নেত্রীর গ্রেফতারের খবর পেয়ে সমর্থকদের বিক্ষোভ। ছবি: পিটিআই।
বিষয়টা অনেকেরই জানা। বিশেষত সংসদ-ভবনে যাঁদের নিত্য যাতায়াত, তাঁরা প্রত্যেকেই জানেন এডিএমকের সাংসদরা দলনেত্রী জয়ললিতার ছবি পকেটে নিয়ে সংসদে আসেন। দলে ঠিক এতটাই গুরুত্ব জয়ার। সেই তাঁরই জেল? এর পর যে দলের সদস্য-সমর্থকরা তামিলনাড়ুতে তীব্র প্রতিবাদ-বিক্ষোভ দেখাবেন, এটাই তো প্রত্যাশিত। হলও তাই। ডিএমকে নেতা করুণানিধির কুশপুতুল পোড়ানো, সংবাদমাধ্যমকে আক্রমণ, আত্মহত্যার চেষ্টা, শহরের বিশাল অংশ অচল করে দেওয়া ক্ষোভের এমনই ছবি দেখাল তামিলনাড়ু। গোয়েন্দা বিভাগের আশঙ্কা, এই বিক্ষোভের তীব্রতা আরও বাড়তে পারে।
বাড়বে না-ই বা কেন? মাত্র চার মাস আগের লোকসভা ভোটেও জয়া দেখিয়ে দিয়েছিলেন, জনপ্রিয়তার নিরিখে তিনি বহু এগিয়ে। না-হলে ৩৯টি লোকসভা আসনের ৩৭টিতেই জয়? কী বিপুল জনসমর্থন রয়েছে তাঁর, তা সেই পরিসংখ্যানই স্পষ্ট করে দিয়েছিল। এ দিন সেই সমর্থকদেরই একাংশ রাস্তায় নামেন। তাঁদের তাণ্ডবে দিনের একটা সময় জয়ার পোজ গার্ডেনের বাড়ি থেকে করুণানিধির বাড়ি পর্যন্ত এক কিলোমিটার রাস্তা রণক্ষেত্রের চেহারা নেয়। গাড়ি লক্ষ্য করে ঢিল ছোড়া, করুণানিধির বাড়িতে হামলা আর তার জেরে ডিএমকে প্রধানের সমর্থকদের সঙ্গে ব্যাপক অশান্তি, বিজেপি নেতা সুব্রহ্মণ্যম স্বামীর বাড়িতে হামলা, গায়ে আগুন লাগিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা সব মিলিয়ে উত্তপ্ত হয়ে উঠল চেন্নাই। করুণানিধি, তাঁর ছেলে স্ট্যালিন ও আলাগিরির কুশপুতুল পোড়ানো হয়। রাস্তায় আটকে পড়েন পড়ুয়া ও অফিসযাত্রীরা। আক্রান্ত হন এক খবরের চ্যানেলের কর্মীরা। কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে তামিলনাড়ুর রাজধানী শহর।
আবেগের এমন বহিঃপ্রকাশ যে জয়ললিতার জন্যই বরাদ্দ থাকবে, তাতে আর আশ্চর্যের কী। অনেকেই উদাহরণ দিচ্ছেন আম্মার রাজনৈতিক সভাগুলোর। তাতে একটা ছবি প্রায়ই দেখা যেত। মঞ্চে নেতারা ও ময়দানে বিপুল জনগণ আম্মার অপেক্ষায় বসে রয়েছেন। হঠাৎ আকাশে তাঁর হেলিকপ্টার নজরে এল। দু’হাত জোড় করে সেই উড়ন্ত কপ্টারের দিকেই প্রণাম করলেন সকলে। আম্মার প্রতি শ্রদ্ধা, ভরসার প্রকাশ (মতান্তরে ভয়-ভীতি)। তাঁর কারাদণ্ডের খবর যে এ ভাবেই তামিলনাড়ুকে নাড়া দেবে, তাতে তো বিস্ময়ের কিছু নেই।
কিন্তু তা বলে এমন বিক্ষোভ? শুধু রাজধানী শহর নয়, রাজ্যের অন্য অংশেও তার ঢেউ লেগেছে। কোথাও সরকারি বাসে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়, কোথাও জোর করে বন্ধ করে দেওয়া হয় দোকান-বাজার। ব্যাপক ঢিল-বৃষ্টিতে কাড্ডালোর জেলায় অন্তত কুড়িটি বাস ভেঙেচুরে যায়। উত্তাল হয়ে ওঠে জয়ললিতার নির্বাচনী কেন্দ্র শ্রীরঙ্গম। তিরুনেলভেলি ও নাগাপত্তিনামে ট্রেন আটকে পড়ে। অন্য দিকে তীব্র বিক্ষোভের জেরে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে মাদুরাইয়ের যান-চলাচল। সেখানে প্রায় হাজার জন এডিএমকে সমর্থককে হেফাজতে নিয়েছে পুলিশ। কোয়ম্বত্তূরেও ব্যাপক অশান্তি হয়। করুণানিধির কুশপুতুল পোড়াতে গিয়ে সেখানে আহত হন এক জয়ললিতা-সমর্থক। দু’জন আত্মহত্যার চেষ্টাও করেন। পরিস্থিতি এমনই দাঁড়ায় যে কোথাও কোথাও লাঠিচার্জ করতে বাধ্য হয় পুলিশ।
তবে স্রেফ লাঠিচার্জ দিয়ে এ গণবিক্ষোভ যে বেশি ক্ষণ নিয়ন্ত্রণে রাখা যাবে না, তা বুঝে গিয়েছে পুলিশ-প্রশাসন। কারণ, ইতিমধ্যেই চেন্নাইয়ে এডিএমকের সদর দফতর থেকে সমর্থকরা দলে দলে প্রতিবাদ মিছিলের জন্য রওনা দিয়েছেন। তাতে নেতৃত্ব দিচ্ছেন স্থানীয় মিউনিসিপ্যাল কাউন্সিলররা। সব মিলিয়ে লাগামছাড়া হতে পারে চেন্নাইয়ের পরিস্থিতি।
এই আশঙ্কার কথা আঁচ করেই জায়গায় জায়গায় নিরাপত্তা বাড়াতে শুরু করেছে পুলিশ। করুণানিধির বাড়ি-সহ নানা এলাকায় বিপুল সংখ্যক পুলিশ বাহিনী মোতায়েন করা হয়। বাড়ানো হয়েছে নজরদারিও। পরিস্থিতি এমনই যে তামিলনাড়ুতে আইন-শৃঙ্খলা ফেরাতে রাষ্ট্রপতিকে চিঠি লিখেছেন ডিএমকে প্রধান করুণানিধি। তাঁর দাবি, তামিলনাড়ুতে গোটা সাংবিধানিক ব্যবস্থাই ভেঙে পড়েছে।
শুধু তামিলনাড়ু নয়, বিক্ষোভের ঢেউ যে পড়শি কেরলেও আছড়ে পড়তে পারে সে কথা আন্দাজ করে ইতিমধ্যেই দু’রাজ্যের সীমানায় কড়া সতর্কতা জারি করেছে কেরল প্রশাসন। অশান্তির আশঙ্কা ছিল বেঙ্গালুরুতেও। এ দিন রায় শুনতে জয়ললিতা যখন পৌঁছন, তখনই পরিবেশ ছিল থমথমে। রায় বেরোনোর পর পরিস্থিতি আরও গম্ভীর হয়ে যায়।
এবং এ সব কিছুর কেন্দ্রেই তিনি, জয়ললিতা। তামিলনাড়ুর বাসিন্দাদের বড় কাছের ‘পুরাৎচি থলাইভি’। বাংলা করলে যার মানে দাঁড়ায় বিপ্লবী নেত্রী। সার্থক নাম। না হলে সাজাপ্রাপ্ত নেত্রীর জন্য এমন গণবিক্ষোভ? এ বিপ্লবের থেকে কম কী?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy