Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
বরাহনগর পুরসভা

ডেঙ্গিতে মৃত্যু? ডাক্তারেরা বললেও মানে না প্রশাসন

চিকিৎসাশাস্ত্র যা-ই বলুক, প্রশাসনের বুলি বাঁধা একই গতে। বিশেষত বিষয়টির সঙ্গে যদি ডেঙ্গির নাম জড়িয়ে থাকে! সাম্প্রতিকতম উদাহরণ বরাহনগরের দুই মৃত্যু। এক জনের ডেথ সার্টিফিকেট অনুযায়ী, মৃত্যুর কারণ ডেঙ্গি সংক্রমণ।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ২৮ অক্টোবর ২০১৫ ০৩:৩৭
Share: Save:

চিকিৎসাশাস্ত্র যা-ই বলুক, প্রশাসনের বুলি বাঁধা একই গতে। বিশেষত বিষয়টির সঙ্গে যদি ডেঙ্গির নাম জড়িয়ে থাকে!

সাম্প্রতিকতম উদাহরণ বরাহনগরের দুই মৃত্যু। এক জনের ডেথ সার্টিফিকেট অনুযায়ী, মৃত্যুর কারণ ডেঙ্গি সংক্রমণ। অন্য জনের জনের ডেথ সার্টিফিকেটে লেখা, ‘এনএস-ওয়ান পজিটিভ রোগীটি মারা গিয়েছেন শক ও এক সঙ্গে বিভিন্ন অঙ্গ বিকল হওয়ায়।’

অথচ দু’জন যে অঞ্চলের বাসিন্দা, সেই বরাহনগর পুরসভার খাতায় ওঁদের মৃত্যুর কারণ হিসেবে ডেঙ্গি শব্দটির কোনও উল্লেখই নেই! খাতায়-কলমে তো বটেই, ঘটনায় ডেঙ্গি-সংশ্রবের সম্ভাবনা মুখেও উড়িয়ে দিচ্ছেন পুর-কর্তৃপক্ষ। তৃণমূলচালিত বরাহনগর পুরসভার চেয়ারপার্সন অপর্ণা মৌলিকের দাবি, ‘‘ডেঙ্গিতে কোনও মৃত্যু হয়নি। কারও ডেঙ্গি হয়ওনি।’’ অপর্ণাদেবীর যুক্তি, কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রকের নির্দেশমতো এনএস-১ পজিটিভ মানেই ডেঙ্গি নয়।

কিন্তু বিধানপল্লির বাসিন্দা আঠাশ বছরের অর্পিতা চক্রবর্তী ও শীতলামাতা লেনের সাঁইত্রিশ বছরের গৃহবধূ নমিতা সামন্তের মৃত্যুর কারণ হিসেবে চিকিৎসকেরা যেখানে ডেঙ্গির দিকে আঙুল তুলছেন, সেখানে পুরসভা এ ভাবে তা নস্যাৎ করায় বিতর্ক দানা বেঁধেছে। তথ্য গোপনের অভিযোগ তুলছে বিরোধীরা। বরাহনগরের প্রাক্তন সিপিএম কাউন্সিলর অশোক রায়ের কথায়, ‘‘যাঁদের এনএস-ওয়ান পজিটিভ, পরে তাঁদের আইজিজি এবং আইজেএম-ও পজিটিভ বেরোচ্ছে। তখন ডেঙ্গি ঘোষণা করা হচ্ছে। সবাই এটা জানে। শুধু পুরসভাই মানতে চাইছে না!’’

এমতাবস্থায় বাস্তবকে স্বীকার করে অবিলম্বে সচেতনতার প্রচারে জোর উচিত বলে অশোকবাবুরা মনে করছেন। সরকারের কী অবস্থান?

কর্তারা অবশ্য বিষয়টিকে যথেষ্ট লঘু করেই দেখছেন। রাজ্য স্বাস্থ্য দফতরের এক শীর্ষ কর্তা মঙ্গলবার বলেন, ‘‘এনএস-১ রিপোর্ট বহু সময়েই পরে ভুল প্রমাণিত হয়। তাই এর ভিত্তিতে ডেঙ্গি নির্ণয় অযৌক্তিক। তা ছাড়া ডেঙ্গির আলাদা চিকিৎসা নেই। তাই রোগ কখন ধরা পড়ল, তা জানা খুব জরুরি নয়।’’ ডেঙ্গির চিকিৎসায় সরকার অ্যান্টিবডি পরীক্ষার রিপোর্টকেই গুরুত্ব দিচ্ছে বলে জানিয়েছেন ওই কর্তা।

এবং সরকারের এ হেন মনোভাব দেখে বাসিন্দাদের বড় অংশের মনে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। ‘‘জ্বর ঘরে ঘরে ছড়াচ্ছে। হাসপাতালগুলোয় দিন-কে-দিন রোগী বাড়ছে, যাঁদের অধিকাংশের আবার এনএস-১ পজিটিভ। তা সত্ত্বেও পুরসভা কেন এমন গা এলিয়ে?’’— প্রশ্ন তুলছেন অনেকে। কারও কারও অভিযোগ, রোগ প্রতিরোধে ব্যর্থতা ঢাকার তাগিদেই সরকার রোগের অস্তিত্ব স্বীকার করছে না। জ্বরে আক্রান্ত এক কিশোরের বাবার পর্যবেক্ষণ, ‘‘কোথায় কোথায় ডেঙ্গি হচ্ছে জানা গেলে তো আগাম ব্যবস্থা নেওয়া যায়। পুরসভা উল্টে তথ্য চেপে রেখে পরিস্থিতি জটিল করে দিচ্ছে।’’

অভিযোগ শুনে পুর-কর্তৃপক্ষের অবশ্য বিশেষ হেলদোল নেই। চেয়ারপার্সনের পাল্টা অভিযোগ, কয়েকটি বেসরকারি হাসপাতাল ও চিকিৎসকদের একাংশ ডেঙ্গির নামে গুজব ছড়াচ্ছেন। ‘‘ডাক্তার কী ভাবে বলে দিলেন যে, অর্পিতা ডেঙ্গিতে মারা গিয়েছে? ব্যাপারটা স্বাস্থ্য দফতরকে জানিয়েছি। তারা তদন্ত করবে।’’— মন্তব্য অপর্ণাদেবীর। যদিও স্থানীয় চিকিৎসকদের অনেকে এবং একাধিক বেসরকারি হাসপাতালের কর্তৃপক্ষ তাঁর যুক্তি উড়িয়ে দিচ্ছেন। কী রকম?

বেলঘরিয়ার এক বেসরকারি হাসপাতালের সিইও চন্দ্রশেখর রায় বলেন, ‘‘অর্পিতার উপসর্গ দেখে ডাক্তারেরা মনে করেছেন, ডেঙ্গিতেই ওঁর মৃত্যু হয়েছে। অহেতুক ডেঙ্গির গুজব ছড়ানোর কোনও কারণ নেই।’’ বেলঘরিয়ার আর এক বেসরকারি হাসপাতালের জেনারেল ম্যানেজার পার্থপ্রতিম শেঠের বক্তব্য, ‘‘ডাক্তারেরা রোগীকে পরীক্ষা করে যা পাবেন, সেটাই তো বলবেন! এখানে গুজব ছড়ানোর প্রশ্ন ওঠে না। রক্ত পরীক্ষার উপরেও ডাক্তারদের হাত নেই।’’ এক চিকিৎসকের আক্ষেপ, ‘‘অ্যান্টিবডি টেস্টের রিপোর্ট আসতে বেশ ক‘দিন লাগে। তত দিনে প্লেটলেট কাউন্ট এক ধাক্কায় অনেকটা নেমে যেতে পারে। এনএস-১ পজিটিভ
হলে আগাম হুঁশিয়ার হওয়া যায়। আমরা সেটাই বলছি। সবাই বুঝছে, শুধু বরাহনগর পুরসভাই বুঝতে চাইছে না!’’

পাশাপাশি অভিযোগ, ডেঙ্গি চেনার ব্যাপারে পুর-প্রচারেরও বালাই নেই। সত্যিই কি তা-ই?

বরাহনগর পুরসভার চেয়ারম্যান পারিষদ (জঞ্জাল) দিলীপনারায়ণ বসু এটা মানেন না। তাঁর কথায়, ‘‘বিশ্বকর্মা পুজোর পরে পুরসভা সচেতনতা শিবিরের আয়োজন করেছিল। বাড়িতে জমা জল না-রাখার মতো বিভিন্ন সতর্কবার্তা দিয়ে আমরা ফের লিফলেট বিলি করব।’’ দুই বাসিন্দার মৃত্যুতে ডেঙ্গির ভূমিকা নস্যাৎ করলেও চেয়ারপার্সন কিন্তু কবুল করে নিচ্ছেন যে, বহু লোক জ্বরে আক্রান্ত। ‘‘মশা মারার তেল, ধোঁয়া ছড়ানো হচ্ছে।’’— দাবি করেছেন তিনি।

তবে মঙ্গলবার সকাল থেকে দীর্ঘক্ষণ বরাহনগর পুর-এলাকায় চক্কর মেরেও এমন কোনও দৃশ্য চোখে পড়েনি, যা পুর-প্রধানের দাবিকে সমর্থন করে!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE