Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪

‘ছুঁয়ে দেখলি না তো?’

‘কেন, কত সময় নষ্ট করছে এখানে ওখানে আড্ডা দিয়ে, ফোনে কথা বলে, আমি বুঝি জানি না!’

প্রতীকী ছবি।

প্রতীকী ছবি।

অনিতা অগ্নিহোত্রী (লেখক)
শেষ আপডেট: ০৫ অগস্ট ২০১৮ ০১:০৭
Share: Save:

‘আমার কাছে কেউ আসে না কেন বল তো?’

—কে আসবে, আমরা ছাড়া?

‘কেন, পাড়া-প্রতিবেশী? আত্মীয়স্বজন?’

—সময় কোথায় তাঁদের, যে আসবেন?

‘কেন, কত সময় নষ্ট করছে এখানে ওখানে আড্ডা দিয়ে, ফোনে কথা বলে, আমি বুঝি জানি না!’

মায়ের মুখে এই ব্যাকুল প্রশ্ন আর হতাশার দৃষ্টি শুনে-দেখে অভ্যেস হয়ে গিয়েছিল আমাদের।

সান্ত্বনা দিয়ে বুঝিয়ে বলি, সকলেই তো বড্ড ব্যস্ত আজকাল।

আসলে শহরটা, সময়টা এই রকমই। আমরাও তারই মধ্যে। অফিস থেকে ফেরার পথে সপ্তাহে দু’দিন ছুটে ছুটে আসি। মায়ের সংসারের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নামিয়ে দিয়ে ফিরে যাব। মাছ, আনাজ, চাল, সাবান, চা পাতা— জিনিসগুলোর দিকে ভাল করে তাকান না মা, এক পাশে সরিয়ে রাখেন। জিনিস চাওয়া তো ছুতো। মা চান আমাদের সময়। জমিয়ে গুছিয়ে গল্প করার মতো অনেকটা সময়। নিজের একলার সংসারের নানা খুঁটিনাটি আমাদের শোনাবেন, তার জন্য সময় চাই।

আমরা তো সফল সন্তান মায়ের। তাই ব্যস্ত। সারা দিন দৌড়চ্ছি। সেটা মা বোঝেন। কিন্তু চারপাশের একশোটা ফ্ল্যাটের পাঁচশো মানুষের কেন সময় নেই একটি বার এসে খবর নেওয়ার, মা বুঝতে পারেন না। সমবয়সি আত্মীয়েরা সন্তানদের উপরে নির্ভরশীল। সন্তানেরা ততোধিক ব্যস্ত।

আমি বা দাদারা দেখা করে ফিরে গেলে মা আবার ঝুলবারান্দার চেয়ারটিতে গিয়ে বসবেন। আরম্ভ হয়ে যাবে তাঁর পথ চাওয়া। আগামী সপ্তাহের আগে আমরা কেউ আসছি না জেনেও।

কত কিছু আছে ধারে কাছে। ব্যস্ত গড়িয়াহাট মোড়। বাজার দোকান। হেঁটে আসার মতো পথ আছে আবাসনের মধ্যেই। ইচ্ছে করে না কোথাও যেতে। অটো গুন্ডামি করে। বাসের পাদানি উঁচু। উঠতে নামতে ভয়। প্রতিবেশীর কৌতূহল— ‘দিদিমা বুঝি একার জন্য বাজার করলেন? ভাল লাগে, একা একা?’

মানুষ গ্রাম থেকে শহরে আসে, তা কেবল রোজগারের জন্য নয়। শিক্ষা আর বিনোদনের সুবিধে, এই দুটো বড় কারণ— বলেছিলেন এক নগর বিশেষজ্ঞ। বড় শহরের আলো ঝলমলে পথ, মাল্টিপ্লেক্স, বড় প্রতিষ্ঠানের হর্ম্যরাজি চোখ ধাঁধায়। স্বপ্নপূরণ হয় অনেকের, কারও কারও হয় না। প্রতিযোগিতা একা করে দেয় নাগরিককে, এগিয়ে গেলেও একা। পিছিয়ে পড়লেও একা। মফস্সলের একটা সামূহিক জীবন থাকে। ছোট শহর, ছোট পাড়া। প্রতিবেশী। পালা-পার্বণ। টেলিভিশন-মোবাইল-মাল্টিপ্লেক্সের আগে শহরের জীবনেও কিছু উত্তাপ ছিল, চেনা মানুষের সান্নিধ্যও ছিল। আমাদের শৈশবে, মা-মাসিদের যৌবনকালে গানের আসর বসত সন্ধেবেলা, পাড়ার নাটকে ডাক পড়ত, সিগারেটের প্যাকেটের কুকুরছানার মুখ নিখুঁত করতে গিয়ে বিকেল গড়িয়ে যেত, পাশের বাড়ির মণিদা হারমোনিয়াম চেয়ে নিতে এলে না বলা যেত না, অথচ ওই যন্ত্র ঘরে না ফেরা পর্যন্ত রাতে ঘুম নেই। উনিশশো সত্তরের দশকে টেকনোলজি অনুপ্রবেশ করল, ধীরে ধীরে আমাদের দুপুর-সন্ধে আর পারস্পরিকতার জীবনকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়ে গেল। শৈশবের এক রকম একাকিত্ব, যৌবনের এক রকম গতির আয়াসবিহীন, বার্ধক্যের আর এক রকম। জনসমুদ্রের শহর, অথচ মানুষের অতল নির্জনতা।

একই দিনে, অনাহারে, অপুষ্টিতে মারা গেল দিল্লির তিনটি ছোট মেয়ে। সবই ছিল তাদের। পাসবইয়ে টাকা, মিড-ডে মিলে বড় মেয়েটির নাম। দিল্লিতে মহল্লা ক্লিনিক, গরিবের জন্য স্কুল ভালই কাজ করে। তা হলে? বাবা খুইয়েছিল রোজগারের একমাত্র উপায় রিকশাটি, বাড়িওয়ালার তাড়া খেয়ে তিন দিন আগে মাত্র নতুন পাড়ায় এসেছিল। দরজা বন্ধ থাকত বলে পড়শিরা ডাকেনি। মায়ের মানসিক ভারসাম্য ছিল না, বাবা নিখোঁজ কাজের সন্ধানে। নতুন শিশুর সার্ভে হয় ছ’মাস পরে পরে, তাই নতুন স্কুল, অঙ্গনওয়াড়ি কেউই তাদের খাতায় নেয়নি। পরিবার যদি দায়িত্ব পালনে অক্ষম হয়, তবে অন্য পরিবারেও শিশু পালনের ব্যবস্থা আছে শহরের স্কিমে। কিন্তু সাহায্য চেয়ে ইমার্জেন্সি বোতামটি কেউ টিপে উঠতে পারেননি। চারপাশে সকলেই এক রকম হতদরিদ্র, জীবিকার সন্ধানে অন্ধ। দু’বার ময়না-তদন্তে উঠে আসে একই ছবি। পেটে খাবার ছিল না ওই শিশুদের। এও সেই জনবহুলতার মাঝে বিচ্ছিন্নতার ব্যাধি, যা শহরের নিজস্ব।

শেষের আগের ক’দিন ভাল করে খাওয়া হত না মায়েরও। থরে থরে সব সাজানো, তবুও। কাজের লোকটি না এলে দরজা খোলার জন্য ওঠার দরকার হত না। ফলে খাওয়াও হত না। বারান্দায় দাঁড়িয়ে অচেনা মানুষকে ডাকতেন মা। কেব্‌ল অপারেটর, খবর কাগজের ভেন্ডর, ইলেকট্রিশিয়ান। ‘উপরে আসবে? মিষ্টি খাওয়াব!’

শহর আমাদের দিল বেছে নেওয়ার অবাধ স্বাধীনতা, গতি, বিনোদন, বৈদ্যুতিন সংযোগ। আমরা হারালাম সংসর্গের উত্তাপ, মানবস্পর্শ, অকারণ আসা-যাওয়ার বাহুল্য।

বড়দা খসখস করে ওষুধ লিখেছে, মা বলেছে, ‘এ কেমন ডাক্তারি, ছুঁয়ে দেখলি না তো?’

‘ছোঁয়ার দরকার হয় না।’ দাদা গম্ভীর হয়েছে।

আমি তো ডাক্তার নই। কাজেই মাকে ছোঁয়ার দরকার হয় না আমারও।

চুলে জট পাকাচ্ছে, এনে দিয়েছি ভাল চিরুনি। গায়ে ময়লা জমছে। ইম্পোর্টেড সাবান তেমনই পড়ে আছে। চুলটা আমি আঁচড়ে দিই, সাবানটা ঘষে দিই পিঠে, মা চাইত। পণ্য কিনে আনা সহজ। সময় দেওয়ার চেয়ে।

আগুনের ভিতরে মাকে তুলে দেওয়ার আগে চোখ পড়ে যায় এলিয়ে থাকা ডান হাতখানার দিকে। শুভ্র হাত। আজন্ম চেনা। নীল, দীর্ঘ শিরা জেগে আছে, যেন এখনও ভিতরে জীবন স্পন্দমান।

মনে পড়ে যায়, কত কত দিন ওই হাত আমি হাতে তুলে নিইনি। তুলে নিয়ে গালে ছোঁয়াই। ভিতর থেকে শৈত্য ছুটে এসে ধাক্কা দেয় ভলকে ভলকে। বুঝতে পারি, শ্মশানে বসে আছি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Anita Agnihotri Loneliness
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE