Advertisement
১৬ এপ্রিল ২০২৪

মেদের মারণ ফাঁদে

ওবেসিটি বা অতিস্থূলতা বর্তমানে এক মারাত্মক সমস্যা। এর কারণে নানা রোগ বাসা বাঁধতে পারে শরীরে। কমতে পারে আয়ুও। অতিস্থূলতার কারণ এবং প্রতিকার নিয়ে আলোচনা করলেন চিকিৎসক প্রেমকুমার বালাচন্দ্রনওবেসিটি বা অতিস্থূলতা বর্তমানে এক মারাত্মক সমস্যা। এর কারণে নানা রোগ বাসা বাঁধতে পারে শরীরে। কমতে পারে আয়ুও।

শেষ আপডেট: ২৮ ডিসেম্বর ২০১৭ ০১:২০
Share: Save:

প্রশ্ন: এখন ‘ওবেসিটি’ খুব পরিচিত একটা শব্দ বা রোগ। এটা আসলে কী?

উত্তর: ওবেসিটি হল শরীরের এক বিশেষ অবস্থা। বাংলায় একে বলে অতিস্থূলতা। শরীরে অতিরিক্ত মেদ বা চর্বিজাতীয় পদার্থ জমা হলে এই অবস্থার সৃষ্টি হয়। এর ফলে শরীরে ক্ষতিকারক প্রভাব পড়ে। নানা সমস্যার সৃষ্টি হয়। বর্তমানে ভারতে প্রায় ২৫ শতাংশ মানুষ এই অবস্থার শিকার। বিশ্বে স্থূলতা-ই মৃত্যুর অন্যতম কারণ হিসাবে চিহ্নিত। মাঝবয়সীদের মধ্যে এর প্রভাবে হৃদরোগে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। শিশুদের ক্ষেত্রেও দিনের পর দিন এর সমস্যা প্রবল ভাবে বাড়ছে,
যা আমাদের কাছে অত্যন্ত চিন্তার কারণ হয়ে উঠেছে।

প্রশ্ন: শরীরের বেশি ওজন মানেই কি ওবেসিটি?

উত্তর: শরীরের বেশি ওজন নয়, বডি মাস ইনডেক্স (বিএমআই)-এর উপরে নির্ভর করে ওবেসিটি। বিএমআই হল শরীরের উচ্চতা এবং ওজনের আনুপাতিক হার। কোনও ব্যক্তির বিএমআই-এর মানের স্বাভাবিক সীমা, ২০-২৫ এর মধ্যে। কিন্তু, বিএমআই-এর মান ২৫-৩০ এর মধ্যে হলে বলা হয় সেই ব্যক্তি মোটা, ৩০ এর বেশি হলে চিকিৎসা পরিভাষায় বলা হয় ক্লাস-১ ওবেসিটি, ৩০-৩৫ হলে ক্লাস-২, ৩৫-৪০ হলে ক্লাস-৩ এবং ৪০ এর বেশি হলে সুপার ওবেসিটি।

প্রশ্ন: ওবেসিটি হলে কী কী সমস্যা হতে পারে?

উত্তর: ওবেসিটি-র জন্য নানা ধরনের সমস্যা দেখা দিতে পারে। বলা যেতে পারে ওবেসিটি বিভিন্ন রোগকে ডেকে আনে। যেমন, হৃদরোগ, ডায়াবেটিস মেলিটাস, অস্টিও আরথ্রাইটিস, বন্ধ্যাত্ব, নিদ্রাহীনতা, মানসিক অবসাদ, শ্বাসকষ্ট ইত্যাদি। ওবেসিটির সঙ্গে ডায়াবিটিস, উচ্চ রক্তচাপ, রক্তে কোলেস্টেরল এবং ট্রাইগ্লিসারাইডের মাত্রা বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। একে ‘মেটাবলিক সিনড্রোম’ বলা হয়। এর জন্য কয়েক ধরনের ক্যানসারের আশঙ্কাও
দেখা যায়।

প্রশ্ন: এর জেরে মৃত্যুর আশঙ্কা কতটা?

উত্তর: সারা বিশ্বে মৃত্যুর অন্যতম কারণ হিসাবে ওবেসিটিকে দায়ী করা হয়। পুরুষদের থেকে মহিলাদের মধ্যে মৃত্যুর আশঙ্কা বেশি। ধূমপায়ীদের ক্ষেত্রেও আশঙ্কা তুলনামূলক বেশি থাকে। সুপার ওবেসিটি যুক্ত ব্যক্তিদের আয়ু ১০ বছর পর্যন্ত কমে যেতে পারে।

প্রশ্ন: ওবেসিটি কেন হয়?

উত্তর: অত্যধিক মাত্রায় ক্যালোরি যুক্ত খাবার খাওয়া এবং শারীরিক পরিশ্রমের অভাব— এটাই ওবেসিটির মূল কারণ হিসাবে ধরা হয়। তা ছাড়া, আরও অনেক কারণ আছে। এখন আমরা পশ্চিমী সংস্কৃতিতে অভ্যস্থ হয়ে প়ড়েছি। ফাস্ট ফুডের প্রতি ঝোঁক বাড়ছে। অনেকেই এক জায়গায় বসে ঘণ্টার পরে ঘণ্টা কাজ করছেন। ফলে শারীরিক পরিশ্রম সেভাবে হচ্ছেই না। কাজের ক্ষেত্রে বা বিভিন্ন কারণে বেশি মানসিক চাপ, অপর্যাপ্ত ঘুম, ওষুধের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার, বেশি বয়সে গর্ভবতী হওয়া— এগুলির জন্য বিএমআই বেড়ে যায়। সফট এবং হার্ড ড্রিঙ্ক—এর জন্য ওবেসিটি দেখা যায়। কিছু ক্ষেত্রে বংশগত কারণেও মানুষ ওবেসিটির শিকার হন।

প্রশ্ন: এর থেকে বাঁচার উপায় কী?

উত্তর: ওবেসিটি থেকে বাঁচার প্রধান পথ হল খাওয়া নিয়ন্ত্রণ করা, যাকে বলা হয় ডায়েটিং করা এবং শারীরিক পরিশ্রম। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা গিয়েছে, নিয়ন্ত্রিত খাওয়াদাওয়ার ফলে হয়তো ওজন কমল, তবে তা সাময়িক। একে ধরে রাখতে গেলে নিয়মিত শারীরিক পরিশ্রম ও যোগব্যায়াম করতে হবে। তবে এক্ষেত্রে সাফল্যের হার খুব কম। তবে সীমিত খাবার খাওয়া এবং শারীরিক পরিশ্রম করার পরেও কাজ না হলে ওষুধ খাওয়া যেতে পারে। ক্লাস-৩ বা সুপার ওবেসিটির ক্ষেত্রে
শল্য চিকিৎসার সাহায্য নেওয়া যেতে পারে।

প্রশ্ন: অনেক সময় দেখা যায় অনেকে খুব কম পরিমাণে খাচ্ছেন, কিন্তু তাঁর ওজন বেড়ে যাচ্ছে। এটা কেন হয়?

উত্তর: এর জন্য ধীর বিপাক ক্রিয়া বা ধীরে হজম হওয়াকেই দায়ী করা যেতে পারে। যাঁরা সাধারণত বাড়িতে বসে থাকেন, বা কোনও এক জায়গায় বসে বসে কাজ করেন, বেশি সময় ধরে টিভি দেখেন তাঁদের ক্ষেত্রেই এই লক্ষণটা দেখা যায়। এ ক্ষেত্রেও তাই একটাই উপায়— শারীরিক পরিশ্রম করে ক্যালোরি খরচ করতে হবে। অনেকে বাজারের ফাস্ট ফুডে অভ্যস্থ। বিভিন্ন ধরনের দুধের তৈরি খাবার, চকোলেট, আইসক্রিম, বার্গার, বা পিৎজা-র মতো খাবারে উচ্চ মাত্রায় ক্যালোরি থাকে। অল্প পরিমাণ খাবার খেলেও শরীরে অধিক মাত্রায় ক্যালোরির সঞ্চয় হয়। তাই সেগুলি পারতপক্ষে বর্জন করাই বাঞ্ছনীয়। এর বদলে বাড়ির তৈরি খাবার খাওয়া অনেক বেশি স্বাস্থ্যকর।

প্রশ্ন: ওষুধ খাওয়ার সঙ্গে ওবেসিটির সম্পর্ক কী?

উত্তর: অনেক ক্ষেত্রে ওষুধের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ায় মোটা হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। বেশ কিছু ওষুধ আছে যেগুলি হরমোন গ্রন্থির উপরে প্রভাব ফেলে। অনিয়ন্ত্রিত ওষুধ ব্যবহারের ফলেও শরীরের সমস্যা দেখা দিতে পারে। শরীর স্থূল হয়ে যায়।

প্রশ্ন: এ ক্ষেত্রে কখন শল্য চিকিৎসার সাহায্য নিতে হয়?

উত্তর: থার্ড লেভেল ওবেসিটি বা সুপার ওবেসিটি হলে শল্য চিকিৎসা বা অপারেশনের সাহায্য নেওয়া যেতে পারে। অথবা ওবেসিটির সঙ্গে অন্যান্য একাধিক রোগ দেখা দিলেও এই পদ্ধতির সাহায্য নেওয়া যেতে পারে। অপারেশনের মাধ্যমে শরীরের মেদ কমিয়ে বা পাকস্থলী, ক্ষুদ্রান্ত্রের মতো পরিপাক তন্ত্রের বিভিন্ন অংশের আয়তন কমিয়ে দেওয়া হয়। ফলে সেই ব্যক্তির কম খাবারেই খিদে মেটে এবং খাবার থেকে ক্যালোরি সঞ্চয়ের পরিমাণও কম হয়। এ ছাড়া গ্যাসস্ট্রিক বাইপাস, মিনি গ্যাস্ট্রিক বাইপাস, ডিওডেনাল সুইচের মতো আরও কয়েক ধরনের শল্য চিকিৎসার ব্যবস্থা আছে।

প্রশ্ন: ওজন বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে হাঁটুর সমস্যা দেখা দেয়। এর কারণ কী? প্রতিকার কী ভাবে করা যাবে?

উত্তর: দেহের উপরের অংশের ওজন বাড়লে হাঁটুতে বেশি চাপ পড়ে। ফলে হাঁটুর কার্টিলেজ ঘষা খেতে খেতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এমনকী হাড়ে হাড়েও ঘষা খায়। ফলে হাঁটুতে ব্যথা হয়। এই অবস্থাকে ডাক্তারি পরিভাষায় অস্টিও আর্থ্রাইটিস বলে। এ রকম হলে হাঁটুতে ব্যথা হয়, বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা যায় না। এ ক্ষেত্রে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত। নিয়মিত ব্যায়াম করা, কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করা দরকার।

প্রশ্ন: নাক ডাকার সাথে ওবেসিটির কোনও সম্পর্ক আছে কি?

উত্তর: ওজন বাড়লে শরীরে বাড়তি অক্সিজেন লাগে। এই বাড়তি অক্সিজেনের জোগান ঘুমের সময় কমে যায়, তাই জোর করে শ্বাস নিতে হয়। তখনই নাকে শব্দ হয়। এতে ফুসফুসে চাপ পড়ে। এই লক্ষ্মণ দেখেও বোঝা যায় শরীরের ওজন বাড়ছে। তখন থেকেই সাবধান হওয়া উচিত।

প্রশ্ন: ওবেসিটি কমানোর ঘরোয়া কোনও উপায় আছে কি?

উত্তর: সে ভাবে ঘরোয়া কোনও উপায় নেই। এর একমাত্র উপায় জীবনযাত্রার পরিবর্তন। কম চাপ নিয়ে কাজ করা, ঠিক মতো ঘুমানো, নিয়মিত হাঁটাচলা ও কিছু যোগাসন করা এবং অবশ্যই পরিমিত পরিমাণে ঘরোয়া খাবার খাওয়া। ধূমপান, অ্যালকোহল, জাঙ্কফুড, ফাস্টফুড, সফ‌ট ড্রিঙ্ক বর্জন করাই উচিত। দরকার হলে কোনও ডায়েটিসিয়ানকে দিয়ে খাবার তালিকা তৈরি করে সেই মতো খাওয়া উচিত। স্থূলতা মানেই শরীরে নানা রোগের বাসা। আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই ওবেসিটি একটা ভয়ঙ্কর সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে আমাদের সমাজে। তাই নিজেকে সুস্থ রাখতে নিজেকেই সচেষ্ট হতে হবে।

সাক্ষাৎকার: প্রদীপ মুখোপাধ্যায়

সাত দিনে সাত কাহনের বিভিন্ন বিভাগে ই-মেল বা চিঠি পাঠাতে:

ই-মেল: edit.southwestbengal@abp.in
চিঠি: আনন্দবাজার পত্রিকা,
৬, প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা- ৭০০০০১।
চিঠি বা ই-মেলে সংশ্লিষ্ট বিভাগের নাম উল্লেখ করতে ভুলবেন না

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Obesity Medicine Diet Chart
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE