নিউমোনিয়া প্রতিরোধক টিকা রয়েছে। এই ধরনের টিকা দু’ভাবে নেওয়া যেতে পারে। এক ধরনের টিকা রয়েছে, যেটি বছরে এক বার নেওয়া যেতে পারে। পাশাপাশি, আর এক ধরনের টিকা রয়েছে, তা পাঁচ বছর অন্তর নেওয়া যেতে পারে। একে ‘বুস্টার ডোজ’ বলা হয়।

বাচ্চাদের ক্ষেত্রে নিউমোনিয়ার টিকা আগাম রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরির জন্য দেওয়া হয়। অন্য দিকে, যাঁদের নিউমোনিয়া রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি, তাঁদের অন্য ধরনের টিকা দেওয়া হয়। তবে সব ক্ষেত্রেই চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে টিকা নেওয়া দরকার।

প্রশ্ন: নিউমোনিয়ার টিকার কোনও পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া আছে কি?

নিউমোনিয়ার টিকার পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া তেমন নেই বললেই চলে। কারও কারও ক্ষেত্রে অ্যালার্জি হতে পারে। বাচ্চাদের ক্ষেত্রে অনেক সময়ে সামান্য জ্বর, পেট খারাপের মতো উপসর্গ দেখা দিতে পারে।

প্রশ্ন: নিউমোনিয়া কি ছোঁয়াচে?

নিউমোনিয়া আক্রান্ত রোগীকে স্পর্শ করলে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা নেই। কিন্তু আক্রান্ত ব্যক্তির কাশি বা হাঁচি থেকে এই রোগের জীবাণু ছড়াতে পারে। একে ‘ড্রপলেট ইনফেকশন’ বলা হয়। সাবধানতার জন্য, যাঁরা আক্রান্ত ব্যক্তির কাছাকাছি থাকেন, তাঁদের মাস্ক ব্যবহার করা দরকার।

সাক্ষাৎকার: প্রশান্ত পাল

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Pneumonia Health
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE