Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪
cancer

শেষ পর্যায়ের ক্যানসারে কষ্ট কমায় প্যালিয়েটিভ কেয়ার

ক্যানসার, ফুসফুসের ক্রনিক অসুখ সিওপিডি, আইএলডি-সহ যেসব  অসুখের টার্মিন্যাল স্টেজে রোগের কষ্ট কমানোর বা সারানোর কোনও সম্ভাবনাই   নেই, সেই অবস্থায় রোগীদের কষ্ট কমানোর চিকিৎসা পদ্ধতির ডাক্তারি নাম ‘প্যালিয়েটিভ কেয়ার’।

ক্যানসারের টার্মিনাল স্টেজ অর্থাৎ অন্তিম পর্যায়ের মানুষদের জন্য কিছু বিশেষ চিকিৎসা ব্যবস্থা প্রয়োজন। ফাইল ছবি।

ক্যানসারের টার্মিনাল স্টেজ অর্থাৎ অন্তিম পর্যায়ের মানুষদের জন্য কিছু বিশেষ চিকিৎসা ব্যবস্থা প্রয়োজন। ফাইল ছবি।

সুমা বন্দ্যোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৮ অগস্ট ২০২০ ১৫:৩৪
Share: Save:

করোনার আতঙ্কে গুরুতর অসুস্থ হয়ে না পড়লে সহজে কেউ হাসপাতালের চৌকাঠ মাড়াতে চান না। এর ফলে সংকটে পড়ছেন ক্রনিক অসুখের রোগীরা। আচমকা ভয়ানক ও জটিল সমস্যায় পড়ছেন এবং অনেক সময় চিকিৎসার আর কোনও সুযোগই পাওয়া যাচ্ছে না। পরিচিতদের মধ্যে অনেক মানুষই প্রায় বিনা চিকিৎসায় কষ্ট পেয়ে মারা যাচ্ছেন। এখনকার কোভিড পরিস্থিতিতে ক্যনাসারের টার্মিন্যাল স্টেজ অর্থাৎ অন্তিম পর্যায়ের মানুষদের জন্য কিছু বিশেষ চিকিৎসা ব্যবস্থা প্রয়োজন। বাড়িতে রেখেই তাঁদের অসহ্য যন্ত্রণা কমানোর পাশাপাশি মানসিক ভরসা দেবার চেষ্টা করতে হয়, বললেন ক্যানসার বিশেষজ্ঞ অর্ণব গুপ্ত। ক্যানসার, ফুসফুসের ক্রনিক অসুখ সিওপিডি, আইএলডি-সহ যেসব অসুখের টার্মিন্যাল স্টেজে রোগের কষ্ট কমানোর বা সারানোর কোনও সম্ভাবনাই নেই, সেই অবস্থায় রোগীদের কষ্ট কমানোর চিকিৎসা পদ্ধতির ডাক্তারি নাম ‘প্যালিয়েটিভ কেয়ার’।

নভেল করোনা ভাইরাসের অতিমারির আগে যে সব অসুখের নাম শুনে বেশির ভাগ মানুষ ভয় পেতেন, তার মধ্যে একটি ক্যানসার। শুরুতে রোগ ধরা পড়লে সার্জারি, রেডিওথেরাপি বা কেমোথেরাপির কম্বিনেশনে রোগটা অনেক ক্ষেত্রেই আটকে রাখা যায়, বললেন ক্যানসার বিশেষজ্ঞ অর্ণব গুপ্ত। তবে অ্যাগ্রেসিভ ধরনের ক্যানসারকে চিকিৎসার সাহায্যে আটকে রাখা মুশকিল। ক্যানসারের বাড়াবাড়ি অবস্থায় ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাকের মতো সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যু আসে না। রোগীকে ভয়ানক কষ্টকর অবস্থার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়।এই সময়টায় রোগীর শরীর ও মনের কষ্ট কমিয়ে তাকে যতটা সম্ভব ভাল রাখার জন্যেই দরকার প্যালিয়েটিভ কেয়ার। বিশেষ করে, যখন ক্যানসারের অন্তিম পর্যায়ে ভয়ানক যন্ত্রণায় রোগী অত্যন্ত কষ্ট পান, তখন প্যালিয়েটিভ কেয়ারের মূল উদ্দেশ্য ব্যথা কমানোর পাশাপাশি রোগীর অন্যান্য শারীরিক কষ্ট নিয়ন্ত্রণ করা ও মন ভাল রাখার চেষ্টা করা, বললেন চিত্তরঞ্জন ন্যাশনাল ক্যানসার ইনস্টিটিউটের (সিএনসিআই) ক্যানসার বিশেষজ্ঞ রণজিৎকুমার মণ্ডল।

ক্যানসারের অন্তিম পর্যায়ে রোগের নানান কষ্টকর অবস্থা কোনও মতেই ঠেকানো যায় না, তাই অসুখের শারীরিক ও মানসিক কষ্ট কমাতে উপসর্গ ভিত্তিক চিকিৎসার পাশাপাশি প্রয়োজন মনের জোরের যোগান দেওয়া। রোগীর পাশাপাশি মানসিক অবসাদের শিকার হতে পারেন আক্রান্তের কাছের মানুষেরাও। একদিকে আর্থিক দুরবস্থা অন্যদিকে কাছের মানুষের কষ্ট ও তাঁকে হারানোর ভয়— দুইয়ের এর টানাপড়েন রোগী ও তাঁর পরিজনদের হতাশ করে তোলে। তাই সিএনসিআইতে টার্মিন্যাল ক্যানসার আক্রান্তকে দেখার সময়ে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা রুমা আবেদনা হসপিস কেয়ারের ভলেন্টিয়াররা রোগী ও বাড়ির লোকজনকে কাউন্সেলিং করেন, জানালেন রণজিৎবাবু।

আরও পড়ুন: হাসপাতালে অমিল শয্যা, বাড়িতে করোনা আক্রান্তের চিকিৎসা করবেন কী ভাবে

বিশেষ করে নিম্নবিত্ত পরিবারে অসুস্থ মানুষকে নিয়ে তাঁদের পরিজন টানাপড়েনে কষ্ট পান। তাই সিএনসিআই–এর অন্তিম পর্যায়ের রোগীদের জন্য ওষুধ দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অন্যান্য সাহায্য করে এই স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা।

আরও পড়ুন: কোভিড ছড়ানোর মূলে বস্তি ও বহুতলে ফারাক নেই! কেন বলছেন ডাক্তারেরা?

অর্ণব গুপ্ত জানালেন, প্যালিয়েটিভ কেয়ার চিকিৎসায় রোগীদের নানান কষ্টকর শারীরিক সমস্যা লাঘব করা হয়। টার্মিন্যাল অসুস্থ রোগীর যে সব শারীরিক সমস্যা বেশি যন্ত্রণাদায়ক হয়ে ওঠে সেগুলি হল, নিঃশ্বাসের কষ্ট, অসহ্য যন্ত্রণা, বমি, অতিরক্ত কন্সটিপেশন, ভয়ানক ক্লান্তি, ঘুম না হওয়া, শরীর জুড়ে ব্যথা-বেদনা ইত্যাদি। এই সব কষ্ট কমানোর জন্য প্রয়োজনীয় ওষুধের সঙ্গে সঙ্গে নিউট্রিশন থেরাপি, ফিজিক্যাল থেরাপি ও ডিপ ব্রিদিং টেকনিকের সাহায্যে রোগীকে রিলিফ দিতে হয়। ঠাকুরপুকুরের সরোজ গুপ্ত ক্যানসার সেন্টার অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউটের প্যালিয়েটিভ কেয়ারের টিম রোগীদের বাড়িতে গিয়ে তাঁদের সাহায্য করেন। তবে কোভিডের কারণে এই মুহূর্তে বাড়ি গিয়ে পরিষেবা দেওয়া যাচ্ছে না, বললেন অর্ণববাবু।

ব্যথা কমানোর পাশাপাশি রোগীর অন্যান্য শারীরিক কষ্ট নিয়ন্ত্রণ করা ও মন ভাল রাখার চেষ্টা করার দায়িত্ব প্রিয়জনদের

সিএনসিআই-এর প্রিভেনটিভ অঙ্কোলজির বিভাগীয় প্রধান রণজিৎকুমার মণ্ডল জানালেন, গত এক বছরে তাঁরা প্রায় ১৯৪৫ জন অন্তিম পর্যায়ের ক্যানসার আক্রান্তকে প্যালিয়েটিভ কেয়ার পেতে সাহায্য করেছেন। কেন্দ্র সরকারের স্বাস্থ্য দফতরের সংস্থা সিএনসিআই-এর পশ্চিমবঙ্গে তিনটি ক্যাম্পাস আছে। এদের মধ্যে হাজরা মোড়ের হাসপাতালটি সম্পূর্ণ চালু, নতুন ক্যাম্পাস রাজারহাটে প্যালিয়েটিভ কেয়ারের চিকিৎসা হবে। তবে চন্দননগরের কেন্দ্র রূপলাল নন্দী মেমোরিয়াল ক্যানসার রিসার্চ সেন্টারটিতে আগামী দিনে ২০–২৫ শয্যা যুক্ত প্যালিয়েটিভ কেয়ার ইউনিট শুরু করা হবে। যেখানে যৎসামান্য খরচের বিনিময়ে অন্তিম পর্যায়ের ক্যানসার আক্রান্তদের যথাযথ চিকিৎসা দেওয়া হবে।

আক্রান্তের পাশে থাকতে হবে প্রিয়জনদের। সাহস জোগাতে হবে। ছবি: শাটারস্টক

এই প্রথম রাজ্যে সরকারি স্তরে প্যালিয়েটিভ কেয়ার চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। এই প্রসঙ্গে রণজিৎবাবু জানালেন যে, অন্তিম পর্যায়ের রোগীদের কষ্ট কমাতে মরফিন দেওয়া হয়। সিএনসিআই-তে বছরে প্রায় এক লক্ষ ডোজ মরফিন রোগীদের ব্যথা কমানোর জন্য ব্যবহার করা হয়। মূলত হাসপাতালের রোগীদেরই এই ওষুধ ট্যাবলেট, ইঞ্জেকশন বা প্যাচ হিসেবে দেওয়া হয়। বাইরের হাসপাতালের রোগীদের এই ওষুধ পেতে অসুবিধে হলে প্রেসক্রিপশন দেখে এই হাসপাতালের চিকিৎসকরা মনে করলে ওষুধটি দেওয়া হয়।

আরও পড়ুন: আপনার কেনা স্যানিটাইজারে আদৌ ভাইরাস মরছে তো? কী বলছেন চিকিৎসকরা​

ক্যানসারের অন্তিম অবস্থায় রোগীদের অনেকেই তাঁর এই কষ্টকর অসুখের জন্য ঈশ্বরের কাছে নালিশ করেন। ঈশ্বরের কাছে বার বার মৃত্যুর জন্যে আর্জি জানান। আবার কারও ক্যানসার অথবা জটিল অসুখের কথা শুনলে অনেকেই রোগীকে এড়িয়ে চলেন। প্যালিয়েটিভ কেয়ারে এই সব সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করা হয়। টার্মিন্যাল কেয়ারের সঙ্গে অনেকেই প্যালিয়েটিভ কেয়ারকে গুলিয়ে ফেলেন। যে রোগীর আয়ু হয়তো মেরে কেটে কয়েক সপ্তাহ, তাঁর চিকিৎসা পদ্ধতির নাম টার্মিন্যাল কেয়ার। আবার ক্যানসার বা অন্য কোনও রোগের অন্তিম পর্যায়ের রোগী হয়তো আরও কয়েক মাস বাঁচবেন, তাঁর জন্যে প্রয়োজন প্যালিয়েটিভ কেয়ার বা অ্যাক্টিভ টোটাল কেয়ার। এই চিকিৎসার মূল উদ্দেশ্য রোগী যে কদিন বাঁচবে্‌ যেন ভাল ভাবে বাঁচেন। মৃত্যুর জন্যে আক্ষেপ নয়, শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত ব্যথা-যন্ত্রণা সঙ্গে নিয়েও বেঁচে থাকাকে উপভোগ করতে সাহায্য করে প্যালিয়েটিভ কেয়ার।

আরও পড়ুন: বাজারচলতি ইউভি ডিভাইসে আদৌ করোনা ধ্বংস সম্ভব কি?

‘যত ক্ষণ শ্বাস তত ক্ষণ আশ’— রোগীর নিকটজনেরা এই ভেবেই শেষ চেষ্টা চালিয়ে যান। কিন্তু ভারতীয় দর্শন অনুযায়ী মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী ও মহান। তাই মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও রোগীকে হাসপাতালের নির্বান্ধব অপরিচিত পরিবেশে রেখে না দিয়ে তাকে শান্ত মনে বরণ করে নেওয়াই ভাল। বাড়িতে রেখে অন্তিম পর্যায়ের রোগীদের পাশে থাকুন, এই পরিস্থিতিতে মাথা ঠান্ডা রেখে কাছের মানুষকে মানসিক শান্তি দিতে চেষ্টা করুন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE