শুধু চিকিৎসা নয়। নিছক ওষুধ নয়। রোগীর জন্য লাগে সেবা। ন্যূনতম স্বাচ্ছন্দ্য। কিন্তু খোদ ডাক্তারবাবুর দুয়ারেই যদি তা না-মেলে, কী হবে রোগীদের?
এর জবাব সরকার বাহাদুরের না-জানার কথা নয়। তবু ডাক্তারদের চেম্বারে সেই ন্যূনতম সুবিধা-স্বাচ্ছন্দ্যের ব্যবস্থা আবশ্যিক করার উদ্যোগ থেকে পিছিয়ে এল রাজ্য সরকার। চিকিৎসকদের চাপেই শেষ পর্যন্ত প্রাইভেট প্র্যাক্টিশনারদের উপর থেকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ অনেকটা তুলে নিল তারা। আর রোগী-স্বার্থ সুরক্ষার বিষয়টি রয়ে গেল তিমিরেই।
রোগীদের স্বার্থে প্রাইভেট প্র্যাক্টিশনারদের চেম্বারের আয়তন কী হবে, সেখানে কী কী সুবিধা না-থাকলেই নয়, ২০১২ সালের ক্লিনিক্যাল এস্টাব্লিশমেন্ট আইনের সংশোধনীর খসড়ায় তার উল্লেখ ছিল। বলা হয়েছিল, এক জন চিকিৎসক বসেন, এমন চেম্বারের আয়তন অন্তত ৩৭৫ বর্গফুট হতেই হবে। রাখতেই হবে রোগীদের বসার পর্যাপ্ত জায়গা। সেই সঙ্গে পানীয় জল, শৌচাগার, মহিলাদের শারীরিক পরীক্ষার আলাদা জায়গা, রোগিণীদের জন্য সহায়িকা, চিকিত্সা বর্জ্য সাফ করার ব্যবস্থা থাকা চাই। এই সব নিয়ম না-মানলে চেম্বার বন্ধ করে দেওয়ার আইনি সংস্থানও ছিল পুরনো খসড়া বিলে।
বিভিন্ন চিকিৎসক সংগঠনের আপত্তিতে এই সব ক’টি বিষয়ই ছেঁটে দিয়ে মঙ্গলবার ক্লিনিক্যাল এস্টাব্লিশমেন্ট আইনের সংশোধিত বিধি পাশ হয়ে গেল বিধানসভায়। বাদ পড়ে গেল চিকিৎসকদের প্রাইভেট চেম্বারে আসা রোগীদের সুবিধা-স্বাচ্ছন্দ্যের যাবতীয় বিষয়।
খসড়া বিধিতে আরও বলা হয়েছিল, ম্যালেরিয়া-ডেঙ্গির মতো সংক্রামক রোগ নিয়ে কত রোগী চেম্বারে আসছেন, নিয়মিত তার হিসেব পাঠাতে হবে স্বাস্থ্য দফতরে। চেম্বারে বাধ্যতামূলক ভাবে চেম্বারের লাইসেন্স, ডাক্তারের নাম, ফি এবং রেজিস্ট্রেশন নম্বর টাঙিয়ে রাখতে হবে। এ দিন পাশ হওয়া সংশোধনীতে বাদ গিয়েছে সেই অংশগুলিও। ২০১২ সালের সংশোধনী যাঁরা তৈরি করেছিলেন, তাঁদের মধ্যেই এক প্রাক্তন আমলার মন্তব্য, ম্যালেরিয়া-ডেঙ্গি নিরাময়ের জন্য নীতি তৈরি করতে গেলে কোন চিকিৎসক কত রোগী দেখছেন, কোন হাসপাতালে কত রোগীর চিকিৎসা হচ্ছে, তার সবিস্তার রিপোর্ট থাকা জরুরি। এর থেকে কোন এলাকায় বছরের কোন সময়ে কোন কোন জনগোষ্ঠীর মধ্যে এই সব রোগ বেশি হয়, তার খুঁটিনাটি হিসেব পাওয়া যায়। আর হাতের কাছে সেই হিসেব পেলে রোগ মোকাবিলায় সুবিধা হয়।
এ দিন পাশ হওয়া সংশোধনীতে তথ্য প্রকাশের বাধ্যবাধকতার প্রসঙ্গটিও পুরোপুরি বাদ চলে গিয়েছে বলে জানান ওই প্রাক্তন আমলা।
এক জন চিকিৎসক বসেন, এমন প্রায় সাড়ে ছ’হাজার চেম্বার রয়েছে রাজ্যে। ওই চেম্বারগুলি চালাতে গেলে পরিকাঠামোগত সুযোগ-সুবিধার প্রমাণ দিয়ে স্বাস্থ্য দফতরের লাইসেন্স নেওয়ার বিধান ছিল ২০১২ সালের খসড়া বিধিতে। পরিকাঠামো সংক্রান্ত নিয়ম তুলে নেওয়ায় এখন কোনও চিকিৎসক যদি কোথাও চেম্বার চালাতে চান, তাঁকে আর স্বাস্থ্য দফতর থেকে লাইসেন্স নিতে হবে না। চিকিৎসকেরা যে যেখানে খুশি যেমন-তেমন ভাবে চেম্বার খুলে বসে পড়তে পারবেন।
এখানেই শেষ নয়। সংশোধিত বিধি চালু হওয়ার পরে ওই সব চেম্বারে চিকিৎসায় গাফিলতির অভিযোগ উঠলে স্বাস্থ্য দফতর সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকের বিরুদ্ধে কোনও শাস্তিমূলক ব্যবস্থাই নিতে পারবে না বলে জানান অনেক স্বাস্থ্যকর্তা।
রোগীর স্বার্থ নিয়ে যে-সব সংস্থা ও সংগঠন কাজ করে, এই নতুন বিলে অশনি সঙ্কেত দেখছে তারা। এমনই একটি সংস্থার এক প্রতিনিধি বলেন, ‘‘চিকিৎসক সংগঠনগুলির চাপে রাজ্যের স্বাস্থ্য দফতর পুরোপুরি রোগীদের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিল। ডাক্তারদের চেম্বারে গেলে রোগীরা যে কোনও রকম পরিকাঠামোগত সুবিধা পাবেন না, তা স্পষ্ট হয়ে গেল।’’
ডাক্তারের কাছে গিয়ে রোগী এবং তাঁর সঙ্গীদের দীর্ঘ ক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়। সেই প্রতীক্ষা পর্বে তাঁরা যাতে একটু স্বাচ্ছন্দ্য পান, মানবিক কারণেই সেই ব্যবস্থা করা দরকার। প্রশ্ন
উঠছে, সেই সুযোগ-সুবিধার বন্দোবস্ত করতে উদ্যোগী হয়েও এ ভাবে পিছু হটার কারণ কী?
জবাব দূরের কথা, রোগীদের ন্যূনতম স্বাচ্ছন্দ্য দেওয়ার ব্যবস্থা রদের বিষয়টি পুরো এড়িয়ে গিয়েছেন রাজ্যের স্বাস্থ্য (শিক্ষা) অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি বলেন, ‘‘আমি এ ব্যাপারে কিছু জানি না। কোনও মন্তব্যও করব না।’’
তবে চিকিৎসকদের সংগঠন ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন বা আইএমএ-র পশ্চিমবঙ্গ শাখার সচিব শান্তনু সেন ওই বিল পাশের বিষয়টিকে নিজেদের জয় হিসেবেই দেখছেন। তাঁর যুক্তি, ‘‘এতে আসলে রোগীর স্বার্থই তো রক্ষা করা হল।’’
কী ভাবে?
শান্তনুবাবুর ব্যাখ্যা, ‘‘খসড়া বিধি মেনে পরিকাঠামো তৈরি করতে গেলে কোনও চিকিৎসকই কম ফি নিয়ে চেম্বারে রোগী দেখতে পারতেন না। আর ফি বাড়ালে বেশির ভাগ গরিব রোগীর পক্ষে ডাক্তার দেখানো সম্ভব হতো না। আমরা তো পলিক্লিনিক বা ছোটখাটো সার্জারি হয়, এমন চেম্বারগুলিকে ছাড় দিতে বলিনি। কিন্তু সিঙ্গল ডক্টর্স চেম্বারগুলিকে এই ছাড় দেওয়া জরুরি ছিল।’’
এ দিন বিধানসভায় ওই বিল পেশের সময় বামফ্রন্ট বা কংগ্রেসের কেউ ছিলেন না। তাঁরা আগেই সভাকক্ষ ত্যাগ করে চলে যান। বিরোধীদের মধ্যে তখন ছিলেন বিজেপি বিধায়ক শমীক ভট্টাচার্য এবং এসইউসিআই (সি) বিধায়ক তরুণ নস্কর। শমীকবাবু বলেন, ‘‘বিলের সমালোচনা করছি না। কিন্তু প্রত্যন্ত গ্রামের মানুষ যাতে স্বাস্থ্য পরিষেবা পান, সরকার তা নিশ্চিত করুক।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy