গোটা দেশের কাছে দৃষ্টান্ত হয়ে উঠতে গিয়েও হতে পারল না পশ্চিমবঙ্গ। ক্যানসার চিকিত্সায় উদ্যোগী হওয়ার ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা নিলেও শেষমেশ হাতেকলমে তা করে দেখানোর ক্ষেত্রে পিছিয়েই রইল এই রাজ্য।
সম্প্রতি কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী হর্ষ বর্ধন দিল্লিতে এক বৈঠকে ক্যানসারকে ‘নোটিফায়েবল ডিজিজ’ (যে রোগে আক্রান্তের হদিস পেলে ও চিকিত্সা শুরু হলে তা সরকারকে জানানো বাধ্যতামূলক) হিসেবে ঘোষণার ব্যাপারে দেশের সমস্ত রাজ্যকে উদ্যোগী হওয়ার আহ্বান জানান। তখনই জানা যায়, ইতিমধ্যেই কেরল, পঞ্জাব ও পশ্চিমবঙ্গে তা ঘোষণা হয়ে গিয়েছে। এবং পশ্চিমবঙ্গে হয়েছে চার বছর আগে! কেন্দ্রের স্বাস্থ্যকর্তারা পশ্চিমবঙ্গের প্রশংসাও করেন। কিন্তু সত্যিই কি প্রশংসা প্রাপ্য এ রাজ্যের?
রাজ্যের চিকিত্সক মহলের মতে, ক্যানসারের মতো মারণ রোগ প্রতিরোধে রাজ্যের অগ্রণী ভূমিকা স্রেফ কাগজে-কলমে। আদতে হয়েছে নেহাতই কলকাতা-কেন্দ্রিক কিছু ব্যবস্থা। স্বাস্থ্যকর্তারাও মানছেন, ক্যানসারের তথ্য সংগ্রহে এখনও উদ্যোগী হওয়া যায়নি। আজ, শুক্রবার, ৭ নভেম্বর বিশ্ব ক্যানসার দিবসে রাজ্যের ব্যর্থতার ছবিটাই ফের প্রকট।
স্বাস্থ্য দফতর সূত্রে খবর, ক্যানসারকে নোটিফায়েবল ডিজিজ ঘোষণার পরে গত চার বছরে স্বাস্থ্য ভবনে এ নিয়ে একটি মাত্র বৈঠক হয়েছে। তাতে হাসপাতালগুলিকে চিত্তরঞ্জন ন্যাশনাল ক্যানসার ইনস্টিটিউট (সিএনসিআই)-এর কাছে তথ্য জমা দিতে বলা হয়েছিল। কিন্তু নির্দেশ কী ভাবে মানা হবে, না মানলে কী হবে, তথ্য পেলে কী ভাবে রিপোর্ট তৈরি হবে কিছুই ঠিক হয়নি।
সিএনসিআই-এর অধিকর্তা জয়দীপ বিশ্বাস বলেন, “কলকাতার সরকারি হাসপাতালগুলি থেকে কিছু তথ্য আসছে। কিন্তু জেলা থেকে প্রায় কিছুই পাই না। বেসরকারি হাসপাতালগুলির ক্ষেত্রেও তাই। সমস্যার গভীরতাটা হয়তো অনেক স্তরেই ঠিক ভাবে বোঝা হচ্ছে না। সব মহলেই এই বিষয়ে আরও সক্রিয়তা দরকার।” তাঁর মতে, গোটা রাজ্যকে কয়েকটি সেক্টরে ভাগ করে তথ্য সংগ্রহ শুরু হওয়া উচিত।
কলকাতার মেডিক্যাল কলেজগুলি থেকে অবশ্য জানা গিয়েছে, তাদের কোনও তথ্যই নিয়মিত সিএনসিআই-তে পাঠানো হয় না। সিএনসিআই-এর ক্যানসার রেজিস্ট্রি প্রকল্পের জন্য মাঝেমধ্যে কর্মীরা হাসপাতাল থেকে তথ্য সংগ্রহ করেন। কোনও হাসপাতালই কখনও স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে কিছু জানায় না।
প্লেগ, এইচ৫এন১ (বার্ড ফ্লু), এইচ১এন১ (সোয়াইন ফ্লু)-এর মতো ছোঁয়াচে রোগের বাইরে ক্যানসারই প্রথম অসুখ যা ছোঁয়াচে না হওয়া সত্ত্বেও ঠাঁই পেতে চলেছে নোটিফায়েবল ডিজিজের তালিকায়। বেঙ্গালুরুর ‘ন্যাশনাল সেন্টার ফর ডিজিজ ইনফরমেটিক্স অ্যান্ড রিসার্চ’-এর বিজ্ঞানীরাও এর পক্ষে সওয়াল করেছেন। ক্যানসার চিকিত্সক সুবীর গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, “এতে বোঝা যাবে নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর মধ্যে বিশেষ কোনও ক্যানসার বেশি হচ্ছে কি না। সামগ্রিক ক্যানসার আক্রান্তের খতিয়ান পেতে বা রোগ প্রতিরোধেও ওই পরিসংখ্যান খুব জরুরি।” ক্যানসার শল্যচিকিত্সক গৌতম মুখোপাধ্যায়ের কথায়, “১০ বছর আগেও রাজ্যে ক্যানসার আক্রান্তের সংখ্যা বলা হত, বছরে ৭০ হাজার। এখনও তা-ই বলা হয়। কেউ জানেনই না সংখ্যাটা আসলে ঠিক কত।”
আর এক চিকিত্সক আশিস মুখোপাধ্যায়ের আক্ষেপ, “এ রাজ্যে জেলা স্তরে চিকিত্সকদের সচেতন করতে বিশেষ প্রশিক্ষণ দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। তার পরে কাজ একেবারেই এগোয়নি। এ নিয়ে তথ্য সংগ্রহ কতটা জরুরি, সে সম্পর্কে ন্যূনতম সচেতনতাই গড়ে ওঠেনি।”
কেন্দ্রের পরিসংখ্যানে গত বছর দেশে প্রায় ১২ লক্ষ ক্যানসার রোগীর হদিস মিলেছিল। যা আগের বছরের তুলনায় ৯০ হাজার বেশি। স্বাস্থ্যকর্তারা মানছেন, ছোঁয়াচে না হলেও এ রোগ যে হারে বাড়ছে, তাতে নোটিফিকেশন খুবই জরুরি। স্বাস্থ্য দফতরের এক কর্তা বলেন, ‘ডেমোগ্রাফিক টিউমার রেজিস্ট্রি’ তৈরি করা দরকার। জেলা স্তরে কর্মীদের প্রশিক্ষণও জরুরি। কিন্তু এখনও সবটাই পরিকল্পনার স্তরে।”
কবে তা বাস্তবের মুখ দেখবে? জবাব আপাতত তাঁদের কাছে নেই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy