Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

‘বাবা-মা পথ দেখালে পারবে সব শিশু’

অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন লেক টাউনের সাধনা পাল। যখন নিজের মেয়ের বৌদ্ধিক প্রতিবন্ধকতার কথা জানতে পারেন, বুঝে উঠতে পারেননি, এর পরে কী করতে হবে।

ছড়ার গানে তাল মেলাচ্ছে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুরা। নিজস্ব চিত্র

ছড়ার গানে তাল মেলাচ্ছে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুরা। নিজস্ব চিত্র

দেবস্মিতা ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ১৩ জুলাই ২০১৮ ০১:৫৭
Share: Save:

কাকভোরে জেগে ওঠে ডানলপের চৌধুরী বাড়ি। ছুটে-ছুটে সংসারের কাজ সারেন অর্চনাদেবী। স্কুলে পাঠানোর আগে মেঘাকে বসিয়ে মনঃসংযোগের কাজগুলো করাতে হবে যে! সেটা ঠিকঠাক হলে মেয়েটা স্কুলে গিয়ে কিছুক্ষণ এক জায়গায় বসে মন দিয়ে পড়াশোনা করতে পারবে।

শুধু শান্ত হয়ে বসলেই হবে না! ক্লাসে লেখাপড়াও করতে হবে। লিখতে হলে তার আগে সূক্ষ্ম জিনিস দিয়ে মালা গাঁথা, চিমটে দিয়ে ছোট জিনিস তোলার মতো বেশ কিছু কাজ শিশুটিকে করাতে হবে, যাতে তার হাত ও চোখের সমন্বয় ভাল হয়। সে কাজ করতে হবে বাবা-মাকেই। সম্প্রতি অটিজ়ম সংক্রান্ত একটি বই প্রকাশ অনুষ্ঠানে অভিভাবক ও বিশেষ শিক্ষকদের এক আলোচনায় এই কথাটাই ঘুরে ফিরে এল। বিশেষ শিক্ষক কাকলি কর বলেন, ‘‘অভিভাবকই তো একটি বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুর প্রধান থেরাপিস্ট। আমরা শুধু পথ দেখাই।’’

অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন লেক টাউনের সাধনা পাল। যখন নিজের মেয়ের বৌদ্ধিক প্রতিবন্ধকতার কথা জানতে পারেন, বুঝে উঠতে পারেননি, এর পরে কী করতে হবে। তিন বছরের ঐশিকা তখনও কথা বলতে পারে না। মেয়েকে নিয়ে মা ছোটেন স্পিচ থেরাপিস্টের কাছে। তাঁর কথায়, ‘‘কয়েক দিন পরে মনে হল থেরাপিস্ট তো শুধু লিখে দেন বাড়িতে কী করাতে হবে। আমাকেই যদি সব কাজ করাতে হয়, তা হলে থেরাপিস্টের ভূমিকা কী!’’ এক থেরাপিস্ট থেকে অন্য থেরাপিস্টের কাছে ঘুরে শেষে সাধনা বোঝেন, কাজটা প্রকৃতই মায়ের।

থেরাপিস্ট জাহির আব্বাস একই সুরে বলেন, ‘‘মা-বাবাই ভাল বুঝবেন সন্তান কতটা নিতে পারবে, কতটা পারবে না। অল্প সময়ে কোনও শিশুকে দেখে কি তার সব চাহিদা বোঝা যায়! ’’ থেরাপিস্টের কথা মেনে বাটি, গ্লাস, বালতি, মগ সব এক এক করে মেয়েকে চেনানো শুরু করেন সাধনা। তিনি বলেন, ‘‘রাস্তায় বেরোলেও মুখ বন্ধ হত না। গাড়ি, রাস্তা, দোকান, কুকুর কোনও কিছু বাদ যেত না।’’ এর সঙ্গে চলত নিত্যদিনের কাজ স্বাধীন ভাবে করানোর পাঠ।’’

অস্থির অর্ক আবার সারা ঘরে দৌড়ে বেড়ায়। চেয়ারে মিনিট পাঁচেক তাকে বসানোই বড় চ্যালেঞ্জ ছিল মা তানিয়ার কাছে। অনুষ্ঠানে তানিয়া জানান, ছেলের সঙ্গে খেলা জমানোর চেষ্টায় সাফল্য এসেছে তাঁরও। ‘‘যে কোনও ভাল অভ্যাস তৈরির আগে ওদের সঙ্গে খেলতে হবে। মোবাইল, ট্যাব, টিভি নয়। খেলনাবাটি, লুকোচুরি। ঠিক ছোটবেলায় যেমন আমরা খেলতাম,’’ বলেন তানিয়া।

হাওড়ার মৌ সেনগুপ্তের আক্ষেপ, ‘‘আমাদের শিশুদের অনেক জায়গায় দূরে সরিয়ে রাখা হয়। তা হলে ওদের সঙ্গে খেলবে কে, আমরা ছাড়া?’’ ফলে তিনিও সন্তানের সঙ্গে এগিয়ে চলার পথ হিসেবে বেছে নিয়েছে খেলাকেই। বাঘা যতীনের সঞ্জীব পাল আবার বিভিন্ন জিনিস দিয়ে বাড়িতে তৈরি করেছেন খেলার সরঞ্জাম। প্রায় বিকেলে তাঁর বাড়িতে জড়ো হয় এলাকার অন্য বিশেষ শিশুরাও। বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের জন্য লেক টাউনের মাঠে খেলাধুলোর আয়োজন করেন ওই এলাকার বাসিন্দা সুমিত্রা পাল। এই সব অভিভাবকই শিখছেন, বিশেষ শিক্ষা ঠিক ভাবে দেওয়া গেলে এই শিশুরা বহু দূর যেতে পারে। যেমন, বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন কিশোর শুভ্রনীল দাসের আঁকা এরই মধ্যে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে প্রদর্শনীতে জায়গা পেয়েছে। বিনায়ক রুকুর আঁকাও প্রশংসা পেয়েছে। আবৃত্তিতে নজর কেড়েছে দেবাঙ্গনা দাসগুপ্ত। বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন কিশোর বিনায়কের মা সুমন ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘বিনায়ক ছবি আঁকে, লেখে, ফেসবুক করে। একা একা বাড়ির কাছে দোকানে যায়। সব শিশু সমান নয়, তবু বাবা-মা ঠিক ভাবে শেখালে বাকিরাও নিশ্চয় পারবে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Guardians children with special needs Autism
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE