Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

শীত বলেই দেদার খাওয়া নয়

ভরা শীত। রসনা তৃপ্তির আদর্শ সময়। কিন্তু, নিয়ন্ত্রণ রাখা উচিত। না হলে, পেটে নানা সমস্যা হতে পারে। জানাচ্ছেন চিকিৎসক প্রদীপকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় প্রশ্ন: শীতকালে পেটে সমস্যা হতে পারে কি? উত্তর: যে কোনও সময়েই পেটের সমস্যা হতে পারে। তবে তুলনামূলক ভাবে গ্রীষ্ম বা বর্ষাকালের তুলনায় শীতকালে পেটের সমস্যা কম হয়।  ঋতু পরিবর্তনের সময়ে অর্থাৎ শীতের শুরুর দিকে শিশুদের ক্ষেত্রে বিশেষ করে পেটের সমস্যার একটা আশঙ্কা থাকে।

রোগী দেখছেন চিকিৎসক। নিজস্ব চিত্র

রোগী দেখছেন চিকিৎসক। নিজস্ব চিত্র

শেষ আপডেট: ১০ জানুয়ারি ২০১৯ ০২:৩২
Share: Save:

প্রশ্ন: শীতকালে পেটে সমস্যা হতে পারে কি?

উত্তর: যে কোনও সময়েই পেটের সমস্যা হতে পারে। তবে তুলনামূলক ভাবে গ্রীষ্ম বা বর্ষাকালের তুলনায় শীতকালে পেটের সমস্যা কম হয়। ঋতু পরিবর্তনের সময়ে অর্থাৎ শীতের শুরুর দিকে শিশুদের ক্ষেত্রে বিশেষ করে পেটের সমস্যার একটা আশঙ্কা থাকে।

প্রশ্ন: কী ধরনের সমস্যা হতে পারে?

উত্তর: সাধারণত গ্যাস, অম্বল, বদহজম তো হতেই পারে। তা ছাড়া, পেট ব্যথা, পাতলা পায়খানা বা বমিও হতে পারে।

প্রশ্ন: কী কী লক্ষণ দেখলে বোঝা যাবে যে পেটের সমস্যা হয়েছে?

উত্তর: পেটে ব্যথা, চোঁয়াঢেকুর, পেট ফাঁপা, পেট ভার, গা-বমি ভাব, শরীর আনচান করা, খিদে না পাওয়া বা খেতে ভাল না লাগা—এ ধরনের সমস্যা হলে বুঝতে হবে পেটের সমস্যা হয়েছে। ব্যাকটেরিয়া থেকে সমস্যা হলে সাধারণত পায়খানার সঙ্গে বমি হয়। জ্বরও হতে পারে। এ ছাড়া শিগেলা জাতীয় এক ধরনের জীবাণুর জন্য পেটের অসুখ হতে পারে। সে ক্ষেত্রে পায়খানার সঙ্গে রক্তও বের হতে পারে। এটি খুব মারাত্মক। ঠিকমতো চিকিৎসা না হলে, প্রাণ সংশয় পর্যন্ত হতে পারে।

প্রশ্ন: কী কারণে বদহজমের সমস্যা হতে পারে?

উত্তর: খাবার ঠিকমতো হজম না হলে পেটে সমস্যা হয়। বিভিন্ন কারণে খাবার হজম হয় না। যেমন, অতিরিক্ত মশলাদার খাবার খাওয়া। সারা বছর নিয়মিত একটি নির্দিষ্ট ধরনের খাবার খাওয়ার প্রবণতা থাকে। তার বাইরে গিয়ে অতিরিক্ত মশলাদার খাবার, মাংস, মিষ্টি বা ফাস্টফুড জাতীয় খাবার খেলে শরীরের পরিপাকতন্ত্র খুব সহজে তা হজম করতে পারে না। তখনই গণ্ডগোল হয়। সাধারণত শীতে এর প্রবণতা বাড়ে। এ ছাড়া, আরও অন্য কয়েকটি কারণেও পেটে সমস্যা হয়। যেমন, জল থেকে। জলের মাধ্যমে অনেক জীবাণু পেটে ঢোকে। অপরিষ্কার জায়গায় খাবার খেলে এ ধরনের সমস্যা হতে পারে। সেখানে পাত্র ঠিকমতো পরিষ্কার হয় না। এ ছাড়া, পেটের মধ্যে এন্ডোটক্সিন জাতীয় রাসায়নিক ঢুকলে বা তৈরি হলে পেটের সমস্যা হয়। ব্যাকটেরিয়া মারা গেলে এ ধরনের ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ বের হয়। এন্ডোটক্সিন জাতীয় রাসায়নিকের প্রভাবে সাধারণত পাতলা পায়খানার সঙ্গে বমি হয়। এ ক্ষেত্রে অ্যান্টিবায়োটিকে সে ভাবে কাজ করে না। তখন বেশি ইলেক্ট্রল পান করতে হবে, বিশ্রাম নিতে হবে। দু’-এক দিন খাওয়ায় নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।

প্রশ্ন: আচ্ছা হজম বলতে আমরা কী বুঝি?

উত্তর: আমরা যে খাবার খাই, তার মধ্যে কার্বোহাইড্রেট, ফ্যাট, প্রোটিন— এই তিনটি প্রধান উপাদান থাকে। এগুলি পেটের মধ্যে গিয়ে নানা উৎসেচকের মাধ্যমে ভেঙে শরীরে শোষিত হয় এবং অপাচ্য অংশ মল হয়ে বেরিয়ে যায়। এই প্রক্রিয়াটিকে হজম বলা হয়। প্রক্রিয়াটি ঠিকমতো না হলে সমস্যা হয়। অতিরিক্ত মশলাদার খাবার খেলে উৎসেচকগুলির কাজ করতে দেরি হয় বা ঠিকমতো কাজ করতে পারে না।

প্রশ্ন: অনেকের মধ্যে একটা প্রবণতা দেখা যায়, অতিরিক্ত মশলাদার খাওয়াদাওয়ার পরে বিভিন্ন ধরনের ওষুধ খাওয়ার। এতে কতটা উপকার হয়?

উত্তর: এ ধরনের ওষুধে হজমের ক্ষেত্রে কোনও উপকার হয় না। শরীর থেকে নিঃসৃত উৎসেচকের মাধ্যমেই ধীরে ধীরে খাবার হজম হয়। এই সব ওষুধে পেট ভার হওয়াকে কমিয়ে শরীরের অস্বস্তি কিছুটা কমায় মাত্র। মূল প্রক্রিয়ায় কোনও লাভ হয় না। এ ছাড়া পিপিআই জাতীয় এক ধরনের ওষুধ বাজারে পাওয়া যায়, এগুলি যাঁদের অ্যাসিডিটির প্রবণতা থাকে, তাঁদের ক্ষেত্রে কাজ করে। তবে হজমের ক্ষেত্রে অ্যাসিডেরও একটা ভূমিকা আছে। সেটা যদি ওষুধ খেয়ে কমিয়ে দেওয়া হয়, তা হলে, ভাল না হয়ে খারাপও হতে পারে।

প্রশ্ন: শুধু কি খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তনের জন্যই পেটের সমস্যা হয়?

উত্তর: না। শরীরের অভ্যন্তরীণ কারণেও পেটের সমস্যা হয়। এই ধরনের সমস্যা সাধারণত দীর্ঘস্থায়ী হয়। যেমন, গলব্লাডার, অ্যাসিডিটি, পাকস্থলীর প্রদাহ বা বাইল-ডাক্ট থেকে সমস্যা সারা বছরই থাকে।

প্রশ্ন: অ্যাসিডিটি বা অম্বল কী?

উত্তর: পেটের রোগের মধ্যে অন্যতম রোগ হল অ্যাসিডিটি বা অম্বলের রোগ। এ ক্ষেত্রে স্বাভাবিক অবস্থায়ই শরীরের মধ্যে বেশি পরিমাণে অ্যাসিড নিঃসৃত হয়। অ্যাসিড বেশি তৈরি হলে যেমন সমস্যা হয়, তেমনি অ্যাসিড কম তৈরি হলেও সমস্যা হয়।

এ ছাড়া, শরীরের পরিপাকতন্ত্রের মধ্যে অনেক ব্যাকটেরিয়া থাকে। তাদের মধ্যে কিছু উপকারি ব্যাকটেরিয়া এবং কিছু অপকারি ব্যাকটেরিয়া। পরিপাকতন্ত্রের নির্দিষ্ট জায়গায় এই সব ব্যাকটেরিয়া থাকে। ব্যাকটেরিয়ার জায়গা পরিবর্তন হয়ে গেলে তাকে ডিসবায়োসিস বলে। এ থেকেও পেটের সমস্যা তৈরি হয়।

প্রশ্ন: পেট জ্বালা করা বা পেট গরম হওয়া নিয়ে কী বলবেন?

উত্তর: এটা সাধারণত হয়ে থাকে পেটের মধ্যে সংক্রমণ হলে।

প্রশ্ন: পেট খারাপের সঙ্গে অন্য কোনও রোগের সম্পর্ক আছে কি?

উত্তর: অবশ্যই আছে। যেমন, জন্ডিস, টাইফয়েডে, গ্যাস্ট্রো-এন্ট্রাইটিসের মতো মারাত্মক রোগও হতে পারে। খাবার বা জলের মাধ্যমে শরীরে এই সব রোগের জীবাণু ঢুকলে পেট খারাপ হয়। ঠিক সময়ে এর চিকিৎসা শুরু না হলে সমস্যা জটিল হতে পারে।

প্রশ্ন: শীতকালে অনেকের মধ্যে অ্যালকোহল পানের প্রবণতা বাড়ে। এতে কি পেটের সমস্যা হয়?

উত্তর: অল্পসল্প অ্যালকোহল পান করলে পেটের সমস্যা হয় না। তবে অতিরিক্ত পান করলে অবশ্যই সমস্যা হতে পারে। পেটের সমস্যা না হলেও অ্যালকোহলের ফলে অনেক ধরনের রোগ হতে পারে। তাই অ্যালকোহল এড়িয়ে চলাই ভাল।

প্রশ্ন: গ্যাসের সমস্যা নিয়ে কী বলবেন?

উত্তর: গ্যাসের কোনও বৈজ্ঞানিক বিবরণ নেই চিকিৎসাশাস্ত্রে। এক এক জনের ক্ষেত্রে এক একটা কারণে গ্যাস হয়। এ ক্ষেত্রে লক্ষণ দেখে চিকিৎসা করা হয়। কেউ যদি বলেন গ্যাস হলে দেহে বা মাথায় ব্যথা হয়, বা গ্যাস হলে ঘুম হয় না, তবে তা গ্যাসের জন্য নয়। তার অন্য কারণ থাকে। পেটে যখন সংক্রমণ হয়, তখন পেটের মধ্যে গ্যাসের সমস্যা হয়। শুধু বাংলায়ই নয়, গোটা বিশ্বে পেটের রোগের ক্ষেত্রে গ্যাস একটি বড় সমস্যা। গ্যাস হয় না, এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া কঠিন। একে ইরিটেবল বায়লস সিন্ড্রোম বা আইবিএস বলে।

প্রশ্ন: কী কারণে এ ধরনের সমস্যা হয়?

উত্তর: দুশ্চিন্তা, টেনশন থেকে পেটের আইবিএস সংক্রান্ত সমস্যা হয়। যত রোগী পেটের সমস্যা নিয়ে আসেন তার অর্ধেকে এ ধরনের সমস্যা নিয়ে আসেন। এ ধরনের সমস্যা খুব সহজে সারে না। দীর্ঘদিন ধরে ওষুধ খেতে হয়। দুশ্চিন্তা হলে পরিপাকতন্ত্রের ডিসবায়োসিসের ঘটনা ঘটে। তখন শরীরের উপকারী ব্যাকটেরিয়াও অপকার করে। তাই দুশ্চিন্তা, চাপমুক্ত জীবনযাপন করার কথা বলা হয়।

প্রশ্ন: ওষুধ না খেয়ে সুস্থ থাকার উপায় কী?

উত্তর: খাওয়ার পরে সঙ্গে সঙ্গে শুয়ে পড়া ঠিক নয়। কিছুক্ষণ বইপড়া বা টিভি দেখার পরে শুতে যাওয়া উচিত। এ ছাড়া রেস্তরাঁয় খাওয়া বা কোনও অনুষ্ঠানবাড়িতে খাওয়া পারতপক্ষে এড়িয়ে চলতে হবে। যাঁদের ডিসপেপসিয়া বা ফাংশনাল বাইল ডিজিজ রয়েছে, তাঁদের দুধ বা তেলেভাজার মতো খাবার খাওয়া চলবে না। দুধ, দুধজাত সামগ্রী, দুধ দেওয়া চা একদম বন্ধ করে দিতে হবে। তেলেভাজার দোকানে একই তেলে বার বার ব্যবহার করা হয়। এতে ক্ষতির আশঙ্কা বেশি হয়। তাই দোকানের তেলেভাজা খাওয়া বন্ধ করতে হবে। বাড়িতে তেলেভাজা তৈরি করে খেলে এই সমস্যা হয় না। তবে তেলেভাজা খাওয়ার পরে জল, মাংসের পরে দুধ বা ভাতের পরেই ফল খাওয়া ঠিক নয়। এ সব খাওয়ার মাঝে কিছুক্ষণ ফারাক রাখা বাঞ্ছনীয়। এ ছাড়া খাবারে আনাজ বা সহজপাচ্য জিনিসের পরিমাণ বেশি করে রাখা উচিত। পচা, বাসি খাবার খাওয়া চলবে না। রান্না করার আগে ভাল করে আনাজ ধুয়ে নিতে হবে। এ সব মেনে চললে সমস্যা অনেকখানি কমে যাবে। প্রক্রিয়াজাত খাবার যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলা উচিত। এ সব খাবার যখন প্যাকেটে ভার হয়, তখন এমন কিছু রাসায়নিক ব্যবহার করা হয়, যাতে হজমের সমস্যা হয়। এগুলি দীর্ঘদিন ধরে খেলে পরিপাকতন্ত্রের কর্মক্ষমতা কমে যেতে পারে।

প্রশ্ন: সমস্যা তৈরি হলে কী করা উচিত?

উত্তর: নিজে নিজে চিকিৎসা করা উচিত নয়। চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে ওষুধ খাওয়া উচিত। নিজে নিজে ওষুধ খাওয়ার বদ অভ্যাস ত্যাগ করতে হবে। এ ব্যাপারে অনেকের মধ্যেই সচেতনতার অভাব রয়েছে। দেরি করে চিকিৎসকের কাছে গেলে সমস্যা জটিল হতে পারে।

প্রশ্ন: দুই বর্ধমানে আপনার কাছে এ ধরনের রোগী কেমন আসেন?

উত্তর: শীতে সাধারণত পেটের সমস্যা নিয়ে রোগীর সংখ্যা কম থাকে। তবে বর্ষবরণ বা বড়দিনের মতো উৎসবের পরে বা কোনও অনুষ্ঠানের পরে এ ধরনের রোগীর সংখ্যা বাড়ে। এ ছাড়া আইবিএস-এর রোগীদের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। বিশেষ করে মহিলাদের ক্ষেত্রে এই রোগ বেশি দেখা যায়। খোঁজ নিলে দেখা যাবে, এদের অধিকাংশের ভাল ঘুম হয় না, বা বিভিন্ন কারণে চাপের মধ্যে থাকেন।

সাক্ষাৎকার: প্রদীপ মুখোপাধ্যায়

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Food disease Health
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE