Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

অভিভাবক মান্না দে

কিশোরকুমার, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, নচিকেতা ঘোষ— প্রত্যেকেই নিজেদের সন্তানের সঙ্গীত শিক্ষার দায়িত্ব ছেড়ে দিয়েছিলেন মান্না দে-র হাতে। লিখছেন দেবপ্রসাদ চক্রবর্তী।মান্নাদার সঙ্গে যারা পথ চলেছেন দীর্ঘ দিন বা অল্প দিনের জন্যও, সবারই এক অভিজ্ঞতা—মান্নাদার হৃদয়টি ছিল আকাশের মতো বিস্তৃত, সমুদ্রের মতো গভীর। মান্নাদার স্নেহের ছোঁয়ায় ধন্য হয়েছে অনেকে। উত্তরবঙ্গে এক সান্ধ্য জলসা। প্রধান শিল্পী মান্নাদা। সেখানকার মানুষ বহু দিন ধরে অপেক্ষায় ছিল।

শেষ আপডেট: ২৮ জুলাই ২০১৫ ০০:২২
Share: Save:

মান্নাদার সঙ্গে যারা পথ চলেছেন দীর্ঘ দিন বা অল্প দিনের জন্যও, সবারই এক অভিজ্ঞতা—মান্নাদার হৃদয়টি ছিল আকাশের মতো বিস্তৃত, সমুদ্রের মতো গভীর। মান্নাদার স্নেহের ছোঁয়ায় ধন্য হয়েছে অনেকে।

উত্তরবঙ্গে এক সান্ধ্য জলসা। প্রধান শিল্পী মান্নাদা। সেখানকার মানুষ বহু দিন ধরে অপেক্ষায় ছিল। মান্নাদা একের পর এক গান গাইছেন আর শ্রোতারা আনন্দে পাগল হয়ে উঠছে। এখানে কৌতুকাভিনেতা চিন্ময় রায়ের অনুষ্ঠান ছিল—দশ-পনেরো মিনিটের মজার অভিনয়। এদিকে সেই সন্ধ্যায় খানিক দূরে চিন্ময়বাবুর আরও একটি অনুষ্ঠান। কিন্তু এখানে মান্নাদার অনুষ্ঠান যেমন জমে উঠেছে, শ্রোতারা দু’ ঘন্টার আগে ছাড়বে বলে মনে হয় না। তার পরে এখানে অনুষ্ঠান করে অন্য অনুষ্ঠান করা প্রায় অসম্ভব। এমন সময় কিছু ক্ষণের জন্য বিরতি। মিউজিশিয়ানরা তাঁদের যন্ত্র সুরে বাঁধছেন। চিন্ময়বাবু যা থাকে কপালে ভেবে নিয়ে মঞ্চে সরাসরি মান্নাদাকে গিয়ে সমস্যার কথা বললেন। মান্নাদা শ্রোতাদের বললেন, ‘চিন্ময় রায় আপনাদের মজার অভিনয় করে দেখাবেন। দেখুন, ভাল লাগবে। তার পর আমি আবার গাইব।’ আর চিন্ময়বাবুকে বললেন, ‘আপনি করুন, আমিও দেখছি।’ জমে যাওয়া অনুষ্ঠানের মাঝে স্টেজ ছেড়ে দিচ্ছেন অন্য শিল্পীকে—এমন আর কোনও ঘটনা আপনারা শুনেছেন?

মান্নাদাকে মধ্যমণি করে একটা টেলিফিল্ম হয়েছিল—‘পাগল তোমার জন্য যে’। অভিনয় করেছিলেন স্বয়ং মান্না দে। শ্যুটিং চলছে। দৃশ্যটা এ রকম—মান্নাদা জড়িয়ে ধরবেন পরান বন্দ্যোপাধ্যায়কে। পরানবাবুর স্বপ্নের গায়ক মান্না দে। কোনও দিন ভাবতেও পারেননি মান্নাদা তাঁকে জড়িয়ে ধরেছেন। এত কাছে তাঁকে পাবেন। আপ্লুত পরানবাবু সেই উপলব্ধির কথা বললেন মান্নাদাকে। মান্নাদা বললেন—‘আপনার মতো অভিনেতাকে কাছে পেয়ে আমিও গর্বিত।’ শুনে অবাক হয়ে গেলেন পরানবাবু।

মান্নাদা সহশিল্পীদেরও খুব খেয়াল রাখতেন। মান্নাদার সঙ্গে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের রেকর্ডিং। রেকর্ডিং থাকলে সন্ধ্যাদি খুব টেনশনে থাকেন। মান্নাদা সে কথা জানতেন। এমন গল্প জুড়ে দিলেন মান্নাদা যে সন্ধ্যাদেবীর সব টেনশন নিমেষে উধাও। ১৯৮৬ সালে মান্নাদার সুরে দুটি গান রেকর্ডিং করেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। সন্ধ্যাদি খুব যত্ন করে গাইলেন। খুশি হয়ে মান্নাদা কী উপহার দিলেন জানেন? দারুণ একটা রান্নার রেসিপি। অনেকের অবাক লাগবে আর একটা বিষয়ে। তখন মান্নাদা আর সন্ধ্যাদি দু’জনের সঙ্গেই তবলা বাজাতেন রাধাকান্ত নন্দী। এমনও হয়েছে দু’জনের একই দিনে অনুষ্ঠান। কিন্তু নিজেদের মধ্যে এমন মধুর সহযোগিতার সম্পর্ক, কারও কোনও অসুবিধা হয়নি। মান্নাদা ও হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সম্পর্ক নিয়ে অনেকের অনেক রকম ধারণা আছে। শুধু একটা কথা বলি। হেমন্তবাবু মান্নাদার হাতেই ছেড়ে দিয়েছিলেন তাঁর কন্যা রানুকে। মান্নাদাও কন্যাস্নেহে তাকে নিয়ে দেশ-বিদেশে কত অনুষ্ঠান করেছেন। যেমন ভাবে অমিতকুমারের সঙ্গীতশিক্ষার ব্যাপারে কিশোরকুমার নির্ভর করতেন মান্না দের উপর।

এক একটা গান আল্টিমেটলি হয়ে ওঠে শিল্পীর গান। যাঁরা গানটিকে তৈরি করেন, সেই গীতিকার ও সুরকারেরা নেপথ্যেই থেকে যান। বেশির ভাগ শ্রোতা তাঁদের কথা জানেই না। মান্নাদাই বোধহয় প্রথম তাঁদের স্বীকৃতি দিয়েছেন। অনুষ্ঠানের শুরুতেই গানের গীতিকার ও সুরকারদের নাম জানিয়ে দিতেন। শুধু নামীদেরই নয়, অনামীদেরও। লেখা বা সুর পছন্দ হয়েছে বলেই অনেক অপরিচিত মানুষের লেখা বা সুরে গেয়েছেন মান্নাদার মতো কিংবদন্তি শিল্পী। আমি সবাইকে যথাযোগ্য সম্মান দিয়েই বলছি শুধুমাত্র মান্নাদার সুর বা গায়কির জন্যই বিশেষ ভাবে সেই গান অমরত্বে পৌঁছেছে। কারণ অন্য কোনও শিল্পীর কণ্ঠে তাদের গান তেমন জনপ্রিয় হয়নি। এখানেই মান্নাদা অনন্য।

১৯৭৫ সাল। হাওড়ায় জলসা। প্রধান শিল্পী মান্না দে। তাঁর আগে গাইবেন হৈমন্তী শুক্লা। তখন হৈমন্তীদির সামান্য কয়েকটি রেকর্ড বেরিয়েছে—তখনও তেমন জনপ্রিয় হননি। হৈমন্তীদি গাইছেন, এমন সময় দেখলেন মান্নাদা ঢুকছেন। দর্শকেরা মান্নাদাকে দেখে প্রচণ্ড আলোড়িত। হৈমন্তীদি গানটি শেষ করেই উঠে আসছিলেন, অবাক হয়ে দেখলেন মান্নাদা সরাসরি মঞ্চে উঠে এসেছেন। দর্শকদের বললেন, ‘কী সুন্দর গাইছে হৈমন্তী। আমার তো দারুণ ভাল লেগেছে। ওর গান আপনারা আরও শুনুন, আমিও শুনি।’ তখনও তেমন পরিচিত নয়, এমন একজন শিল্পীকে উৎসাহ দিচ্ছেন ভারতবর্ষের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ শিল্পী মান্না দে। ভাবা যায় না। আসলে কত সংগ্রামের পথ পেরিয়ে এসে একজন শিল্পী মানুষের স্বীকৃতি পায়, সে কথা মান্নাদার থেকে বেশি কে জানতেন? সুযোগ পেলেই মান্নাদা এমন ভাবে পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। বাংলাগানের তিন দিকপাল একসঙ্গে রেকর্ডিং করছেন। গৌরীপ্রসন্ন (গীতিকার), নচিকেতা ঘোষ (সুরকার) এবং মান্না দে। তবলায় রাধাকান্ত নন্দী। নচিবাবুর ছেলে সুপর্ণর বয়স তখন খুবই কম। সারারাত জেগে রিদমের একটা প্যাটার্ন তৈরি করেছেন, কিন্তু বাবা সেসবে একেবারে পাত্তা দিচ্ছেন না। রাধুবাবুকে বলছেন হাত খুলে বাজাতে। রাধুবাবুও খুশি। সব দেখে শুনে মান্নাবাবু এলেন উদ্ধারকর্তা হয়ে। বললেন, ‘‘ও নচিবাবু! খোকা (সুপর্ণদাকে এ নামেই ডাকতেন) কী বলছে একটু শুনুন না! আমার তো মনে হচ্ছে প্যাটার্নটা ও ভালই করেছে।’’ মান্নাবাবুর কথা নচিবাবু আর কী করে ফেলেন! অগত্যা...

পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়-মান্না দে জুটিতে সৃষ্টি হয়েছে বাংলা গানের বহু মণিমুক্তো। পুলকদা তাঁর অনেক বাণীর জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন মান্নাদার কাছে। কত গান শোনা তাঁর কাছে। যেমন মেহদি হাসান। লিরিক্যালি সমৃদ্ধ কত গজল। মান্নাদার কাছে ও সব গান না শুনলে হয়তো লেখা হত না ‘যখন কেউ আমাকে পাগল বলে’, ‘এ কী অপূর্ব প্রেম দিলে’, ‘রাতজাগা দুটি চোখ’ ইত্যাদি গান।

একদিন মান্নাদা বললেন, আপনারা প্রেমের গান লেখেন অনেকটা একই ধাঁচের। কিন্তু ইংরেজি গান শুনবেন, দেখবেন ভালবাসার কথা ওরা কত রকম ভাবে বলে। কত বিষয়বৈচিত্র ওদের গানে। মান্নাদা গেয়ে উঠলেন জিম রিভসের সেই বিখ্যাত গান ‘‘Oh Dawny boy, Down The Mountain Side the Summer’s gone! এই গানের সুরে প্রভাবিত হয়ে মান্নাদা তৈরি করেছিলেন সেই অমর গান ‘আমি আজ আকাশের মতো একেলা’ (শ্যামল গুপ্তের কথা)। একদিন মান্নাদার গলায় শুনলাম ‘হলিডে ইন’-এর সেই বিখ্যাত গান ‘Sweet Heart Of Mine, I have sent you a Valentine’। কখনও এলভিস প্রেসলি, কখনও অ্যান্ডি উইলিয়ামস-এর ‘can’t get used to losing you’। আমি নিজেকেও সৌভাগ্যবান মনে করি মান্নাদার গলায় ওই সব বিখ্যাত ইংরেজি গান শুনতে পেয়েছি বলে। চার্জড হয়েছি। প্রেরণা পেয়েছি নতুন ভাবে গান লিখবার।

মান্নাদা সাধারণত অনুষ্ঠান করতেন অনেক সময় ধরে। দর্শকদের মন কানায় কানায় পূর্ণ করে দিতেন। একদিন মান্নাদার দীর্ঘ দিনের যন্ত্রশিল্পী বেবিদা (প্রতাপ রায়) জিজ্ঞাসা করলেন, এত সময় ধরে গান গাইতে কষ্ট হয় না? মান্নাদা কী বললেন জানেন? ‘‘না বেবি! আমার একদম কষ্ট হয় না, বরং খুব আনন্দ হয়। যখন চোখের সামনে দেখি শয়ে শয়ে মানুষ শুধু আমার গান শোনার জন্য অধীর আগ্রহে বসে আছে। ঈশ্বর যেন আমাকে নতুন করে শক্তি দেয়। আমার চোখে জল এসে যায়। আমি তো শুধু একটু গাইতে পারি, তার জন্য সবার এত ভালবাসা....’’ বলতে বলতে মান্নাদার চোখ ভিজে যায়, কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে আসে।

আর তাঁর অমর গানের উত্তরাধিকার বহন করে আমরা গর্বিত হই বারবার।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE