Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

সিগারেট খেলে স্মৃতিশক্তি নষ্ট হয়, জানেন তো?

ব্যোমকেশ বক্সীর সঙ্গে দেখা করতে এসে ফেলুদা যেই চারমিনার অফার করেছেন, অমনি রে রে করে উঠলেন অজিত। সায় দিল তোপসেও। কেননা, বুদ্ধির গোড়ায় ধোঁয়া দিতে গিয়ে বুদ্ধিটাই যে বেমক্কা কমে যেতে শুরু করে। এই ব্যাপারটা ভাল করে বুঝিয়ে দেওয়া হল বাংলার সেরা দুই সত্যান্বেষীকে। মডার্ন মেডিক্যাল সায়েন্স এর প্রমাণ পেয়েছে।

সুমা বন্দ্যোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ৩০ মে ২০১৮ ১৬:২১
Share: Save:

তামাকের পাতা হোক বা ধোঁয়া, এ এমনই এক জিনিস যার এক বিন্দু গুণ নেই। যা আছে সবই অত্যন্ত ক্ষতিকর আর বিষাক্ত। কিন্তু বেশির ভাগ মানুষই ‘জেনে শুনে বিষ পান’ করেন। সিগারেটের ধোঁয়ার প্রভাবে অন্যান্য অসুখবিসুখের সঙ্গে সঙ্গে স্মৃতিশক্তি কমে যেতে শুরু করে। বিশ্ব তামাক বিরোধী দিবসের প্রাক্কালে নিজেকে ভাল রাখার জন্য বিপজ্জনক সিগারেট-বিড়ি সমেত যাবতীয় তামাকের নেশাকে পাকাপাকি বিদায় জানাতে অনুরোধ করলেন মেডিসিন বিশেষজ্ঞ অরিন্দম বিশ্বাস।

ব্যোমকেশ বক্সীর সঙ্গে দেখা করতে এসে ফেলুদা যেই চারমিনার অফার করেছেন, অমনি রে রে করে উঠলেন অজিত। সায় দিল তোপসেও। কেননা, বুদ্ধির গোড়ায় ধোঁয়া দিতে গিয়ে বুদ্ধিটাই যে বেমক্কা কমে যেতে শুরু করে। এই ব্যাপারটা ভাল করে বুঝিয়ে দেওয়া হল বাংলার সেরা দুই সত্যান্বেষীকে। মডার্ন মেডিক্যাল সায়েন্স এর প্রমাণ পেয়েছে।

ঘিলু যায় ভেস্তিয়ে বুদ্ধি গজায় না

নিকোটিন ছাড়াও সিগারেটের ধোঁয়ায় থাকা নানা ক্ষতিকর রাসায়নিকের প্রভাবে মস্তিষ্কের বাইরের দিকের স্তর কর্টেক্স (এরই আর এক নাম গ্রে ম্যাটার) ক্রমশ ক্ষয়ে যেতে শুরু করে। সম্প্রতি এডিনবার্গ ইউনিভার্সিটি ও ম্যাকগিল ইউনিভার্সিটির একদল গবেষক সমীক্ষা করে এর প্রমাণ পেয়েছেন। গবেষক দলের নেতৃত্বে ছিলেন প্রফেসর ইয়ান ডিয়ারি। প্রায় ৫৫০ জন ধূমপায়ীর মস্তিষ্কের এমআরআই করে দেখা গিয়েছে, অধূমপায়ীদের তুলনায় এদের গ্রে ম্যাটারের পরিমাণ উল্লেখযোগ্য ভাবে কম। প্রসঙ্গত, সেরিব্রাল কর্টেক্স অর্থাৎ, মস্তিষ্কের বাইরের স্তর মস্তিষ্কের মোট পরিমাণের দুই তৃতীয়াংশ এবং সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ অংশ। যে ধূমপায়ীদের উপর এই সমীক্ষা চালানো হয়েছে, তাঁদের গড় বয়স ৭৩ বছর। এদের প্রত্যেকেই দীর্ঘ দিন সিগারেটের নেশায় আসক্ত।

আরও পড়ুন: ভয়াল অসুখের আশঙ্কা, সিগারেট ছাড়বেন কী ভাবে?

সিগারেটের ধোঁয়ার ক্ষতিকর রাসায়নিকের প্রভাবে ব্রেনের গ্রে সেল ক্ষয়ে যেতে শুরু করে। প্রফেসর ইয়ান জানান, কর্টেক্স বা গ্রে ম্যাটার ব্রেনের সব থেকে উন্নত অংশ। এই অংশই আমাদের বুদ্ধিবৃত্তি, ভাবনাচিন্তার শক্তি, কথা বলা ও বোঝা, সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা-সহ বিভিন্ন মানসিক বিকাশের নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র। তাই এই অংশের ক্ষয় হলে সামগ্রিক ভাবে বুদ্ধিশুদ্ধি যায় কমে। একই সঙ্গে গন্ধবোধ চলে যাওয়ার ঝুঁকি বাড়ে। এমনিতেই বেশি বয়সে মস্তিষ্কের গ্রে সেলের কার্যক্ষমতা কিছুটা কমে যায়। তার সঙ্গে বুদ্ধির গোড়ায় যাঁরা নিরন্তর ধোঁয়া দিয়ে চলেছেন তাঁদের অবস্থা আরও কাহিল হয়ে পড়ে। সুকুমার রায় থাকলে নতুন করে লিখতেন,

ধোঁয়া খেলে ঘিলু যায় ভেস্তিয়ে,
বুদ্ধি গজায় না।

সভ্যতার শুরু থেকেই নেশার সূত্রপাত

আসলে যিশুর জন্মের ৩০০০ বছরেরও আগে থেকে আমাদের দেশে যে ধূমপানের অভ্যেস ছিল তার প্রমাণ মিলেছে। তখন অবশ্য তামাক পাতার বদলে গাঁজা গাছের পাতা পুড়িয়ে সেই ধোঁয়া টেনে নেশা করতেন আমাদের পূর্বপুরুষেরা। আর স্বয়ং মহাদেবের গাঁজায় দম দেওয়ার কথা তো সবারই জানা। তবে তামাক পাতা পুড়িয়ে তার ধোঁয়া টানার ইতিহাস খুব পুরনো নয়। তামাক গাছের আদি নিবাস উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা। ৬০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে তামাক গাছের জন্মের কিছু নমুনা মিলেছে। সেই সময়ে আমেরিকানরা দাঁতের ব্যথা কমাতে ও কাটাছেঁড়ার ওষুধ হিসেবে তামাক পাতা ব্যবহার করতেন। ১৫৮৮ সালে ভার্জিনিয়ার বাসিন্দা টমাস হ্যারিয়েট তামাক পাতা পুড়িয়ে ধোঁয়া টানার প্রচলন করেন। টমাসের ধারণা ছিল, নানা রোগ আটকাতে পারে তামাকের ধোঁয়া। সে সময়ে মুখ দিয়ে ধোঁয়া টেনে নাক দিয়ে বের করাটা পুরুষত্বের প্রতীক ছিল। বেচারি টমাস হ্যারিয়েট অত্যন্ত বেশি পরিমাণে তামাক সেবন করার ফলে অচিরেই ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। ১৬০০ খৃষ্টাব্দে স্বর্ণমুদ্রার পরিবর্তে তামাক পাতা দিয়ে বেচাকেনা শুরু হল। ১৯০২-তে শুরু হল বিশ্ববিখ্যাত সিগারেট কোম্পানি মার্লবোরো ব্র্যান্ড। তার পর দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ল ধূমপান-সহ নানা ভাবে তামাক সেবন। এই মুহূর্তে বিশ্বের ১০০ কোটি মানুষ সিগারেটের ধোঁয়ায় মজেছেন। এ ছাড়া দোক্তা, গুটখা আর খৈনির মতো তামাক চিবোনর নেশা তো আছেই। তামাক ব্যবহারকারীরা নিজেরা তো অসুখ ডেকে আনছেনই, যাঁরা তামাক অপছন্দ করেন তাঁদেরও অসুস্থ করে তুলছেন। অন্য দেশে ধূমপানের প্রবণতা কমলেও আমাদের দেশে অল্পবয়সী ছেলেমেয়েদের মধ্যে দিন দিন নেশা বাড়ছে।

আরও পড়ুন: সিগারেট খেয়ে চার ঘণ্টা বাচ্চার কাছে যাবেন না

তামাকের বিপদ এক নজরে

তরুণ তুর্কিদের অনেকেই গর্ব করে বলেন, ধূমপান পৌরুষের প্রতীক। কিন্তু চিকিৎসা বিজ্ঞান আবার উল্টো কথা বলছে। ধূমপায়ী পুরুষদের স্পার্ম কাউন্ট কমে যায়। স্পার্মের ডিফর্মিটির ঝুঁকি বাড়ে। একই সঙ্গে পুরুষত্বহীনতা ডেকে আনতে পারে। পুরুষদের বন্ধ্যাত্বে অন্যতম কারণ ধূমপান। মেয়েদের ঊর্বরতা কমায় ধূমপান, মেন্সট্রুয়াল সাইকল এলোমেলো হয়ে যেতে পারে। মেনোপজ এগিয়ে আসে। সার্ভিক্স-সহ অন্যান্য ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ে। শ্বাসনালী আর ফুসফুসের সব থেকে ক্ষতি করে সিগারেটের ধোঁয়া। শ্বাসনালীর উপরের আবরণী ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সর্দি, হাঁচি, কাশির পাশাপাশি বারংবার শ্বাসনালীর সংক্রমণ হয়। ফুসফুসের কাজ করার ক্ষমতা কমে যায়। কার্বন মনোক্সাইড, হাইড্রোজেন সায়ানাইড, আলকাতরা, আর্সেনিক, ক্যাডমিয়াম, লেড সমেত অজস্র ধাতব এবং বিভিন্ন তেজষ্ক্রিয় পদার্থ থাকে সিগারেট বিড়ির ধোঁয়ায়। এদের মধ্যে ৭০টি রাসায়ানিকই ক্যানসার উদ্দীপক। তামাক আর ক্যানসার প্রায় সমার্থক। নাক কান গলা, মুখের মধ্যে ও জিভের ক্যানসারের সঙ্গে সঙ্গে গলা, স্বরযন্ত্র, ফুসফুস ইত্যাদি বিভিন্ন অঙ্গের ক্যানসারের অন্যতম কারণ চিবোন ও ধোঁয়া ওড়ানোর তামাক। গন্ধ বোধ নষ্ট হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে। ব্লাড প্রেশার ও হার্ট রেট বেড়ে যায়। রক্তনালীর কন্সট্রিকশন বেড়ে যাওয়ায় শরীরের তাপমাত্রা কমে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে। রক্তে অক্সিজেনের পরিমাণ কমে যায় একই সঙ্গে রক্ত স্টিকি হয়ে যাওয়ায় রক্তের জমাট বাঁধার প্রবণতা বাড়ে। এর নিট ফল হার্ট ও ব্রেন অ্যাটাক। ধূমপান নিউমোনিয়া ও ইনফ্লুয়েঞ্জার ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। শরীরের বিভিন্ন অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, বিশেষত ভিটামিন সি-র পরিমাণ উল্লেখযোগ্য ভাবে কমে যায়। ত্বকে বয়সের ছাপ পড়ে নির্ধারিত সময়ের অনেক আগেই। চোখের নানা সমস্যা-সহ অন্ধত্বের আশঙ্কা বাড়ে। মাড়ি ও দাঁতের অসুখের ঝুঁকি অনেক বেড়ে যায়।

সুতরাং বিশ্ব তামাক বিরোধী দিবসে শপথ নিন তামাক মুক্ত সুস্থ জীবনের! ভাল থাকুন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Cigarette Smoking
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE