Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

সতর্ক থাকলে ডেঙ্গি প্রতিরোধ সম্ভব

ডেঙ্গির মরসুম চলে এসেছে। সাম্প্রতিক সময়ে এই রোগ নিয়ে আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি হয়েছে। প্রাণহানিও ঘটেছে। অযথা আতঙ্কিত না হয়ে, একটু সতর্ক থাকলে, চিকিৎসকের পরামর্শ মতো চললে ডেঙ্গি প্রতিরোধ সম্ভব। জানাচ্ছেন চিকিৎসক মফিদুল ইসলাম।ডেঙ্গি ভাইরাস বহনকারী মশা মানুষের শরীরে কামড়ালে ভাইরাস মানুষের দেহে সংক্রামিত হয়। ভাইরাস প্রথমে লালার মাধ্যমে ত্বকের ভিতরে প্রবেশ করে। পরে শ্বেত রক্তকোষে ঢোকে। সেই কোষ শরীরের সর্বত্র চলাচল করলে সেগুলির ভিতরে এই ভাইরাস প্রজনন চালিয়ে যায়। প্রবল সংক্রমণে শরীরের ভিতরে ভাইরাসের উৎপাদন অত্যধিক বৃদ্ধি পায়। যাদের ক্রনিক অসুখ, যেমন ডায়াবেটিস, অ্যাজমা, অ্যানিমিয়া, টিবি আছে তাদের এবং বয়স্কদের ক্ষেত্রে ডেঙ্গি প্রাণঘাতী হতে পারে।

শেষ আপডেট: ০৯ অগস্ট ২০১৮ ০২:০৫
Share: Save:

প্রশ্ন: আমরা বর্ষাকালের বেশ খানিকটা সময় পেরিয়ে এসেছি। এই সময়ে মশাবাহিত বেশ কয়েকটি রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। যার মধ্যে অন্যতম ডেঙ্গি। প্রথমেই তাই জানা দরকার ডেঙ্গি কী?

উত্তর: ডেঙ্গি হল একটি ভাইরাসঘটিত রোগ। এডিস ইজিপ্টাই মশার দ্বারা মানুষের শরীরে এর সংক্রমণ ঘটে। ডেঙ্গির কারণে যে সব লক্ষণ দেখা দেয় তার অন্যতম হল, সারা শরীরে অসহ্য ব্যথা-সহ জ্বর, সঙ্গে বমি বমি ভাব, চোখের পিছনে ব্যথা এবং সারা শরীরে র‌্যাশ। কিছু ক্ষেত্রে এটি প্রাণঘাতী হতে পারে।

প্রশ্ন: এই রোগটি কখন এবং কাদের মধ্যে হয়?

উত্তর: বিশেষ করে গ্রীষ্ম ও বর্ষার সময়ে ডেঙ্গির প্রকোপ বেশি হয়। সাধারণত শহরাঞ্চলে এর প্রাদুর্ভাব বেশি হয়।

প্রশ্ন: কী ভাবে ডেঙ্গির সংক্রমণ ঘটে?

উত্তর: এটি একটি আরএনএ ভাইরাস ঘটিত রোগ, যা এডিস ইজিপ্টাই মশার দ্বারা ছড়ায়। স্ত্রী এডিস মশা ডেঙ্গি আক্রান্তের রক্ত পান করলে প্রথমে তার দেহে ভাইরাসের সংক্রমণ ঘটে। স্ত্রী মশা পেটে এই ভাইরাস বহন করে। তবে, মশার উপরে এই ভাইরাসের ক্ষতিকারক প্রভাব পড়ে না। প্রায় ৮-১০ দিন পরে সেই ভাইরাস মশার দেহের অন্যান্য অংশে ছড়িয়ে পড়ে ও মশার লালাগ্রন্থির মাধ্যমে লালাতেও চলে আসে। ডেঙ্গি ভাইরাস বহনকারী মশা মানুষের শরীরে কামড়ালে ভাইরাস মানুষের দেহে সংক্রামিত হয়। ভাইরাস প্রথমে লালার মাধ্যমে ত্বকের ভিতরে প্রবেশ করে। পরে শ্বেত রক্তকোষে ঢোকে। সেই কোষ শরীরের সর্বত্র চলাচল করলে সেগুলির ভিতরে এই ভাইরাস প্রজনন চালিয়ে যায়। প্রবল সংক্রমণে শরীরের ভিতরে ভাইরাসের উৎপাদন অত্যধিক বৃদ্ধি পায়। যাদের ক্রনিক অসুখ, যেমন ডায়াবেটিস, অ্যাজমা, অ্যানিমিয়া, টিবি আছে তাদের এবং বয়স্কদের ক্ষেত্রে ডেঙ্গি প্রাণঘাতী হতে পারে।

প্রশ্ন: এই রোগের সংক্রমণের আশঙ্কা দিনের কোন সময়ে বেশি থাকে?

উত্তর: ডেঙ্গির মশা সাধারণত দিনের বেলায়, বিশেষ করে ভোরে ও সন্ধ্যার দিকে কামড়ায়। তাই সংক্রমণের আশঙ্কা দিনের ওই দু’টি সময়ে সব থেকে বেশি থাকে। এ ছাড়া বর্ষাকালে ডেঙ্গির প্রকোপ বেশি হয়। কারণ, এই সময়ে এডিস মশার ডিম পাড়ার সম্ভাবনা বেশি। ফলে এই প্রজাতির মশার সংখ্যা বাড়ে। এর থেকে সংক্রমণের আশঙ্কাও বাড়ে।

প্রশ্ন: কী ভাবে বোঝা যাবে ডেঙ্গি হয়েছে বা এই রোগের সাধারণ উপসর্গগুলি কী?

উত্তর: অন্যান্য জ্বরের সঙ্গে ডেঙ্গি জ্বরের পার্থক্য প্রাথমিক অবস্থায় বোঝা মুশকিল। তবে চিকিৎসকেরা রক্তের কয়েক রকম পরীক্ষা করে এবং রোগের গতিপ্রকৃতি ও লক্ষণ দেখে বুঝতে পারেন রোগী ডেঙ্গিতে আক্রান্ত হয়েছেন কি না। এ ক্ষেত্রে জ্বরের স্থায়িত্ব হয় তিন থেকে ১৪ দিন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তা চার থেকে সাত দিনের মধ্যেই উপশম হয়ে যায়। তবে বেশ কিছু রোগের ক্ষেত্রে জ্বর অনেকটা ডেঙ্গি জ্বরের মতো। মূলত ম্যালেরিয়া, লেপ্টোস্পাইরোসিস, ইনফেকটিভ হেপাটাইটিস, চিকুনগুনিয়া, রুবেলা, ইনফ্লুয়েঞ্জার জ্বর ডেঙ্গি জ্বরের মতোই হয়। অনেক সময়ে ডেঙ্গির জ্বর সাধারণ জ্বরের মতোই প্রকাশ পায় বা সে ভাবে মারাত্মক আকার নেয় না। সাধারণ কিছু ওষুধেই তা সেরে যায়।

প্রশ্ন: তা হলে কখন ব্যাপারটা মারাত্মক আকার নেয়?

উত্তর: ডেঙ্গিকে সাধারণভাবে তিন ভাগে ভাগ করা যেতে পারে—

(১) ক্লাসিক্যাল ডেঙ্গি: এটি বেশি দেখা যায়। খুব বেশি মারাত্মক হয় না। সাধারণ কিছু কনজারভেটিভ ট্রিটমেন্টেই নিরাময় হয়ে যায়। এই প্রকার ডেঙ্গিতে জ্বরের সঙ্গে সারা শরীরে অসহ্য ব্যথা হয়। এর জন্য এই জ্বরকে বলা হয়, ব্রেক বোন ফিভার বা হাড় ভাঙা জ্বর। সঙ্গে মাথা ব্যথা, বমি ভাব, চোখের পিছনে ব্যথা এবং প্রচণ্ড শারীরিক দুর্বলতা থাকতে পারে।

(২) হেমারেজিক ডেঙ্গি ফিভার: এটি বেশি ক্ষতিকারক এবং এই রোগের জন্য রোগীকে হাসপাতাল বা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ভর্তি করতে হতে পারে। এই রোগের প্রধান লক্ষণ হল, রক্তের মধ্যে প্লেটলেট বা অনুচক্রিকার সংখ্যা কমে যাওয়া এবং রক্তের ঘনত্ব বাড়িয়ে দেওয়া। যার ফলে শরীরের বিভিন্ন অংশ থেকে রক্তক্ষরণ হতে থাকে এবং চামড়ায় ছোট ছোট রক্তের দাগের মত র‌্যাশ হয়, যাকে চিকিৎসা পরিভাষায় ‘পেটিচি’ বলা হয়।
(৩) ডেঙ্গি শক সিনড্রোম: এই প্রকারের ডেঙ্গি সব থেকে মারাত্মক। যা থেকে মানুষের মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। ডেঙ্গি শক সিনড্রোম থেকে মানব দেহে জল শূন্যতা তৈরি হয়। সঙ্গে সঙ্গে পাল্স রেট অনেকটা বেড়ে যায় এবং রক্তচাপ খুব কমে যায়। শরীর ঠান্ডা হয়ে যায়। শ্বাসপ্রশ্বাস খুব দ্রুত চলে। রোগী অস্থির হয়ে ওঠেন।

প্রশ্ন: ডেঙ্গি হয়েছে কি না তা কী ভাবে নির্ণয় করা হয়?

উত্তর: অধিকাংশ ক্ষেত্রে ডেঙ্গি হলে খুব বেশি পরীক্ষানিরীক্ষা করার দরকার নেই। সাধারণত জ্বরের চার পাঁচ দিন পরে এনএস-১ অ্যান্টিজেন টেস্ট করে বোঝা যায় ডেঙ্গি হয়েছে কি না। জ্বরের স্থায়িত্ব আরও কিছু দিন বেশি হলে আইজিএম ম্যাক এলাইজা স্ট্রিপ টেস্ট করে ডেঙ্গি রোগ সম্পর্কে জানা যায়। সঙ্গে সঙ্গে রক্তের প্লেটলেট পরিমাপ করে রোগের ব্যাপকতা সম্পর্কে ধারণা করা যায়। তবে চার-পাঁচ দিনের আগে করলে রিপোর্ট স্বাভাবিক থাকতে পারে। আগে আগে পরীক্ষা করালে অনেকে বিভ্রান্তিতে পড়তে পারেন।

প্রশ্ন: প্লেটলেট বা অনুচক্রিকার পরিমাণ কত হলে রোগীর অবস্থা খারাপ বলে মনে করা হয়?

উত্তর: সাধারণত প্রতি ঘন মিলিলিটার রক্তে এক লক্ষের কম পরিমাণ অনুচক্রিকা থাকলে রোগীর অবস্থা সংকটজনক বলে মনে করা হয়। তখন প্লেটলেট দিতে হতে পারে।

প্রশ্ন: ডেঙ্গি রোগের চিকিৎসা কী ভাবে করা উচিত?

উত্তর: বেশির ভাগ রোগীই কোনও স্থায়ী সমস্যা ছাড়াই ডেঙ্গি থেকে আরোগ্যলাভ করেন। ঠিকমতো চিকিৎসায় মৃত্যুহার এক শতাংশেরও কম। সাধারণ ভাবে ডেঙ্গি জ্বরের চিকিৎসা রোগের ব্যাপকতা এবং লক্ষণ অনুযায়ী করা হয়। প্রথমত, জ্বরের জন্য প্যারাসিটামল জাতীয় ওষুধ ঠিকমতো ডোজে দিলে জ্বর কমে। এ ছাড়াও স্পঞ্জিং করা হয়, যা খুব ভাল কাজ করে। লক্ষ্য রাখতে হবে যাতে শরীরের তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের নীচে থাকে। কোনও ভাবেই যেন রোগীকে ব্যথা কমানোর জন্য অ্যাসপিরিন বা ওই জাতীয় ওষুধ না দেওয়া হয়। অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চলা উচিত। সম্পূর্ণ নিরাময় না হওয়া পর্যন্ত বিশ্রামে থাকতে হবে। যথেষ্ট পরিমাণ জল, সরবত, ডাবের জল, অন্যান্য তরল জাতীয় খাবার দিতে হবে। খেতে না পারলে স্যালাইন দিতে হবে।

প্রশ্ন: অ্যাসপিরিন জাতীয় ওষুধ দেওয়া বারণ কেন?

উত্তর: ডেঙ্গির জ্বর যদি হেমারেজিক জ্বরে পরিবর্তিত হয়, তবে অ্যাসপিরিন জাতীয় ওষুধ খেলে ফল মারাত্মক হতে পারে। তখন শরীরের নানা অংশ থেকে রক্তক্ষরণ হতে পারে। যা রোগীর জীবন বিপন্ন করতে পারে। এ ছাড়া রোগীকে ওআরএস দিতে হবে। হাসপাতাল বা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ভর্তি হলে স্যালাইন দেওয়া হয়, যাতে শরীরের জলশূন্যতা রোধ করা যায়।

প্রশ্ন: কী ধরনের পরিস্থিতি হলে রোগীকে বাড়িতে না রেখে হাসপাতালে ভর্তি করা উচিত?

উত্তর: যদি রোগীর রক্তচাপ কমে যায়, পালস রেট বেড়ে যায়, প্রস্রাব কমে যায়— তা হলে তা বিপদের লক্ষণ। এই অবস্থায় রোগীকে অবশ্যই হাসপাতাল বা নিকটবর্তী স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ভর্তি করানো উচিত। তা হলে রোগীর জীবনহানি আটকানো যেতে পারে। অন্যান্য উপসর্গগুলিও চিন্তার। যেমন, রোগীর বমি হওয়া, পেটে ব্যথা হওয়া, শরীরের বিভিন্ন অংশ থেকে রক্তক্ষরণ হওয়া ইত্যাদি। এগুলি সবই রোগের মাত্রা বেড়ে যাওয়ার লক্ষণ।

প্রশ্ন: ডেঙ্গি হলে কি শরীরের অন্য অঙ্গে তার কোনও প্রভাব পড়ে?

উত্তর: মাঝে মাঝে ডেঙ্গি অন্যান্য অনেক অঙ্গকেও আক্রমণ করতে পারে। খুব মারাত্মক অবস্থায় মস্তিষ্কে ভাইরাসের সংক্রমণ ঘটে। এতে নিউরোলজিক্যাল ডিসঅর্ডার হতে পারে। এ ছাড়া অ্যাকিউট লিভার ফেলিওর বা হৃৎপিণ্ডেও সংক্রমণ হতে পারে।

প্রশ্ন: এক বার ডেঙ্গিতে আক্রান্ত হওয়ার পরে কি ভবিষ্যতে ফের ডেঙ্গি সংক্রমণের আশঙ্কা থাকে?

উত্তর: ডেঙ্গি ভাইরাস চার প্রকার বা সেরোটাইপের হয়। তাই ডেঙ্গিও চার বার হতে পারে। যে প্রকার ডেঙ্গিতে এক বার আক্রান্ত হয়, শরীরে সেই নির্দিষ্ট প্রকার বা সেরোটাইপের বিরুদ্ধে ইমিউনিটি তৈরি হয়। কিন্তু অন্য প্রকারের ডেঙ্গিতে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থেকেই যায়। তবে এক বার ডেঙ্গিতে আক্রান্ত হওয়ার পরে পুনরায় রোগটি হলে সেটি মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ হয়। বিশেষ করে শিশুদের ক্ষেত্রে এটি মারাত্মক হতে পারে।।

প্রশ্ন: ডেঙ্গি হওয়া কী ভাবে আটকানো যেতে পারে?

উত্তর: ডেঙ্গি ভাইরাসের কোনও স্বীকৃত টিকা নেই। এর প্রতিরোধ নির্ভর করে জীবাণুবাহী মশা নিয়ন্ত্রণ ও তার কামড় থেকে বাঁচার উপরে। মশা নিয়ন্ত্রণের প্রাথমিক পদ্ধতি হল এর বৃদ্ধির পরিবেশকে ধ্বংস করা। ডেঙ্গির মশা সাধারণত স্থির ও পরিষ্কার জলে ডিম পারে। তাই বাড়ির চারপাশে যাতে কোনও জায়গায় জল না জমে থাকে তা দেখতে হবে। বাড়ির আশপাশের ভাঙাপাত্র, নর্দমা বা ডোবাতে জল জমতে না দেওয়া ও পরিষ্কার রাখা অত্যন্ত জরুরি। তা ছাড়া বিভিন্ন রকম মশা নিরোধক কীটনাশক বা বায়োলজিক্যাল কন্ট্রোল এজেন্ট স্প্রে করা যেতে পারে। তবে পরিবেশের উপর কীটনাশকের কুপ্রভাবের কথা মাথায় রেখে জল জমতে না দেওয়াটাই ভাল উপায়। এ ছাড়া পুরো শরীর পোশাকে ঢেকে রাখা, ঘুমানোর সময় মশারি ব্যবহার করার উপরে জোর দিতে হবে। ডেঙ্গি আক্রান্তকে অবশ্যই সব সময়ে মশারির মধ্যে রাখতে হবে, যাতে মশা তাকে কামড়াতে না পারে। ডেঙ্গি-র মশা আগেও ছিল, এখনও আছে। তাই একমাত্র সচেতনতা ও প্রতিরোধের মাধ্যমেই এর হাত থেকে বাঁচা সম্ভব।

সাক্ষাৎকার: প্রদীপ মুখোপাধ্যায়

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Dengue Precaution Fever
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE