Advertisement
২০ এপ্রিল ২০২৪

হাজার কোটির চিনা লগ্নি টানাই চ্যালেঞ্জ মোদীর

ওহরলাল নেহরু ‘হিন্দি-চিনি ভাই ভাই’ মন্ত্র আওড়াতে গিয়ে ভারী ধাক্কা খেয়েছিলেন। চিনের প্রেসিডেন্টকে আজ নরেন্দ্র মোদী যে ভাবে আমদাবাদে অভ্যর্থনা জানিয়েছেন, তাকে অনেকেই ‘মোদী-চিনি ভাই ভাই’ বলে ডাকছেন। সরকারের কূটনীতিকরা বলছেন, সীমান্ত বিবাদ নিয়ে আলোচনা চলবে। কিন্তু ‘ড্রাগন বনাম হাতির লড়াই’ জিইয়ে না রেখে দু’দেশের বাণিজ্য সম্পর্ককে আরও মজবুত করাই লক্ষ্য নরেন্দ্র মোদীর।

প্রেমাংশু চৌধুরী
আমদাবাদ শেষ আপডেট: ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৪ ০৩:১৮
Share: Save:

ওহরলাল নেহরু ‘হিন্দি-চিনি ভাই ভাই’ মন্ত্র আওড়াতে গিয়ে ভারী ধাক্কা খেয়েছিলেন। চিনের প্রেসিডেন্টকে আজ নরেন্দ্র মোদী যে ভাবে আমদাবাদে অভ্যর্থনা জানিয়েছেন, তাকে অনেকেই ‘মোদী-চিনি ভাই ভাই’ বলে ডাকছেন। সরকারের কূটনীতিকরা বলছেন, সীমান্ত বিবাদ নিয়ে আলোচনা চলবে। কিন্তু ‘ড্রাগন বনাম হাতির লড়াই’ জিইয়ে না রেখে দু’দেশের বাণিজ্য সম্পর্ককে আরও মজবুত করাই লক্ষ্য নরেন্দ্র মোদীর।

চিনের প্রেসিডেন্ট শি চিনফিং আজ তিন দিনের ভারত সফরে আমদাবাদে পা দেওয়ার পরেই গুজরাতে শিল্প পার্ক তৈরির জন্য চিনা সংস্থাগুলির সঙ্গে চুক্তি হয়েছে। সরকারের বক্তব্য, এই শিল্প পার্ক এবং সেখানে চিনা সংস্থাগুলির বিনিয়োগই দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ককে আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার রূপরেখা তৈরি করবে।

চিনের সঙ্গে বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ভারতের মূল দুশ্চিন্তার বিষয় দু’দেশের মধ্যে বাণিজ্য ভারসাম্যের অভাব। ভারত যে পরিমাণ চিনে রফতানি করে, চিন তার থেকে ভারতে রফতানি করে অনেক বেশি। দু’দেশের বাণিজ্যের পরিমাণ ৬৫০০ কোটি ডলার। কিন্তু ভারতের তুলনায় চিনের রফতানির পরিমাণ ৩৬০০ কোটি ডলার বেশি। অথচ ১৪ বছর আগে এই ঘাটতির পরিমাণ ছিল মাত্র ১০০ কোটি ডলার।

এই ফারাক ঘুচবে কী ভাবে? কেন্দ্রীয় বাণিজ্যমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন বলেন, “শুধু ভারতীয় পণ্যের রফতানি বাড়িয়ে এই ফারাক মেটানো সম্ভব নয়। কারণ ভারত মূলত কাঁচামাল রফতানি করে। চিন পাঠায় বৈদ্যুতিন সরঞ্জামের মতো কারখানায় উত্‌পাদিত পণ্য। তাই চিন থেকে লগ্নি প্রয়োজন। চিনের সংস্থাগুলিকে বলতে হবে, এ দেশেই কারখানা তৈরি করে এ দেশের বাজারে পণ্য বিক্রি করতে হবে।”

চিনের লগ্নি কিন্তু ভারতে খুবই কম। ২০০০ থেকে ২০১৪ পর্যন্ত চিন ভারতে মাত্র ৪০ কোটি ডলার লগ্নি করেছে। বছর বছর লগ্নি কমেছে। ২০০৮ সালে চিন ভারতে ৮.৮ কোটি ডলার লগ্নি করেছিল। গত বছর করেছে মাত্র ২.৭ কোটি ডলার। আমেরিকার সঙ্গে মন কষাকষি সত্ত্বেও চিন বারাক ওবামার দেশে গত বছর ১৪০০ কোটি ডলার লগ্নি করেছে। চিনের বিদেশি মুদ্রার ভাণ্ডার উপচে পড়ছে। আগামী পাঁচ বছরে অন্যান্য দেশে ৫০ হাজার কোটি ডলার লগ্নির পরিকল্পনা করেছে চিন। এরই একটা অংশ ভারতে নিয়ে আসতে চাইছেন নরেন্দ্র মোদী। প্রধানমন্ত্রী দফতরের বক্তব্য, গুজরাতকে সামনে রেখে সেই লগ্নি টানারই কাজ শুরু করেছেন তিনি। চিনের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে ১৩৫টি চিনা সংস্থার সিইও ভারত সফরে এসেছেন। তাঁদের সামনে ভারতকে ‘লগ্নির গন্তব্যস্থল’ হিসেবে তুলে ধরতে চাইছেন মোদী।

লাদাখ-তিব্বত বা অরুণাচল নিয়ে বিবাদের সঙ্গে তাই বাণিজ্যিক সম্পর্ককে গুলিয়ে ফেলতে চাইছে না নয়াদিল্লি। কিছু দিন আগেই জাপানে গিয়ে সে দেশের লগ্নি টানার চেষ্টা করেছেন মোদী। নয়াদিল্লির বক্তব্য, জাপানের সঙ্গে বন্ধুত্ব মানেই চিনের সঙ্গে শত্রুতা নয়। জাপান নিজে চিনকে বাদ দিয়ে অন্য শান্তিপূর্ণ দেশগুলির জোট তৈরি করতে চাইছে। সেই দলে ভারতকেও চায় জাপান। কিন্তু জাপান নিজে ভারতের তুলনায় অনেক বেশি অর্থ চিনে বিনিয়োগ করে। আজ তাই নিজের জন্মদিনেও জাপান ও চিনের মধ্যে ভারসাম্যের কূটনীতি বজায় রেখেছেন নরেন্দ্র মোদী। এক দিকে মোদী জন্মদিনে চিনের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে চাঁদের আলোয় নৈশভোজ করেছেন। অন্য দিকে জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে নিজে ফোন করে মোদীকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানিয়েছেন।

বিদেশ মন্ত্রকের বক্তব্য, বৃহস্পতিবার থেকে চিনা প্রেসিডেন্টের নয়াদিল্লির কর্মসূচি শুরু হবে। দু’দেশের বৈঠকে সীমান্ত বিবাদের সমস্যা নিয়ে আলোচনা হবে। লাদাখ সীমান্তে এখনও চিনা সৈন্যের অনুপ্রবেশ নিয়ে সংঘাত চলছে। মঙ্গলবার দুই সেনাবাহিনীর বৈঠকে ভারতের তরফে চিনকে কড়া বার্তা দেওয়া হয়েছে। ফের বৈঠকে রাজি হয়েছে চিন। অন্যান্য স্পর্শকাতর বিষয়ও আলোচনার টেবিলে আসতে পারে। কিন্তু আগে থেকেই অসন্তোষের পরিবেশ তৈরি করতে চায়নি নয়াদিল্লি। সেই কারণেই চিন প্রেসিডেন্টের ভারত সফরের সময় দলাই লামাকে নয়াদিল্লিতে কোনও অনুষ্ঠান করতে দেওয়া হয়নি। মনমোহন সিংহ অতীতে এই ভুল করেছিলেন। বিদেশ মন্ত্রক সূত্রের বক্তব্য, তা বলে তিব্বতের রাজনীতি ভুলে গিয়ে ভারত অখণ্ড চিনের রাজনীতি মেনে নিচ্ছে না। সে ক্ষেত্রে ভারতও চিনের উপরে অরুণাচলকে ভারতের অঙ্গ হিসেবে মেনে নেওয়ার শর্ত রাখবে। বিদেশ মন্ত্রকের ওই সূত্র মনে করিয়ে দিচ্ছেন, নরেন্দ্র মোদীর শপথ-অনুষ্ঠানে তিব্বতিদের নির্বাসিত সরকারের প্রধানমন্ত্রী লবসাং সাংগেকেও আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। তিনি হাজিরও হয়েছিলেন।

বিবাদ ভুলে গিয়ে শি চিনফিংয়ের নয়াদিল্লি সফরে কতখানি চিনা লগ্নির ঘোষণা হয়, সে দিকেই তাকিয়ে রয়েছে নরেন্দ্র মোদীর সরকার। নয়াদিল্লির আশা, আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে চিন ভারতের বিভিন্ন রেল প্রকল্প, পরিকাঠামো ও কারখানা তৈরিতে প্রায় হাজার কোটি ডলার লগ্নি করতে পারে। এশিয়ার সব থেকে বড় অর্থনীতিকে ভারতের অর্থনীতির স্বার্থে কাজে লাগানোটাই আপাতত সব থেকে বড় স্বপ্ন মোদীর ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE