সুরকার কল্যাণজি মান্নাদার গানের একটা চমৎকার অ্যাসেসমেন্ট করেছিলেন। মান্নাদার মতো এমন শিক্ষিত গায়ক আগেও আসেননি, পরেও না। কল্যাণজি বলছেন—মান্নাদাই পৃথিবীতে একমাত্র ক্লাসিকাল গায়ক, যিনি রাগের মশলা-মাখানো গানে কমার্শিয়াল ছবির মিউজিককে অন্য মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। সঙ্গীতের যে-ধ্রুপদ ঘরানা ছিল সাতমহলা রাজপ্রাসাদে বন্দি, মান্নাদা তাকে এনে দিলেন আম-জনতার মধ্যে। এমন ভাবে সাজিয়ে গুছিয়ে তাকে তিনি পরিবেশন করলেন, সবাই তা মহানন্দে উপভোগ করতে লাগলেন। ঠুংরি, গজল যে বাণিজ্যিক হিন্দি ছবিতেও এমন ভাবে সফল হতে পারে, কেউ কি আগে ভেবেছিল? মান্নাদা না থাকলে সুরকাররাও হয়তো এটা ভাবার সাহস পেতেন না।
স্টেজ পারফরমার হিসেবেও মান্নাদা ছিলেন অতুলনীয়। শুধু নিজের পারফরম্যান্স নয়, অন্যকেও কী ভাবে তৈরি করে নিতে হয়, মান্নাদা সেটা ভাল জানতেন। গানে-গল্পে (গানেই বেশি) দর্শকদের মজিয়ে রাখতেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা। বন্যাপীড়িতদের সাহায্যার্থে একটা অনুষ্ঠান হচ্ছে নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে। মান্নাদাই প্রধান শিল্পী। যদিও আরও অনেকে গাইবেন, কিন্তু মান্নাদার গানের জন্যই সবার অপেক্ষা। মান্নাদার গাওয়া হয়ে গেলে দর্শকদের ধরে রাখা মুশকিল। অবধারিত ভাবে তিনিই শেষে গাইবেন। অর্থাৎ প্রায় শেষ রাত। অভিনেত্রী আরতি ভট্টাচার্য ছিলেন সেই অনুষ্ঠানে। অল্প হলেও বেশ কয়েকটি ভাল ছবিতে অভিনয় করেছিলেন তিনি। যেমন, স্ত্রী, আনন্দমেলা, পিকনিক, শ্রেয়সী। প্রতিটি ছবিতেই মান্নাদার সব অসাধারণ গান। এর মধ্যে শ্রেয়সী ছবির সঙ্গীত পরিচালনা করেছিলেন স্বয়ং মান্নাদা। আগেই অল্প পরিচয় ছিল। মান্নাদা রসিকতা করে তাঁকে বললেন, ‘আপনাদের বেশ মজা। নমস্কার করে দুটো কথা বললেই আপনাদের ছুটি। আমার অবস্থা দেখুন। সবে তো সন্ধে, জাগতে হবে সারারাত’। আরতিদিও মজা করে বললেন, ‘অন্য রকম কিছু ভাবলে মন্দ হয় না।’ মান্নাদা বললেন, ‘অন্য রকম তো ভাবাই যায়। আসুন, আমরা একটা ডুয়েট গাই’। শুনে তো আরতিদির অজ্ঞান হবার জোগাড়। মান্নাদা তার সবচেয়ে প্রিয় শিল্পী। ভাবলেন উনি বোধহয় রসিকতা করছেন। মান্নাদা সিরিয়াস। ‘আমার কোন গানটা আপনি জানেন?’ আরতিদি কোনও মতে বললেন,‘আ যা সনম মধুর চাঁদনি মে হম’। মান্নাদা ডায়েরি খুঁজে গানটা বের করে আরতিদির হাতে দিলেন। এবার মিউজিসিয়ানদের সঙ্গে দু’তিনবার রিহার্সাল। রাত প্রায় শেষ। এবার ডুয়েট গাইবেন মান্না দে ও আরতি ভট্টাচার্য। দর্শকরা নড়েচড়ে বসলেন। ভট্টাচার্য? মুখোপাধ্যায় হবে তো! মান্নাদা কনফিডেন্ট। আরতিদি কাঁপছেন। ভয়ে নয়। পাবলিক অ্যাপিয়ারেন্সের অভ্যাস তো আছে। মান্নাদার সঙ্গে গাইতে হবে, এটাই ভয়। মান্নাদা এমন ভাবে ইনস্পায়ার করলেন, আরতিদি বুঝতেই পারলেন না কখন গান শেষ হয়ে গেছে। সম্বিৎ ফিরল দর্শকদের প্রবল হাততালিতে। সবাই বলছে আরতিদি দারুণ গেয়েছে। একেবারে ছুপা রুস্তম। সবাই একই কথা বলছে। আরতিদি কাউকে বোঝাতে পারছেন না—‘আমি নয়, আমি নয়। সবই মান্নাদার জন্য’।
এমনই অভিজ্ঞতা হয়েছিল অরুন্ধতী হোমচৌধুরীর। তাঁর কেরিয়ারের প্রথম দিক। ‘স্বাতী’ ছবিতে প্লেব্যাক। এমন ভাগ্য খুব কম শিল্পীরই হয়। সুরকার কিংবদন্তি হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। পরে একসঙ্গে অনেক কাজ করেছেন ঠিকই, কিন্তু এটা তো প্রথম। গাইবেন কার সঙ্গে? আর এক কিংবদন্তি শিল্পী মান্না দের সহশিল্পী তিনি। অরুন্ধতীদি স্বভাবতই একটু নার্ভাস। কিন্তু সে সব ধুয়ে-মুছে সাফ হয়ে গেল মান্নাদার সঙ্গে রিহার্সালের প্রথম দিনেই। কোনও সমস্যাই রইল না। মান্নাদা এমন সুন্দর ভাবে গাইড করলেন যে অরুন্ধতীদি গাইবার সঠিক পথটি সহজেই খুঁজে পেলেন। তৈরি হল বাংলা সিনেমার একটি সুন্দর মিষ্টি রোম্যান্টিক গান—‘কিছু কথা বলব তোমার কানে কানে।’ পরে দু’জনে বহু ছবিতে ডুয়েট গেয়েছেন। মান্নাদাকে আরও বেশি করে জেনেছেন। অরুন্ধতীদির উপলব্ধি হল—মান্নাদাকে দেখলে বোঝা যায় মনের দিক থেকে বড় না হলে বড় শিল্পী হওয়া যায় না।
আর এক আরতির কথা বলি। আরতি মুখোপাধ্যায়। মান্নাদার সঙ্গে আফ্রিকায় প্রোগ্রাম করতে গেছেন। নাইরোবি, মরিশাস, উগান্ডা... একের পর এক অনুষ্ঠান। শ্রোতারা একেবারে পাগল হয়ে উঠেছে। তাল কাটল মোম্বাসায় এসে। বিরাট অনুষ্ঠান। জোর কদমে স্টেজে রিহার্সাল চলছে। চারদিক আলোয় ঝলমল করছে। হয়েছে কী! স্টেজের পাশে এক জায়গায় অন্ধকার ছিল। সেখানে পাতা ছিল একটা কালো তার। দেখতে না পেয়ে সেই তারে পা জড়িয়ে আরতিদি পড়ে গেলেন। থুতনিটা কেটে গেল। লক্ষ করে দেখবেন সেই দাগ এখনও আছে। অনুষ্ঠানটা আর করা হল না। মান্নাদা প্রচণ্ড রেগে গেলেন। স্টেজের দায়িত্বে থাকা লোকদের এই মারেন তো সেই মারেন। রোজ হাসপাতালে আরতিদিকে দেখতে যেতেন। উৎকণ্ঠিত মুখ। সেই মুখ দেখে আরতিদি ভাবতেন সন্তানের অসুস্থাতেই বাবারা এমনই উদ্বিগ্ন হন। সত্যি বলতে তিনি তো পিতৃতুল্যই।
আরতিদির কাছে মান্নাদা ছিলেন এক মহান বিরল গায়ক। যাঁর কোনও তুলনা নেই। কোনও দিন ভাবেননি তার একটা স্বপ্ন এত তাড়াতাড়ি পূর্ণ হবে। সুরকার নচিকেতা ঘোষ তখন ‘বিলম্বিত লয়’ ছবির সুর করছেন। আরতিদিকে ডাকলেন গাইবার জন্য। একক গান তো ছিলই, একটা ডুয়েট গানও গাইতে হবে মান্নাদার সঙ্গে। গানটি রাগাশ্রয়ী। নচিবাবু আরতিদিকে অনুরোধ করলেন সাগিরুদ্দিন খান সাহেবকে আনার জন্য, যদি উনি গানটা একটু ঠিক করে দেন। আরতিদি তখন তাঁর ছাত্রী। তিনি বললে হয়তো ‘না’ করতে পারবেন না। কিন্তু আরতিদি ভাবছিলেন অন্য কথা। মান্নাদার মতো শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে পণ্ডিত মানুষ আর ক’জনই বা আছেন! তিনি গানটি গাইবেন। অন্য কেউ এসে যদি কারিকুরি করে, মান্নাদা কী ভাবে নেবেন? নচিবাবু অভয় দিলেন, না-না, মান্নাদা কিছু মনে করবেন না। সাগিরুদ্দিন খানসাহেব এসে গানটা কিছুটা ‘পালিশ’ করে দিলেন। আরতিদির ধারণা একদম অমূলক প্রমাণিত হল। মান্নাদা কিছুই মনে করলেন না। একজন প্রকৃত গুণীই আর একজন গুণীর কদর করতে পারেন। আরতিদিকে নিয়ে মান্নাদা এমন রিহার্সাল করলেন যে এক টেকেই রেকর্ডিং ‘ওকে’ হয়ে গেল। মানুষের ভাললাগায় চিরস্থায়ী হয়ে গেল সেই গান—‘বেঁধো না ফুলমালা ডোরে’।
আরতিদির পছন্দের দুই গায়ক হলেন গজল সম্রাট মেহেদি হাসান ও গোলাম আলি। গোলাম আলির সঙ্গে আলাপ হয় লন্ডনে, মেহেদি হাসানের সঙ্গে মুম্বইয়ে। মান্নাদাও এই দু’জনের অন্ধ ভক্ত ছিলেন। কথায় কথায় আরতিদি জানলেন ওই দু’জনেরই অতি প্রিয় গায়ক হলেন মান্না দে। মেহেদি হাসান তো প্রায়ই বলতেন, মান্নাদার মতো এত সঙ্গীত-শিক্ষিত গায়ক হিন্দি ছবিতে আগে আসেননি। গোলাম আলি বলেছিলেন, ‘আমার একটাই দুঃখ, ভারতে আমরা এত অনুষ্ঠান করি, কিন্তু মান্নাদার কখনও সুযোগ হল না পাকিস্তানে গিয়ে গান শোনানোর’।
একবার মান্নাদাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘আপনার মতে বাংলা গানে বেস্ট ফিমেল সিংগার কে? লতাজি-আশাজি ছাড়া।’ মান্নাদা একটু ভেবে বললেন, ‘প্রতিমার গলাটা খুব মিষ্টি, গাওয়ার মধ্যে একটা সরলতা আছে। সন্ধ্যাদিও সব ধরনের সুন্দর সুন্দর গান গেয়েছেন। তবে সব দিক মিলিয়ে আমার মনে হয় আরতিই বেস্ট। বড় ভাল গায় মেয়েটা।’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy