শেষমেশ রেগে গিয়ে ভদ্রলোক পাশের সহযাত্রীর হাতে তুলে দিয়েছিলেন নিজের মোবাইল। তার পরে একটু শ্লেষাত্মক ভাবেই বলেছিলেন, ‘‘নিন, আপনি দেখে নিন ভাল করে। দেখা হলে আমাকে দেবেন।’’ পাশের সহযাত্রী প্রথমে আমতা-আমতা করে তার পরে প্রবল প্রতিবাদ করলেন। তা নিয়েই শুরু হল দু’পক্ষের কথা-কাটাকাটি, চিৎকার।
প্রথম জনের অভিযোগ ছিল, তিনি নিজের মোবাইলটি বার করলেই পাশের সহযাত্রী তাতে উঁকি মেরে দেখছেন। এমনকি, হোয়াটসঅ্যাপ চ্যাট চলাকালীনও ওই সহযাত্রী না কি চোখ সরাননি! যদিও অভিযোগ পুরো অস্বীকার করেছিলেন দ্বিতীয় জন। ঘটনার সত্যতা বিচার করা যায়নি যদিও। কিন্তু কিছু দিন আগে মেট্রোযাত্রার ওই ঘটনার সঙ্গে অনেকেই নিজেদের অভিজ্ঞতার মিল খুঁজে পেয়েছিলেন। ওই মেট্রো কামরাতেই থাকা কয়েক জন যাত্রী মন্তব্যও করেছিলেন, ‘সত্যিই! মোবাইল বার করার উপায় নেই। পাশের জন হুমড়ি খেয়ে পড়ছেন তাতে!’
আর অন্যের মোবাইলে উঁকি দেওয়ার প্রবণতা ক্রমশ বাড়ছে বলেই মনে করছেন অনেকে। রাস্তাঘাটে যাতায়াতের সময়ে মোবাইল বার করলেই তার দিকে কখনও আড়চোখে, কখনও সরাসরি তাকিয়ে থাকছেন পাশের মানুষ। এমনকি, ফেসবুক মেসেঞ্জার বা হোয়াটসঅ্যাপ চ্যাটের মতো ব্যক্তিগত কথোপকথনের ভিতরেও উঁকি মেরে দেখছেন তাঁরা। এই প্রবণতাকে কেউ বলছেন, বিনোদন, নিছকই দায়হীন মনোরঞ্জন। কেউ বলছেন বিকৃতি, ‘পার্ভর্শন’। কেউ আবার বলছেন, নিষিদ্ধের প্রতি টান!
মনোবিদদের একাংশের মতে, পাশের জনের মোবাইলে উঁকি দেওয়াটা আসলে একটা সহজ বিনোদনের মাধ্যম। তাতে রহস্যের একটা অনুষঙ্গও জড়িয়ে আছে। পাশের জন, যাঁর সম্পর্কে কিছুই জানি না, তিনি কার সঙ্গে কী কথা বলছেন, সেটা জানার মধ্যে একটা সস্তা বিনোদন রয়েছে। মনোরোগ চিকিৎসক রিমা মুখোপাধ্যায় বলছেন, ‘‘সবচেয়ে বড় ব্যাপার হল, এই বিনোদনের জন্য কোনও দায় নিতে হবে না। তবে ব্যক্তিগত মানসিকতা, রুচির উপরেও বিষয়টি নির্ভর করছে।’’
সমাজতাত্ত্বিকদের একাংশ আবার এর মধ্যে একটা সুপ্ত বিকৃতি খুঁজে পেয়েছেন। সমাজতত্ত্বের শিক্ষক অভিজিৎ কুণ্ডু বলেন, ‘‘যে ভদ্রলোক পাশের জনের মোবাইলে উঁকি দিয়ে কারও ব্যক্তিগত কথোপকথন দেখছেন, তিনি হয়তো পাশের ফ্ল্যাটে কী হচ্ছে, তা জানেন না। কারণ, সেটা জানতে গেলে তাঁকে ঝামেলায় জড়িয়ে পড়তে হতে পারে বা কোনও ঘটনার দায়িত্ব নিতে হতে পারে। কিন্তু সেই ভদ্রলোকই অন্যের মোবাইলে উঁকি দিয়ে ব্যক্তিগত চ্যাট দেখছেন! এটা অবদমিত বিকৃতি বা পার্ভর্শন!’’ লেখক স্মরণজিৎ চক্রবর্তী আবার পুরো ঘটনার মধ্যে দায়হীন মনোরঞ্জনের সঙ্গে খুঁজে পেয়েছেন নিষিদ্ধ উত্তেজনার প্রতি মানুষের আদি ও অকৃত্রিম টানের দিকটিও। স্মরণজিৎবাবুর কথায়, ‘‘অন্যের মোবাইলে উঁকি দিয়ে কারও ব্যক্তিগত অবস্থান জানতে গেলে কোনও দায়িত্ব নিতে হয় না। কিন্তু সাময়িক কৌতূহল মেটার পাশাপাশি নিষিদ্ধতার প্রতি মানুষের যে আকর্ষণ, তারও নিবৃত্তি হয় আর কী!’’
সোশ্যাল মিডিয়ায় তথ্য কতটা নিরাপদ, এই বিষয়টি ফের সেই প্রশ্নকেই সামনে এনেছে বলে মনে করছেন তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞদের একাংশ। সেই সঙ্গে ‘মোবাইল এটিকেট’ও ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে পড়ছে বলে মনে করছেন তাঁরা। প্রসঙ্গত, ব্যক্তিগত তথ্যের গোপনীয়তার জন্য হোয়াটসঅ্যাপের মতো সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং মাধ্যম ‘এন্ড টু এন্ড এনক্রিপশন’ চালু করেছে, নেটওয়ার্কের অন্য কেউ যাতে ব্যক্তিগত তথ্যের হদিস না পায়। ‘ইনভিসিব্ল মোবাইল স্ক্রিন’ প্রযুক্তি ইতিমধ্যে বাজারেও এসেছে। এই প্রযুক্তিতে শুধুমাত্র যাঁর হাতে মোবাইল, তিনিই বিশেষ চশমার সাহায্যে মোবাইলের কোনও
মেসেজ পড়তে পারবেন। পাশের জনের কাছে সে মোবাইল স্ক্রিন সাদাই থাকবে! তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ কল্যাণ কর বলেন, ‘‘ব্যক্তিগত তথ্যের নিরাপত্তার কারণেই এমন স্ক্রিনগার্ড বা মোবাইল স্ক্রিন তৈরি করা হচ্ছে। দেখা যাচ্ছে, এই প্রযুক্তির দাবি ক্রমশ বাড়ছে। আসলে মোবাইল এটিকেট বেশি করে প্রয়োজনীয় হয়ে পড়ছে। কারণ, অন্যের মোবাইলে যে উঁকি দেওয়া যায় না, সেই সৌজন্যবোধ অনেক সময়েই বজায় রাখতে পারছি না আমরা!’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy