Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

শুয়োর ধরার মমতা-নিদানে বিভ্রান্তি চরমে

রোগের মূলে ভাইরাস। আর রোগ নিয়ে বিভ্রান্তি বাড়িয়ে দিল শুয়োর। সোয়াইন ফ্লু নিয়ে আগাগোড়া যে-বিভ্রান্তি ছিল, মঙ্গলবার নবান্নে মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বাস্থ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বৈঠকের পরে তা প্রশমিত না-হয়ে বেড়েই গিয়েছে।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০৩:৪৯
Share: Save:

রোগের মূলে ভাইরাস। আর রোগ নিয়ে বিভ্রান্তি বাড়িয়ে দিল শুয়োর।

সোয়াইন ফ্লু নিয়ে আগাগোড়া যে-বিভ্রান্তি ছিল, মঙ্গলবার নবান্নে মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বাস্থ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বৈঠকের পরে তা প্রশমিত না-হয়ে বেড়েই গিয়েছে।

বাড়ল কেন?

সোয়াইন ফ্লু প্রতিরোধে কী করতে হবে, তার নির্দিষ্ট দিশাই তো পাওয়া গেল না। উল্টে শুয়োর ধরার নির্দেশ দিলেন মুখ্যমন্ত্রী। কিন্তু বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু) থেকে শুরু করে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রকের নির্দেশিকা আগাগোড়া ঘেঁটেও সোয়াইন ফ্লু-র সংক্রমণের সঙ্গে শুয়োরের কোনও সম্পর্ক খুঁজে পাননি স্বাস্থ্য দফতরের কর্তারা।

রাজ্যে সোয়াইন ফ্লু নিয়ে প্রচারে বাড়াবাড়ি করলে আতঙ্কের সৃষ্টি হতে পারে, এই যুক্তিতে এত দিন ওই মারণ রোগ নিয়ে সচেতনতা অভিযানে নামেনি স্বাস্থ্য দফতর। হাসপাতাল, নার্সিংহোমে চিকিৎসার নির্দেশিকাও পাঠানো হয়নি। সতর্ক করা হয়নি পুরসভা, পঞ্চায়েতকে। সোমবার প্রথমে বিধানসভায় স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্যের বিবৃতি, তার পরে মুখ্যমন্ত্রীর বয়ানের পরিপ্রেক্ষিতে স্বাস্থ্য দফতর হঠাৎই সোয়াইন ফ্লু নিয়ে তৎপর হয়ে ওঠে। মমতা মঙ্গলবারের বৈঠকে এই ব্যাপারে কী নির্দেশ দেন, তার জন্য অপেক্ষা করছিল গোটা স্বাস্থ্য ভবন।

গত বছর উত্তরবঙ্গে জাপানি এনসেফ্যালাইটিসের উপসর্গ-সহ রোগ সংক্রমণ নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর ডাকা বৈঠকের পরেই রাজ্য জুড়ে শুয়োর ধরা অভিযান শুরু হয়। স্বাস্থ্যকর্তাদের কয়েক জনকে সাসপেন্ড করার সিদ্ধান্তও নেন মমতা। এ দিন মূলত সোয়াইন ফ্লু নিয়ে ডাকা বৈঠকে ওই রোগ নিয়ে স্বাস্থ্যকর্তাদের ঢিলেঢালা মনোভাবের জন্য কারও বিরুদ্ধে কোনও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি ঠিকই। তবে মুখ্যমন্ত্রী ফের শুয়োর ধরার অভিযানে নামার নির্দেশ দেওয়ায় স্বাস্থ্যকর্তা, পুর-প্রশাসকদের একাংশের মধ্যে বিভ্রান্তি ছড়িয়েছে।

সপ্তাহখানেক আগে কলকাতা পুরসভার কর্তা ও স্বাস্থ্যকর্তারা ঘোষণা করেছিলেন, বহু বছর আগে শুয়োর থেকে সোয়াইন ফ্লু ছড়িয়েছিল মেক্সিকোয়। এখন অবশ্য রোগটা মানুষ থেকে মানুষে ছড়াচ্ছে। শুয়োরের সঙ্গে তার আর কোনও সম্পর্ক নেই। তাই মুখ্যমন্ত্রী এ দিন শুয়োর নিয়ন্ত্রণের নির্দেশ দেওয়ায় বিভ্রান্তিতে পড়েন আমলারা। মুখ্যমন্ত্রী ঠিক কী বলেছেন, তা নিয়ে বৈঠকে উপস্থিত কর্তারা পরস্পরকে প্রশ্ন করতে থাকেন। এক পুরকর্তা সাফ জানিয়ে দেন, “মুখ্যমন্ত্রী শুয়োর ধরতে বলেছেন। সেটাই সব। কেন বলেছেন, তার কারণ খোঁজার দরকার কী?!”

কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রকের তরফে ‘ইন্টিগ্রেটেড ডিজিজ সার্ভেইল্যান্স প্রোগ্রাম’-এর অধীনে সংক্রামক রোগ প্রতিরোধ সম্পর্কে বিভিন্ন নির্দেশিকা পাঠানো হয়ে থাকে। ওই কর্মসূচির দায়িত্বে থাকা প্রদীপ খাসনবিশ এ দিন জানান, সোয়াইন ফ্লু-র দাপটের সময় যে-বার্তার সব চেয়ে বেশি প্রয়োজন, তা হল, যত দ্রুত সম্ভব রোগটাকে চিহ্নিত করতে হবে। উপসর্গ বুঝে চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে। দেরি হলে রোগীর মৃত্যুর সম্ভাবনা বাড়বে। “কেন্দ্রের তরফে এই বার্তাই দিচ্ছি আমরা। এই সময়ে শুয়োর-টুয়োর ধরার কথা পশ্চিমবঙ্গ সরকার কেন বলতে যাচ্ছে, বুঝতে পারছি না,” বলেছেন প্রদীপবাবু।

মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশকে কেন্দ্র করে যে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে, তা বুঝতে পেরে সন্ধ্যায় ‘ড্যামেজ কন্ট্রোল’ করতে অর্থাৎ সামাল দিতে আসরে নামেন রাজ্যের স্বাস্থ্যসচিব। তিনি বলেন, “মুখ্যমন্ত্রীর কথার ভুল ব্যাখ্যা দেওয়া হচ্ছে। আসলে বৈঠকে শুধু সোয়াইন ফ্লু নিয়ে আলোচনা হয়নি। ডেঙ্গি, ম্যালেরিয়া, চিকুনগুনিয়া, জাপানি এনসেফ্যালাইটিসের সঙ্গে সোয়াইন ফ্লু-র প্রসঙ্গও এসেছে। রাজ্যে সোয়াইন ফ্লু পরিস্থিতি এখন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে। জাপানি এনসেফ্যালাইটিস আটকাতে শুয়োর ধরার নির্দেশ দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। কারণ, ওই রোগ ছড়ায় শুয়োর থেকেই।”

কিন্তু সোয়াইন ফ্লু-র দাপটের মধ্যে হঠাৎ জাপানি এনসেফ্যালাইটিস (জেই)-এর প্রসঙ্গ কেন? তা হলে কি রাজ্যে আবার জাপানি এনসেফ্যালাইটিস সংক্রমণের কোনও খবর পেয়েছে স্বাস্থ্য দফতর?

রাজ্যের স্বাস্থ্য অধিকর্তা বিশ্বরঞ্জন শতপথীর জবাব, “কলকাতা বা অন্যত্র রাস্তাঘাটে শুয়োর ঘুরে বেড়ানো কি খুব স্বাস্থ্যকর বিষয়? এখন হয়তো জেই হচ্ছে না কিন্তু হয়ে গেলে কী হবে? আগে থেকে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিতে ক্ষতি কী? বিভিন্ন ধরনের ছোঁয়াচে রোগ নিয়ে আলোচনার পরে মুখ্যমন্ত্রী সার্বিক ভাবে কিছু নির্দেশ দিয়েছেন। তার মধ্যে শুয়োর ধরাও রয়েছে।”

মুখ্যমন্ত্রী গত বছর শুয়োর ধরার নির্দেশ দিয়েছিলেন। তার পরেও কী ভাবে যত্রতত্র ঘুরে বেড়াচ্ছে শুয়োর? এর জন্য কি কারও শস্তি হবে?

স্বাস্থ্যকর্তারা এর জবাব দেননি।

এ দিন মুখ্যমন্ত্রীর ডাকা বৈঠকে ছিলেন মুখ্যসচিব, স্বাস্থ্যসচিব, পঞ্চায়েত সচিব। ছিলেন কলকাতা ও হাওড়া পুরসভার মেয়রেরা এবং বিধাননগর পুরসভার চেয়ারপার্সন।

স্বাস্থ্য দফতর এবং পুরসভাগুলির ঢিলেঢালা মনোভাবের জন্যই কি এ দিন মুখ্যমন্ত্রীর এই বৈঠক?

রাজ্যের স্বাস্থ্যকর্তারা অবশ্য বলছেন, তাঁদের তরফে সচেতনতা কর্মসূচিতে কোনও ঘাটতি নেই। সোয়াইন ফ্লু পরীক্ষার পরিকাঠামোয় কিছুটা ঘাটতি ছিল। সেটুকু মেটাতে নাইসেডের সঙ্গে সঙ্গে স্কুল অব ট্রপিক্যাল মেডিসিন ও উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজে কয়েক মাসের মধ্যে সোয়াইন ফ্লু পরীক্ষা শুরু হয়ে যাবে বলে জানান স্বাস্থ্যসচিব।

সব সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে ‘আইসোলেশন বেড’ বাড়ানোর নির্দেশও দেওয়া হয়েছে। সোমবার সোয়াইন ফ্লু-র রোগীকে জোর করে বার করে দেওয়ার অভিযোগে চারটি বেসরকারি হাসপাতালকে শো-কজ করেছিল স্বাস্থ্য দফতর। ওই সব হাসপাতালের কর্তৃপক্ষ জানান, আইসোলেশন বেডের অভাবে এই ছোঁয়াচে রোগের রোগী রাখতে সমস্যা হচ্ছে। “এই বাহানা অর্থহীন। বেসরকারি হাসপাতালগুলিতে কেবিন থাকে। তার একটিকে অনায়াসে আইসোলেশন বেড হিসেবে আলাদা রাখা যায়,” বলেছেন স্বাস্থ্যসচিব।

এ দিন নবান্নের বৈঠক সেরে মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায় পুরসভায় জানান, শহরে ফের শুয়োর ধরার অভিযান শুরু হবে। এই ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে পুরসভার স্বাস্থ্য ও জঞ্জাল অপসারণ দফতর। যে-সব শুয়োর ধরা হবে, তার জন্য ক্ষতিপূরণও দেওয়া হবে মালিকদের।

নবান্ন থেকে ফিরে পুরসভার স্বাস্থ্য দফতরের অফিসারদের নিয়ে জরুরি বৈঠক করেন মেয়র-পারিষদ (স্বাস্থ্য) অতীন ঘোষ। তিনি জানান, শহরে মশা ও বায়ুবাহিত রোগের ব্যাপারে মানুষকে সচেতন করার নির্দেশ দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। মশাবাহিত রোগ প্রতিরোধের কাজ নিয়মিত ভাবেই করে থাকে পুরসভা। সোয়াইন ফ্লু-র ব্যাপারেও নাগরিকদের সচেতন করার জন্য সব রকম ব্যবস্থা নেওয়া হবে। জাপানি এনসেফ্যালাইটিসের প্রাদুর্ভাবের সময়েও শুয়োর ধরা হয়েছিল। দু’-এক দিনের মধ্যেই ফের শুয়োর ধরার অভিযান শুরু হবে।

স্বাস্থ্য দফতর সূত্রের খবর, মঙ্গলবার রাজ্যে আরও আট জনের দেহে সোয়াইন ফ্লু-র ভাইরাস মিলেছে। এ ছাড়া অসমের দু’জন রোগী এ দিন উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজে এবং ঝাড়খণ্ডের এক রোগী কলকাতার একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। উত্তরবঙ্গ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন দুই রোগীর শরীরেও সোয়াইন ফ্লু-র জীবাণু মিলেছে। তাঁদের নাম অনুজ সইকিয়া ও সুখফা হাণ্ডিক। দু’জনেই অসমের বাসিন্দা। বেসরকারি সংস্থায় কাজের প্রশিক্ষণ উপলক্ষে কয়েক মাস ধরে শিলিগুড়ির মাটিগাড়ার তুম্বাজোতে ছিলেন। হাসপাতালের সুপার সব্যসাচী দাস জানান, ওঁদের দেহে সোয়াইন ফ্লু-র এন১এইচ১ জীবাণু মিলেছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

swine flu mamata bandyopadhyay remark pig
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE