Advertisement
১৭ এপ্রিল ২০২৪
কোলে-পিঠে

দায় এড়ানোর দ্বন্দ্ব

বাড়িতে অসুস্থ শিশু। এই সময় সবচেয়ে জরুরি অভিভাবকদের সহযোগিতা, সহানুভূতি ও আত্মিক ভাবে জড়িত থাকা। কিন্তু নিজেরাই বাস্তব মানতে না-পেরে অবসাদগ্রস্ত হন? তাতে জটিলতর হয় অবস্থা। সমাধান বাতলেছেন মনোচিকিৎসক সুপর্ণা রায় চট্টোপাধ্যায়। ধাক্কাটা মেনেই নিতে পারেননি অরিন্দম আর তাঁর বাবা-মা। অবসাদে ডুবে গিয়ে দোষারোপ শুরু করেছিলেন সুচন্দ্রাকে। অভিযোগ করেছিলেন—নিশ্চিত সুচন্দ্রার পরিবারের কারও এই রোগ ছিল যার থেকে অরিত্র-র মধ্যে তা এসেছে।

ছবি: প্রণব দেবনাথ

ছবি: প্রণব দেবনাথ

শেষ আপডেট: ১৫ নভেম্বর ২০১৮ ০৩:১৪
Share: Save:

অরিত্র যখন জন্মায় তখন গোটা পরিবারে হইহই ব্যাপার। ঝলমল করে উঠেছিল সুচন্দ্রা-অরিন্দমের জীবন। কিন্তু বছর পার হতে না হতেই হঠাৎ বজ্রাঘাত। অরিত্র-র আচরণে কিছু অস্বাভাবিকতা দেখে চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন সুচন্দ্রারা। বেশ কিছু পরীক্ষা করে তিনি জানিয়েছিলেন, অরিত্র ‘অটিস্টিক’। এটা এমনই একটা মানসিক সমস্যা যা-র ওষুধ এখনও আবিষ্কার হয়নি। কিছু থেরাপি-র মাধ্যমে জীবনধারণের মান উন্নত করা যায়।

ধাক্কাটা মেনেই নিতে পারেননি অরিন্দম আর তাঁর বাবা-মা। অবসাদে ডুবে গিয়ে দোষারোপ শুরু করেছিলেন সুচন্দ্রাকে। অভিযোগ করেছিলেন—নিশ্চিত সুচন্দ্রার পরিবারের কারও এই রোগ ছিল যার থেকে অরিত্র-র মধ্যে তা এসেছে। এক সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়ে অরিত্রকে ভাল রাখার দায়িত্ব নেওয়ার বদলে সব দায় ঝেড়ে ফেলেছিলেন অরিন্দম। সুচন্দ্রার সঙ্গে সম্পর্ক তলানিতে ঠেকেছিল। অধিকাংশ সময় বাড়ির বাইরে কাটাতে শুরু করেছিলেন। অটিস্টিক ছেলেকে নিয়ে অকূল পাথারে পড়েছিলেন সুচন্দ্রা। হাতড়ে বেড়াচ্ছিলেন দিশা। সেই সঙ্গে ব্যক্তিগত জীবনে এই আঘাত। এই সব কিছুর মধ্যে ক্রমাগত মানসিক অবস্থার অবনতি হচ্ছিল অরিত্র-র।

বহু পরিবারেই এই ঘটনা ঘটে। সন্তান কখনও সুস্থ হবে না, এই সত্য মেনে নিতে পারেন না অনেকে। কী ভাবে সন্তানের চিকিৎসা চালাতে হবে, জীবনধারণ প্রক্রিয়া বদলাতে হবে এটাও অনেকে ভেবে উঠতে পারেন না। তখনই অনেক অভিভাবকের মধ্যে শুরু হয় ঠেলাঠেলি। অনেকেই তখন সন্তানকেই সহ্য করতে পারেন না। দায় এড়াতে চান। স্বামী-স্ত্রী দু’জনে চাকরি করলে অনেক ক্ষেত্রে সমস্যা বাড়ে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে স্বামী চান যে, স্ত্রী চাকরি ছেড়ে দিন। সামাজিক, পারিবারিক চাপ বাড়তে থাকে তাঁর উপর। অবসন্ন, তিতিবিরক্ত হয়ে অনেক স্ত্রী-ও তখন দায় এড়ানোর পথ খোঁজেন।

সেরিব্রাল পলসি আক্রান্ত তিতিরের বাবা একদিন স্ত্রী ও সন্তানকে ছেড়ে নিখোঁজ হয়ে যান। তিতিরের মা সুমনা পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাওয়াতে না-পেরে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। কোনওরকমে তাঁকে বাঁচানো হয়। কিন্তু এর পরে তিতিরের শারীরিক ও মানসিক অবস্থার যতটুকু উন্নতি হয়েছিল তা-ও খারাপ হতে থাকে। আবার মাসকুলার ডিসট্রফি-র মতো বিরল রোগে প্রায় শয্যাশায়ী রুদ্রাণী-র দায়িত্ব বাবা-মা এত সুন্দর ভাবে ভাগ করে নিয়েছেন এবং এমন ভাবে মানসিক শক্তি জোগাচ্ছেন যে হার না-মানার জেদ তীব্র হচ্ছে দশ বছরের মেয়ের মধ্যেও

এই ধরনের শিশুর বাবা-মাকে প্রথম থেকেই ধাপে ধাপে বেশ কিছু নিয়ম মেনে চলতে হবে। প্রথমেই একটা বিষয় বুঝতে হবে যে, শিশুটি এক দিকে অক্ষম হলেও কোনও একটা দিকে নিশ্চয় সক্ষম। তাকে খুঁজে বের করতে হবে। এর জন্য প্রয়োজনে কাউন্সেলর বা চিকিৎসকের সাহায্য নেওয়া যেতে পারে। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, বাবা বা মা বা উভয়েই অহেতুক চেষ্টা করে যান শিশুকে সব দিক থেকে সক্ষম করে তুলতে। এতে শিশু তো পুরোপুরি স্বাভাবিক হতে পারেই না উল্টে বাবা-মা উৎকণ্ঠায় ভুগতে থাকেন। নিজেদের মধ্যে ঝামেলা করতে শুরু করেন।

এ সব ক্ষেত্রে প্রথমে মন শক্ত করতে হবে। পৃথিবীতে অনেককে এমন অবস্থার সামনে পড়তে হয়, এটা কোনও অস্বাভাবিক বা লজ্জাজনক অবস্থা নয় এটা বুঝতে হবে। বাবা-মা প্রথমেই একটা রুটিন তৈরি করে নিতে হবে। দায়িত্ব ভাগ করতে হবে। সকালের দিকে বাবা যদি ব্যস্ত থাকেন, তখন মা শিশুকে দেখবেন, পরে বাবা শিশুটিকে স্নান-টিফিন করিয়ে নিজে প্রস্তুত হয়ে অফিসে যেতে পারেন। তার পর অফিস থেকে ফিরে শিশুর দায়িত্ব নিতে পারেন বাবা। চিকিৎসক বা থেরাপিস্টের কাছে তাঁরা পালা করে শিশুকে নিয়ে যেতে পারেন। দু’জনেরই উচিত দিনের কিছুটা সময় নিজেদের জন্য রাখা। নিজেদের মধ্যে গল্প করা, কেনাকাটা, বই পরা, বেড়ানো, সিনেমা দেখার মতো ছোটছোট আনন্দগুলি যেন হারিয়ে না-যায়। নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়ার অভাব ও দাম্পত্য জীবনে কলহ যেন তৈরি না-হয়। এ ক্ষেত্রে একই রকমের প্রতিবন্ধকতা রয়েছে, এমন অভিভাবকেরা মিলে একটা গ্রুপ বা গোষ্ঠী তৈরি করতে পারেন। তাতে পারস্পরিক সমস্যা, কষ্ট, সমস্যা ভাগ করে নেওয়া যায়। অনেক সমস্যার দ্রুত সমাধান বের হয়, মনের চাপ লাঘব হয়।

অনেক সময় বাচ্চাকে নিয়ে বাইরে গেলে অনেকে অনেক রকম কথা বলেন। কেউ সহানুভূতি জানান, কেউ ঠেস দিয়ে কথা বলেন, কেউ দুঃখ করেন। সে সব বিশেষ গায়ে মাখবেন না। ইতিবাচক মন তৈরি করতে হবে। একান্নবর্তী পরিবারে অন্যদের সঙ্গেও বাচ্চার অসুবিধা নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে। তাতে পরিবারের অন্য সদস্যরাও শিশুটির দায়িত্ব ভাগ করে নিতে পারেন। বাবা-মা তাঁদের অন্য সন্তান থাকলে তাদেরও ভাই বা বোনের প্রতি যত্নবান হওয়ার পরামর্শ দিতে পারেন। দেখা যাবে অসুস্থ শিশু আর নিজেকে আলাদা বলে ভাববে না। তার শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি হবে আর অভিভাবকেরাও ভাল থাকবেন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE