হাসপাতাল ফিরিয়ে দেয়। নার্সরা মুখ ঘুরিয়ে নেন। পাড়া-পড়শি একঘরে করে এইচআইভি আক্রান্তদের জন্য বেশির ভাগ সময়েই অপেক্ষা করে থাকে একের পর এক অমানবিক মুখ। কিন্তু ছবিটা যে চাইলেই অন্য রকম হতে পারে, অবলীলায় দেখিয়ে দিচ্ছে মঙ্গলকোটের বলরামপুর গ্রাম।
বছর তিনেক আগে গ্রামেরই এক মহিলা জানতে পারেন তিনি এইচ আই ভি আক্রান্ত। কী ভাবে সংসার চলবে, কী ভাবে চিকিৎসার খরচ জোটাবেন ভেবে মাথায় হাত পড়েছিল ওই সদ্যবিধবার। গ্রামের মানুষ বিষয়টিকে কী ভাবে দেখবেন, দুশ্চিন্তা ছিল তাই নিয়েও। কিন্তু আশঙ্কার যাবতীয় মেঘ সরিয়ে দিয়ে গ্রামবাসীরা শুধু ওই মহিলাকে আগলেই রাখেননি, তিন বছর ধরে তাঁর খাওয়া-পরা-চিকিৎসার ভারও ভাগ করে নিয়েছেন।
ঘটনাটি যে এক উজ্জ্বল ব্যতিক্রম, তা স্বীকার করছেন প্রশাসন এবং চিকিৎসক মহলের বড় অংশই। কারণ অতীতে তো বটেই, সাম্প্রতিক কালেও বহু ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ বিপরীত ভূমিকা নিতে দেখা গিয়েছে হাসপাতাল-ডাক্তার-নার্সদের একাংশকেও। কয়েক মাসের মধ্যেই কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন এক শিশু এইচআইভি পজিটিভ জানার পরে নার্সরা তাকে শৌচাগারের পাশে ফেলে রেখেছিলেন বলে অভিযোগ। আরজিকর হাসপাতালে এক রোগীকে বের করে দেওয়ার অভিযোগ ওঠে। খড়গপুরে এইচআইভি পজিটিভ ছাত্রের মাথা ফেটে যাওয়ার পরে তাঁর চিকিৎসায় এগিয়ে আসেননি ডাক্তাররা, এমন খবর উঠে আসে সংবাদমাধ্যমে। দুর্ঘটনায় আহত এইচআইভি পজিটিভ মহিলাকে চিকিৎসা করতে ‘অস্বীকার’ করেছিল হাওড়া হাসপাতাল।
অমূলক আশঙ্কা আর সংস্কারে ডুবে থাকা এই আবহেই সকলকে চমকে দিয়েছে বলরামপুর। কলকাতার স্কুল অব ট্রপিক্যাল মেডিসিন-এর এক চিকিৎসক বিভূতি সাহা ঘটনাটি শুনে বলছেন, “চিকিৎসার সঙ্গে যুক্ত কিছু মানুষই যেখানে এখনও কিছু ক্ষেত্রে ভুল ধারণা কাটাতে পারেননি, সেখানে গ্রামের মানুষের এমন মানসিকতাটা সত্যিই তারিফ করার মতো।”
গত ৬ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় কৈচর ১ পঞ্চায়েতের এই গ্রামে বাসিন্দাদের সঙ্গে বৈঠক করতে যান বর্ধমানের অতিরিক্ত জেলাশাসক (সাধারণ) উৎপল বিশ্বাস। সঙ্গে ছিলেন চার জন অতিরিক্ত জেলাশাসক, মহকুমাশাসক (কাটোয়া) মৃদুল হালদার-সহ কয়েক জন প্রশাসনের কর্তা। সভায় রাস্তা, জল, স্বাস্থ্য পরিষেবার নানা সমস্যা নিয়ে আলোচনা চলছিল। তখনই বছর চল্লিশের ওই রোগিণী উঠে দাঁড়িয়ে খোলাখুলি বলেন, “আমি এইচআইভি আক্রান্ত বিধবা। চিকিৎসা করাতে গিয়ে সর্বস্বান্ত। গ্রামের মানুষের কাছে আর কত সাহায্য চাইব? এ বার আপনারা সাহায্য না করলে আর চলবে না।”
প্রথমটা থমকে যান আধিকারিকরা। কয়েক মুহূর্ত পর নীরবতা ভেঙে এক জন বলে ওঠেন, “আপনি যে সাহস করে এই রোগের কথা বললেন, তা অত্যন্ত প্রশংসনীয়।” এর পরেই কথার সূত্রে বেরিয়ে আসে, কী ভাবে তিন বছর যাবৎ ওই মহিলাকে সাহায্য করে আসছেন গ্রামবাসীরা।
বলরামপুরের বাসিন্দাদের কথা থেকেই জানা যায়, ওই মহিলার স্বামী হাওড়া-নিমতা রুটে বাসচালক ছিলেন। বছর চারেক আগে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। শুরুতে ব্রেন টিউমারের চিকিৎসা হয়। কিন্তু তাতে ফল না হওয়ায় গ্রামের কয়েক জনই তাঁকে বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে রক্ত পরীক্ষা করে জানা যায়, তিনি এইচআইভি আক্রান্ত। যাঁরা তাঁকে চিকিৎসা করাতে নিয়ে গিয়েছিলেন, সেই গ্রামবাসীর মাধ্যমে গ্রামের বাকিরা এই খবর জানতে পারেন। মহিলার স্বামীকে প্রথমে বর্ধমান, পরে কলকাতার আরজিকর হাসপাতালে চিকিৎসা করান তাঁরা। বছর তিনেক আগে সেখানেই তাঁর মৃত্যু হয়। এর পরে তাঁর স্ত্রী বর্ধমান মেডিক্যালে রক্তপরীক্ষা করালে তাঁরও এইচআইভি পজিটিভ ধরা পড়ে।
বলরামপুর এর আগে কখনও এইচআইভি আক্রান্তকে দেখেনি। কিন্তু টেলিভিশন দেখে, গ্রামে আসা ‘আশা’ স্বাস্থ্য কর্মীদের থেকে শুনে গ্রামবাসীরা জেনেছিলেন, এ রোগ সহজে সংক্রামক নয়। রক্ত, লালা, দেহরসের সংযোগ ছাড়া কারও দেহে এ রোগ বাহিত হয় না। বর্ধমান মেডিক্যালের চিকিৎসক সুব্রত দত্তের অভিজ্ঞতাও বলছে, “সরকারি প্রচারের জেরে গ্রামের মানুষ এখন যথেষ্ট সচেতন।”
ফল? কোনও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন নয়, পঞ্চায়েতের নির্দেশ নয়, বাইরের নেতৃত্ব নয় স্রেফ মানবিকতার বোধ থেকেই এগিয়ে এসেছিল বলরামপুর। একে স্বামী মারা গিয়েছেন। শাশুড়ি ও এক মেয়েকে নিয়ে খুবই বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন ওই মহিলা। তার উপরে নিজের অসুখ। ওঁর কিছু আত্মীয়-পরিজন গ্রামেই থাকেন। সেই চন্দন দত্ত, শম্পা দত্তরা প্রথম থেকেই খেয়াল রাখছিলেন, যাতে ওঁর সঙ্গে আচার-আচরণে কোনও অস্বাভাবিকতা কারও মধ্যে প্রকাশ না পায়। এই শুভবুদ্ধিরই সংক্রমণ ছড়াল গ্রামে। এখন গ্রামবাসীরা সহজ সুরে বলেন, “অসুখ করেছে বলে গ্রামের বউকে তো আর পর করে দেওয়া যায় না!”
বধূ নিজেই বলছেন, এই তিন বছরে পুজো-পার্বণ থেকে শুরু করে সামাজিক অনুষ্ঠান, বাজারহাট থেকে রাস্তাঘাট কোথাওই তাঁকে বৈষম্যের শিকার হতে হয়নি। গ্রামের আর পাঁচ জন মেয়ে বন্যা-সীমা-বুলা-আনন্দময়ী দত্তেরা নিয়মিত তাঁর বাড়ি গিয়ে গল্পগুজব করে আসেন। কখন কী লাগবে, খোঁজ রাখেন। ওঁরা বলেন, “রোগ তো ছোঁয়াচে নয়। আমরা তাই পুজো-পার্বণে যোগ দেওয়া, নিমন্ত্রণ বাড়িতে যাওয়া, সব একসঙ্গেই করি।” অথচ হাতের কাছেই উদাহরণ রয়েছে, এইচআইভি পজিটিভ হওয়ার ‘অপরাধে’ বর্ধমান শহরে এক পরিবারকে কুয়ো থেকে জল তুলতে বাধা দিতেন প্রতিবেশীরা। আর বলরামপুরের মুদি ব্যবসায়ী রাজেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় বলেন, “অসুস্থ বলে দোকানের জিনিস দেব না, তা কি হয়?” স্থানীয় বাসিন্দা শুভেন্দু দত্তর মনে হয়, “আমাদের ব্যবহারে উনি যাতে কষ্ট না পান, সেটা দেখা তো আমাদেরই দায়িত্ব।”
শুধু স্বাভাবিক মেলামেশাই নয় মহিলার সংসার চালানোর দায়িত্ব, চিকিৎসার খরচও গ্রামের মানুষ যখন যতটা পারেন, জুগিয়েছেন। চাল-ডাল পাঠানোই হোক বা ওষুধপথ্য, সাহায্যে এগিয়ে এসেছেন। বছর দুয়েক আগে মহিলার একমাত্র মেয়ের বিয়ে গ্রামের লোকেরা দাঁড়িয়ে থেকে দিয়েছেন। গ্রামবাসীরা জানান, জামাইয়ের বাড়ি পাশের গ্রামে। সবাই সব জানতেন। কিন্তু মেয়ের রক্তপরীক্ষা করে কিছু না মেলায় বিয়েতে আপত্তি করেননি।
৬ তারিখ যে প্রকাশ্য বৈঠকে মহিলা নিজের সমস্যার কথা বললেন, তার পিছনেও গ্রামবাসীদেরই প্রেরণা। মহিলা বলছেন, “গ্রামের মানুষ পাশে আছেন বলেই তো প্রশাসনের কর্তাদের হাতের কাছে পেয়ে সব কথা বললাম। বাপের বাড়ি,
(সহ-প্রতিবেদন: অসিত বন্দ্যোপাধ্যায়)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy