Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪

সোশ্যাল মিডিয়ায় দেশপ্রেম-ঝড়! চিন্তায় সমাজবিজ্ঞানীরা

সংশ্লিষ্ট সমাজবিদ এবং গবেষকেরা বলছেন, এক দিকে মানুষের মস্তিষ্কে ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে যুদ্ধ।

দেশভক্তি সোশ্যাল মিডিয়াতেই আটকে না থেকে বাইরে ছড়িয়ে পড়ায় সমস্যা আরও বেড়েছে বলেই মনে করা হচ্ছে।—ফাইল চিত্র।

দেশভক্তি সোশ্যাল মিডিয়াতেই আটকে না থেকে বাইরে ছড়িয়ে পড়ায় সমস্যা আরও বেড়েছে বলেই মনে করা হচ্ছে।—ফাইল চিত্র।

অগ্নি রায়
নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ০১:৪৫
Share: Save:

অতি ‘দেশভক্তি’ যারই লক্ষণ হোক না কেন, পুলওয়ামা কাণ্ডের পরে ফেসবুকে তা আছড়ে পড়া নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়েছে। বিষয়টি শুধু সোশ্যাল মিডিয়াতেই আটকে না থেকে বাইরে ছড়িয়ে পড়ায় সমস্যা আরও বেড়েছে বলেই মনে করা হচ্ছে।

সংশ্লিষ্ট সমাজবিদ এবং গবেষকেরা বলছেন, এক দিকে মানুষের মস্তিষ্কে ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে যুদ্ধ। প্রতিহিংসার মন্ত্র দিয়ে হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে অদৃশ্য মেশিনগান। অন্য দিকে, ন্যায়বিচার বদলে যাচ্ছে প্রতিহিংসায়। কখনও বাণিজ্যিক, কখনও রাজনৈতিক স্বার্থে বিক্রি করা হচ্ছে এই স্নায়বিক এবং মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ, বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে।

সমাজবিজ্ঞানী আশিস নন্দীর কথায়, ‘‘আড়াইশো বছর আগে স্যামুয়েল জনসন বলেছিলেন, দুবৃত্তদের শেষ ভরসা হল (উগ্র) দেশপ্রেম! এখন চারিদিকে যা পরিস্থিতি, তাতে ওই উক্তির বাস্তবতা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। আর এই ‘দেশপ্রেম’-এর আধুনিক রূপকার সোশ্যাল মিডিয়া।’’ তাঁর ব্যাখ্যায়, ‘‘সোশ্যাল মিডিয়া আর কিছুই নয়, মুনাফাখোর ট্রোলার। মানুষের চিন্তাকে নিয়ন্ত্রণ করছে নিজেদের বাণিজ্যিক স্বার্থে। তবে আমেরিকায় যেমন এখন বেশির ভাগ চ্যানেলের সংবাদকে আর সেখানকার মানুষ গুরুত্ব দেয় না, এখানেও তেমন এই সোশ্যাল মিডিয়ায় অভ্যস্ত হয়ে গেলে এর আগ্রাসন কমবে।’’ পাশাপাশি, পুলওয়ামা ঘটনার প্রসঙ্গে ঘৃণা ছড়ানো প্রসঙ্গে তাঁর বক্তব্য, ‘‘এখনও মানুষের মনের মধ্যে দেশভাগের ভূত ভর করে রয়েছে। পুরনো প্রজন্মের কাছে শোনা কাহিনিগুলি অদৃশ্য ভাবে অবচেতনে কাজ করে। সেটাকেই নানা ভাবে সুড়সুড়ি দেওয়া হয়।’’

ভার্জিনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের মনস্তত্ত্ব বিভাগের অধিকর্তা ভামিক ভলকান-এর তত্ত্ব অনুযায়ী, প্রত্যেকটি দেশ তাদের কোনও একটি বিপর্যয়কে ‘বেছে নেয়’। ভলকান একে বলছেন ‘চোজ়েন ট্রমা’। সে দেশের প্রজন্মের পর প্রজন্ম সেই বিপর্যয়টির সঙ্গে নিজেদের জাতিগতভাবে একাত্ম করে রাখে। সেই দুঃখ বা ক্ষত তার অবচেতনে গড়ে দেয় প্রতিশোধচেতনাও। ভারতীয় সমাজবিজ্ঞানীদের একটি অংশ মনে করেন, ভারতে দেশভাগই সেই ‘চোজ়েন ট্রমা’ যা উপন্যাস, গান, শ্রুতির মাধ্যমে প্রজন্মের পর প্রজন্মে বাহিত হয়ে চলেছে। এত বছর পরেও সেই স্মৃতি বদলায়নি। বরং স্মৃতিবাহিত হয়ে মানুষের মস্তিষ্কের বাম গোলার্ধকে (যা যুক্তি নিয়ন্ত্রণ করে) অকেজো করে, জাগিয়ে তোলে মস্তিষ্কের ডান গোলার্ধকে (যা নিয়ন্ত্রণ করে আবেগ, প্রতিহিংসা, ভয়, ঘৃণা)। মুসলিমদের প্রতি বদলার মনস্তত্ত্বের এটি অন্যতম কারণ বলে মনে করেন তাঁরা।

পশ্চিমবঙ্গ রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানের বিভাগীয় প্রধান ঋতু সেন চৌধুরীর মতে, ‘‘শান্তি এবং ন্যায়বিচারের তুলনায় দ্বেষ এবং প্রতিহিংসা বেশি বিক্রি হয়। ফলে এখন বহু ক্ষেত্রেই হিংসা ন্যায়বিচারের জায়গা নিচ্ছে। বিচারের জন্য চর্চা, নিজস্ব সময়, যুক্তি ও ধৈর্যের প্রয়োজন। কে আর অত সময় দেবে! বরং সহজ হল, আজ যারা শান্তির কথা বলছে, তাদের উপর গায়ের ঝাল মেটাও।’’ তাঁর কথায়, ‘‘এটাই এখন প্রশ্ন যে, পাওয়ার অব আ কমন ম্যান (‘আ ওয়েনেস ডে’ ছবির বিখ্যাত সংলাপ) আসলে ঠিক কী? তাকে তো এখন ফাসিস্ত যুক্তি দিয়ে ব্যাখ্যা করা হচ্ছে। শুধু পুলওয়ামা কাণ্ডই নয়, সমাজ জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রেই এই ফাসিস্তধর্মী অসহিষ্ণুতা বাড়ছে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Sociologist Patriotism Facebook Violence
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE