Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

‘কাটা আঙুল’ পড়ে রাস্তায়, বোবা ভিড়ের দিকে আঙুল কবির

সে দিনের সেই ‘নবীন কিশোর’ আজ বছর সাতাশের যুবক— নবীন চৌরে। সম্প্রতি ‘গণপিটুনি’-র প্রতিবাদে লেখা তাঁর একটি কবিতা ভাইরাল হয়েছে।

নবীন চৌরে

নবীন চৌরে

চৈতালি বিশ্বাস
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৬ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ০১:৫৫
Share: Save:

ছোট থেকেই তিনি মুখচোরা। চার পাশে যা দেখতেন, তা শব্দ দিয়ে বন্দি করতেন খাতায়। ডায়েরিতে নিঃশব্দে জমত আলো-অন্ধকার থেকে জন্ম নেওয়া সময়ের কবিতারা।

সে দিনের সেই ‘নবীন কিশোর’ আজ বছর সাতাশের যুবক— নবীন চৌরে। সম্প্রতি ‘গণপিটুনি’-র প্রতিবাদে লেখা তাঁর একটি কবিতা ভাইরাল হয়েছে। যেখানে কবি সরাসরি আঙুল তুলছেন সমাজের সংখ্যাগরিষ্ঠের দিকে। যারা টুঁটি চেপে ধরতে চায় সংখ্যালঘুর। কবি সরব হয়েছেন চোখের সামনে পিটিয়ে খুন দেখেও চুপ থাকায় অভ্যস্ত ভিড়ের মানসিকতা নিয়ে। নবীন লেখা শুরু করেছেন একটি কাটা আঙুলের চিত্রকল্প দিয়ে— ‘‘এক সড়ক পে খুন হ্যায়/ তারিখ কোই জুন হ্যায়/ এক উঙ্গলি হ্যায় পড়ে/ অউর উসপে জো নাখুন হ্যায় / নাখুন পে হ্যায় এক নিশান/ অব কৌন হোগা হুকমরান/ যব চুন রহি থি উঙ্গলিয়া/ তব ইয়ে উঙ্গলি ভি থি উহাঁ...’’

মধ্যপ্রদেশের হোশঙ্গাবাদের নবীন জানালেন, কয়েক বছর আগে তিনি দিল্লি এসেছেন পড়াশোনা করতে। দিল্লি আইআইটি। কেমিক্যাল ই়ঞ্জিনিয়ারিং পড়ার ফাঁকে চলছিল কবিতা লেখাও। মাঝে এক বছর থিয়েটার শিখেছেন। তার পর ২০১৬-র শেষ দিকে লিখতে শুরু করেন ‘বাস্তবিক কানুন’ নামের ওই দীর্ঘ হিন্দি কবিতাটি। ২০১৭ নাগাদ লেখা শেষ হয়। কিছুটা থিয়েটারের ধাঁচে অভিনয় ও ভিন্ন ভিন্ন বাচনভঙ্গিতে পাঠ করে তা ভিডিয়ো রেকর্ড করানো হয়।

সম্প্রতি নবীনের সেই কবিতার ভিডিয়ো ‘বাহ মোদীজি বাহ’ নামের একটি পেজে শেয়ার করা হয়। এর পরেই তা ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়ে। বর্তমানে নবীনের কবিতার ‘ভিউয়ার’ তিরিশ লক্ষ ছাড়িয়েছে।

বর্তমানে লেখালেখির সূত্রে দিল্লিতেই থাকেন নবীন। জানালেন, তাঁর প্রতিবাদ ধর্মের বিরুদ্ধে নয়, ধর্মের নামে যারা তাকে ভুল ভাবে ব্যবহার করছে, তাদের বিরুদ্ধে। তাঁর কথায়, ‘‘ছোট থেকে দেখছি, স্কুলে যে বাচ্চাটা অন্তর্মুখী, তার উপরে বাকিরা দল বানিয়ে চেপে বসে। স্কুল, কলেজ, কর্মক্ষেত্র—গল্পটা এক। এগুলো আমায় ভাবাত।’’

‘বাস্তবিক কানুন’ লেখার পিছনে কোনও বিশেষ ঘটনা বা কোনও বিশেষ গল্প নেই। তবে আছে চারপাশের দেখা রোজকার ভয় পাওয়ার স্মৃতি, জানালেন কবি।

নবীনের কথায়, ‘‘মানুষকে ভয় দেখানোটাই এর আসল উদ্দেশ্য। একার উপরে সমষ্টির আঘাত। সেটা ভাষাগত বিভেদের কারণেই হোক বা ধর্মের ভেদের কারণে। গণতন্ত্রের পক্ষে এই প্রবণতা বিপজ্জনক।’’

নবীন বিশ্বাস করেন, বিভিন্নতা না-থাকলে সুস্থ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। বিরুদ্ধ মত শোনাটাও জরুরি। তাই তাঁর এই ভিডিয়ো ঘিরে যেমন উৎসাহীদের প্রশংসা তাঁকে আনন্দ দিয়েছে, সে ভাবে এর সমালোচনাও সহজ ভাবে গ্রহণ করেছেন তিনি। নবীন বলছেন, ‘‘গণপিটুনির মানসিকতার বিরুদ্ধে লিখছি। এই অস্থির সময়ে রাজনৈতিক কবিতা লেখায় অনেকেই অখুশি। তবে এখনও সরাসরি হুমকি কেউ দেয়নি। কয়েক জন ভিন্ন মত পোষণ করেছেন শুধু। সাংবিধানিক সীমা লঙ্ঘন না-করে সেটা তো করাই যায়।’’

এই সময়ে একের পর এক ঘটে চলা গণপিটুনির খবর নবীনকে বিচলিত করে। কিন্তু তার চেয়েও তাঁকে বেশি ভাবায় গণপিটুনির পরে সাক্ষীর অভাবে অভিযুক্তদের পার পেয়ে যাওয়া। নবীন বলেন, ‘‘আমি ওই লেখায় একটা লাইন লিখেছি যেখানে প্রশ্ন তুলছি— কেন ভিড় থেকে এক জনও কেউ এগিয়ে আসেন না? আসলে মানুষের মনের মধ্যে ভয় ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে— ‘সোচ কে উঙ্গলি উঠানা, কাট রহি হ্যায় উঙ্গলিয়া।’

পেহলু খান, তবরেজ আনসারির ঘটনায় প্রশাসনের দোষীদের আড়াল করার চেষ্টা নবীনকে বিচলিত করে। কিন্তু তিনি মনে করেন এই প্রশাসনকে যারা ভোট দিয়ে এনেছে, দোষটা আসলে তাঁদেরই। ধর্মকে ভিত্তি করে যারা ভোট দেয়, তারাই আবার মানুষকে পিটিয়ে মারার সময়ে ভিড়ে মিশে যায়। নবীনের ওই কবিতা আসলে কোনও দল বা সরকারের বিরুদ্ধে নয়। নবীন মূলত ভিড়ের দিকেই প্রশ্নটা ছুড়ে দিয়েছেন।

কাটা আঙুলের জন্য ন্যায়বিচার চেয়ে যে ভিড়কে নবীন শব্দে ব্যাখ্যা করছেন এই ভাবে—‘ধর্ম না কোই জাত উনকি, ভিড় থি কুছ লোগ থে।’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Naveen Choubey Lynching Narendra Modi
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE