একটি জনপ্রিয় ভিডিয়ো গেম। প্রস্তুতকারী সংস্থার দাবি, বিশ্বজুড়ে ২০০ মিলিয়নেরও বেশি বার সেটি ডাউনলোড করা হয়েছে। আর প্রতিদিন গেমটি খেলেন ৩০ মিলিয়ন মানুষ। সেটি এতই পরিচিত যে, সম্প্রতি ‘পরীক্ষা পে চর্চা’ অনুষ্ঠানে এক শিক্ষিকা ছেলের ভিডিয়ো গেমে আসক্তি নিয়ে অনুযোগ জানালে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী প্রথমেই ওই গেমটির নাম করেন। দক্ষিণ কোরিয়ার এক সংস্থার তৈরি এই গেমের নাম ‘প্লেয়ার্সআননোন ব্যাটলগ্রাউন্ড’, সংক্ষেপে ‘পিইউবিজি’। অনলাইনে একাধিক মানুষ একসঙ্গে এটি খেলতে পারেন। খেলা শুরুর পরে অস্ত্র ও অন্যান্য জিনিস সংগ্রহ করতে করতে এগোতে হয়। আত্মরক্ষার খাতিরে মারতে হয় অন্য অংশগ্রহণকারীদের অনলাইন অবতারকে। শেষমেশ যিনি বেঁচে থাকেন, তিনিই হন বিজয়ী।
গেমপ্রেমীদের প্রশংসা পেলেও আপত্তি উঠেছে এ দেশের বিভিন্ন জায়গায়। গুজরাত সরকার একটি বিজ্ঞপ্তি জারি করে বিভিন্ন জেলা কর্তৃপক্ষকে খেলাটি নিষিদ্ধ করতে বলেছে। সে রাজ্যের প্রাথমিক শিক্ষা দফতরও গেমটি নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। সম্প্রতি কাশ্মীরে দশম ও দ্বাদশ শ্রেণির পরীক্ষার খারাপ ফলাফলের জন্য ওই গেমটিকেই দুষেছে ‘জম্মু ও কাশ্মীর স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন’। গেমটির প্রতি পড়ুয়াদের আসক্তির জেরে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে পড়াশোনা— এই যুক্তিতে জাতীয় শিশু অধিকার রক্ষা কমিশনও সেটি নিষিদ্ধ করার দাবি জানিয়েছে।
নিষিদ্ধ করার দাবির সপক্ষে রয়েছে গেমটির হিংসাত্মক দিকটিও। অভিযোগ, গেমটি খেললে অল্পবয়সিদের মধ্যে আক্রমণাত্মক আচরণ বাড়বে। প্রসঙ্গত, গুগল এবং অ্যাপল গেমটি ১৭-র বেশি বয়সিদের জন্য উপযোগী বলে চিহ্নিত করেছে। ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট পরমিত সোনি বলেন, ‘‘এই গেমগুলি সাধারণত দল তৈরি করে খেলা হয়। জেতার স্ট্র্যাটেজি তৈরি করতে হয়। থাকে পয়েন্ট জেতার সুযোগ। স্কুলপড়ুয়াদের কাছে সেটা এতটাই আকর্ষণীয় যে পিইউবিজি আর নিছক ভিডিয়ো গেম নেই, মেলামেশার ক্ষেত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। নিষিদ্ধ ঘোষণা করলে গেমটি নিয়ে কৌতূহল আরও বাড়বে। তার চেয়ে বাড়িতে বোঝানো উচিত, কেন বারণ করা হচ্ছে।’’ পরমিতের মতে, ভিডিয়ো গেমের সঙ্গে আক্রমণাত্মক আচরণের যোগসূত্র টানা অতি সরলীকরণ। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এই আচরণ নির্ভর করে পারিবারিক পরিবেশ ও বাড়ির বড়দের আচরণের উপরে। তিনি জানান, পড়াশোনার বাইরে মনোনিবেশ করার কোনও বিষয় না পেয়ে, একাকিত্ব বা সামাজিক আড়ষ্টতা থেকে অনেক বাচ্চা ভিডিয়ো গেমে আসক্ত হয়ে পড়ে। এই ফাঁদ এড়াতে বাড়িতে ও স্কুলে সুস্থ পরিবেশ দরকার।
বাড়ি ও স্কুলের ভূমিকার উপরে জোর দিচ্ছেন হিন্দু স্কুলের প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক তুষার সামন্তও। তিনি বলেন, ‘‘স্কুলপড়ুয়ারা মোবাইল নিয়ে কী করছে, তা নজরে রাখতে হবে বাড়ির বড়দেরই। গেম খেলার জেরে যে পড়াশোনায় ক্ষতি হতে পারে, বন্ধু বা পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে দূরত্ব বাড়তে পারে— এ সব উদাহরণ দিয়ে, ভালবেসে বোঝাতে হবে।’’ তাঁর মতে, এ ক্ষেত্রে এগিয়ে আসতে পারে স্কুলও। কারণ, অনেক সময়েই বাড়ির লোকেদের চেয়ে শিক্ষকেরা বোঝালে বেশি কাজ হয়। তিনি বলেন, ‘‘এই ধরনের গেম আরও আসবে। ফলে এক দিনের সচেতনতা শিবির করে তেমন লাভ হবে বলে মনে হয় না। ছোটদের প্রথম থেকেই ধারাবাহিক ভাবে বিষয়টি বুঝিয়ে যেতে হবে।’’
বালিগঞ্জ এলাকার একটি স্কুলের তরফে কৃষ্ণ দামানি বলেন, ‘‘এই বিশেষ গেমটি নিয়ে আমরা অভিভাবকদের থেকে কোনও সমস্যার কথা শুনিনি। তবে যে কোনও গেম বা ফোন, ট্যাবলেটে আসক্তিই ক্ষতিকর। এ নিয়ে আমরা পড়ুয়াদের যথাসম্ভব সচেতন করার চেষ্টা করি।’’
স্কুল অব অ্যান্টি হ্যাকিং-এর কর্ণধার এবং সাইবার বিশেষজ্ঞ সন্দীপ সেনগুপ্ত জানাচ্ছেন, সাধারণত কোনও গেমের জেরে হিংসা ছড়ানো, পড়াশোনায় ক্ষতি, সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ার মতো অভিযোগ উঠলে সেটি নিষিদ্ধ করার কথা ভাবা হয়। এ ক্ষেত্রে সরকারি নির্দেশ এলে ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার সংস্থাগুলি নির্দিষ্ট গেম আটকে দিতে পারে। তবে ঘুরপথে নিষিদ্ধ গেম খেলার রাস্তাও রয়েছে অনেক।
গেম নিষিদ্ধ করে সুরাহা হবে না বলে মনে করেন দক্ষিণ কলকাতার একটি স্কুলের ডিরেক্টর দেবী কর। তিনি বলেন, ‘‘হয়তো বাস্তব থেকে পালানোর রাস্তা হিসেবে এই গেম বেছে নিচ্ছে পড়ুয়ারা। তারা কেন এই ধরনের গেম খেলতে উৎসাহী হচ্ছে, তা নিয়ে গভীর ভাবে ভাবা দরকার। ছোটদের কী ভাবে খুশি রাখা যায়, সুস্থ রাখা যায়, তা নিয়েও ভাবতে হবে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy