Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
বাঙুর হাসপাতাল

অস্পৃশ্য যুবকের সেবায় সহমর্মী রোগী

একটি মহত্বের গল্প অথবা সমব্যথার। যার উপরে নির্ভর করে নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে পা বাড়ানো এক অসুস্থ মানুষ কিছুটা হলেও ফিরতে পেরেছেন বাঁচার লড়াইয়ে। অপ্রত্যাশিত ভাবে পাওয়া সহমর্মিতার জোরে সুদেব স্বর্ণকারের এই লড়াইয়ে ফেরার সাক্ষী টালিগঞ্জের এম আর বাঙুর হাসপাতাল। গুরুতর অসুস্থ সুদেবের দায়িত্ব নিতে চাননি তাঁর বাবা-মা। সারা গায়ে পচন ধরে পোকা বেরোতে থাকায় তাঁকে ওয়ার্ডে রাখতে বাধা দিয়েছিলেন অন্য রোগীরা। যে চিকিৎসক ও নার্স সুদেবকে পরিষেবা দেবেন, তাঁদের চিকিৎসা নিতে অস্বীকার করেন অধিকাংশ রোগী।

সুদেবের পরিচর্যায় গৌতম। —নিজস্ব চিত্র

সুদেবের পরিচর্যায় গৌতম। —নিজস্ব চিত্র

পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৬ নভেম্বর ২০১৪ ০৩:২১
Share: Save:

একটি মহত্বের গল্প অথবা সমব্যথার। যার উপরে নির্ভর করে নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে পা বাড়ানো এক অসুস্থ মানুষ কিছুটা হলেও ফিরতে পেরেছেন বাঁচার লড়াইয়ে। অপ্রত্যাশিত ভাবে পাওয়া সহমর্মিতার জোরে সুদেব স্বর্ণকারের এই লড়াইয়ে ফেরার সাক্ষী টালিগঞ্জের এম আর বাঙুর হাসপাতাল।

গুরুতর অসুস্থ সুদেবের দায়িত্ব নিতে চাননি তাঁর বাবা-মা। সারা গায়ে পচন ধরে পোকা বেরোতে থাকায় তাঁকে ওয়ার্ডে রাখতে বাধা দিয়েছিলেন অন্য রোগীরা। যে চিকিৎসক ও নার্স সুদেবকে পরিষেবা দেবেন, তাঁদের চিকিৎসা নিতে অস্বীকার করেন অধিকাংশ রোগী। সুদেবের থেকে তাঁদের দেহে সংক্রমণ হওয়ার আশঙ্কা করছিলেন তাঁরা।

এমন অবস্থায় সুদেবের চিকিৎসা কী ভাবে সম্ভব, ভেবে পাচ্ছিলেন না কর্তৃপক্ষ। তখনই গৌতম মজুমদারের আবির্ভাব। বছর চল্লিশের এই যুবকও আত্মীয়দের কাছে ব্রাত্য। অসুস্থ অবস্থায় রাস্তায় পড়ে থেকে মাথার ক্ষতস্থানে পোকা হয়ে গিয়েছিল তাঁরও। বাঙুরেই চিকিৎসার পরে অনেকটা সুস্থ। সুদেবের মতো তিনিও আছেন মেল ফ্রি সার্জিক্যাল ওয়ার্ডে। সুদেবকে পরিষেবা দিতে স্বেচ্ছায় এগিয়ে এসেছেন গৌতম।

চিকিৎসকদের কাছ থেকে প্রশিক্ষণ নিয়েই গত এক মাস নিয়মিত তিন বেলা গৌতম কঙ্কালসার সুদেবের সারা শরীরে ড্রেসিং করছেন। নার্সদের থেকে বুঝে নিয়ে চার্ট ধরে ওষুধ খাওয়ান। আপনজনের অবহেলার পরেও অনাত্মীয় এক মানুষের পরিচর্যায় জীবন ফিরে পাচ্ছেন সুদেব।

হাসপাতালের সার্জারি বিভাগের চিকিৎসক জয়দীপ রায়ের কথায়, “অদ্ভুত পরিস্থিতিতে পড়েছিলাম। ওয়ার্ডের অন্য রোগী ও তাঁদের আত্মীয়রা বিদ্রোহ করলেন। সুদেবের গা থেকে অসংখ্য ‘ম্যাগট’ (পোকা) বেরিয়েছে, দুর্গন্ধ বেরোচ্ছে। প্রথমে ওঁরা কিছুতেই তাঁকে ওয়ার্ডে থাকতে দেবেন না। তার পরে সকলেই জানালেন, সুদেবকে ছুঁলে আমাদের চিকিৎসাও নেবেন না। এই নিয়ে যখন বাগবিতণ্ডা চলছে, তখন গৌতমই সমস্যার সমাধান করলেন।”

সকলে যখন সুদেবকে দেখে নাকে-মুখে কাপড় চাপা দিচ্ছেন, তখন তিনি কেন যেচে নিলেন তাঁর পরিচর্যার দায়িত্ব? সুদেবের মাথায় যত্ন করে হাত বুলিয়ে গৌতম বলেন, “আমাকেও বাড়ির লোক দেখে না, আমারও শরীরে পোকা হয়ে গিয়েছিল। লোকে আমাকে দেখেও ঘেন্নায় সরে যেত। সুদেবের মধ্যে নিজেকে দেখতে পাই। ওর কী কষ্ট হচ্ছে, তা আমার থেকে বেশি কেউ বুঝবে না। আমি ওকে এই ভাবে পড়ে থেকে মরতে দেখতে পারব না।” আরও বলেন, “জীবনে কিচ্ছু ভাল কাজ করতে পারিনি। আমি একটা বেকার, ফালতু মানুষ। এখন ভগবান একটা অসহায়-অসুস্থ মানুষকে যত্নের সুযোগ দিয়েছেন। এ টুকুও না পারলে আমি নরকের কীট।”

হাসপাতালের সুপার সোমনাথ মুখোপাধ্যায় জানান, চিকিৎসক-নার্সদের বদলে গৌতম অসুস্থ সুদেবের দায়িত্ব নেওয়ায় অন্য রোগীরাও আর প্রতিবাদ জিইয়ে রাখতে পারেননি। তাঁর কথায়, “সুদেবদের পরিবার যখন এঁদের ত্যাগ করে তখন মনে হয় দুনিয়াটা স্বার্থপরে ভরে গিয়েছে। কোনও সম্পর্ক অবশিষ্ট নেই। আবার গৌতমদের দেখে মনে হয়, এই সহানুভূতিটুকু আছে বলেই হয়তো পৃথিবী এখনও টিকে আছে।”

গত ২৪ সেপ্টেম্বর সন্তোষপুরের ফুটপাথ থেকে গৌতমকে তুলে হাসপাতালে আনে পুলিশ। আর সেই পুলিশই হরিদেবপুরের রাস্তা থেকে সুদেবকে তুলে আনে ১৩ অক্টোবর। গৌতমের বাবা-মা নেই। দিদি-জামাইবাবু জানান, নেশাগ্রস্ত, অসুস্থ, বেকার ভাইকে তাঁরা বাড়িতে নেবেন না। অন্য দিকে, ছেলেকে হাসপাতালে এসে কয়েক বার দেখে গেলেও সুদেবের বাবা-মা গোপালচন্দ্র স্বর্ণকার ও পুতুল স্বর্ণকার স্পষ্ট বলে দেন, “ওর মাথায় গোলমাল, তার উপরে নেশা করে। যখন-তখন বাড়ি থেকে উধাও হয়ে যায়। ওর জন্য অনেক হেনস্তা হয়েছি। আর ওর দায়িত্ব নেব না আমরা।” এর পরে হয়তো চিরকালের মতো হারিয়ে যেতেন সুদেব। কিন্তু গৌতমের মতো বন্ধুর হাত খাদের কিনারা থেকে ফিরিয়ে আনছে তাঁকে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE