Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪
Foreigners Tribunal

এনআরসি-র ফের, শৈশব কেটে গেল কারাগারে

অসমে অনুপ্রবেশকারী বাছাই অভিযানে দিনমজুরের স্ত্রী মিনারা বেগমকে ‘বিদেশি’ তকমা দিয়ে ২০১০ সালের ১৪ মে পুলিশ যখন ধরে নিয়ে যায়, শাহানারা তখন ৭ মাসের।

মিনারা ও শাহানারা। ؅—নিজস্ব চিত্র।

মিনারা ও শাহানারা। ؅—নিজস্ব চিত্র।

উত্তম সাহা
শিলচর শেষ আপডেট: ১৫ জানুয়ারি ২০২১ ০৪:২২
Share: Save:

বারান্দায় একাই ছোটাছুটি করছিল বছর ১১-র কিশোরীটি। অপরিচিত তিন জনকে দেখে চোখেমুখে ভাবান্তর নেই। নেই ভয়ডরও। গারদের আড়ালেই যার শৈশব কেটে গিয়েছে, তার আবার ভয়!

শাহানারা বেগম তুমি? মাথা নাড়ল বালিকা। ১০ মাসে পৃথিবীকে নতুন করে দেখছে সে। স্কুলে যাতায়াতে এত দিন গাড়ি ছিল, থাকত কড়া পুলিশি পাহারা। এখন গাড়ি নেই, রক্ষীও নেই। “এ-ই ভাল, বন্ধুদের সঙ্গে কেমন গল্প করতে করতে হেঁটে যাই, ফিরিও হেঁটে,” খুশি ফুটে ওঠে চেহারায়। ঘাড় ছড়িয়ে নামা চুল যতটা পারে টেনে সামনে আনে। বলে, “বাইরে কার-না ভাল লাগে! বাবা, দাদা-দিদিকে কেমন সারা ক্ষণ পাচ্ছি!”

অসমে অনুপ্রবেশকারী বাছাই অভিযানে দিনমজুরের স্ত্রী মিনারা বেগমকে ‘বিদেশি’ তকমা দিয়ে ২০১০ সালের ১৪ মে পুলিশ যখন ধরে নিয়ে যায়, শাহানারা তখন ৭ মাসের। সবে বসতে শিখেছে। মায়ের দুধ ছাড়া কিছু খায় না। পুলিশের আপত্তি না-থাকায় তাকেও সঙ্গে নেন মিনারা। অসমের কাছাড় জেলার উধারবন্দের লাঠি গ্রামের বাড়ি থেকে গোয়ালপাড়ার ডিস্ট্রিক্ট জেলে। ছয় মাস পরে কোকরাঝাড়ে। কাগজকলমে ডিটেনশন ক্যাম্প, আসলে সে-ও এক জেল। সাড়ে আটটা বছর সেখানেই কাটে শাহানারার। আড়াই বছর বয়সে বাবাকে এক বার দেখেছিল। ছয় দিদির চার জনের বিয়ে হয়ে গিয়েছে, কারও চেহারাই দেখেনি। দাদাকেও দেখেনি কখনও। জেলে তাই তাদের চেহারা কল্পনা করে নিত। ২০১৯-র ১ জুন তাদের শিলচর সেন্ট্রাল জেলে পাঠানো হয়। এর পরে অবশ্য বাবার সঙ্গে দেখা হয়েছে কয়েক বার।

আরও পড়ুন: মানের ইস্তফায় প্রশ্নের মুখে কমিটির ভবিষ্যৎ

করোনা অনেকের কাছে সর্বনাশ হলেও মিনারা-শাহানারাদের কাছে যেন পৌষ মাস। সংশোধনাগারে ভিড় কমাতে দু’বছরের বেশি ডিটেনশন ক্যাম্পে থাকা বন্দিদের জামিনের নির্দেশ দেয় কোর্ট। ২২ এপ্রিল কার্যত গারদের বাইরের মুক্ত পৃথিবীটাকে প্রথম দেখে শাহানারা।

কী ভাবছিলে জেল থেকে বেরোনোর সময়? সপ্রতিভ কিশোরীর জবাব, “বাড়ি গিয়ে কখন দাদা-দিদিদের দেখব, যেন তর সইছিল না!” মিনারা বেগমের দাবি, শুধুমাত্র বাংলায় কথা বলার কারণে তাঁদের এই হেনস্থা। তিনি জানান, তাঁরা ভারতীয় পরিবার। কিন্তু দারিদ্র ও অশিক্ষার দরুন কোনও কাগজপত্র রাখার কথা কখনও ভাবেননি তাঁর বাবা, কায়ক্লেশে সংসার পালন করা দিনমজুর। তার পরে বিদেশি বলে পুলিশে মামলা হতেই মা আর দাদা ভয়ে গা-ঢাকা দেন। বিপাকে পড়েন মিনারা।

আরও পড়ুন: একরত্তির অঙ্গে প্রাণ বাঁচল পাঁচ জনের

জেলে অসমিয়া ভাষাটা ভালই শিখেছেন মিনারা। গোয়ালপাড়া কি কোকরাঝাড়, শুরুতে জেলে খুবই ভুগতে হয়েছে ভাষা নিয়ে। কারও কথা বোঝেন না, কাউকে কিছু বোঝাতেও পারেন না। এখন বাংলা বলতে গিয়ে ঢুকে পড়ে অসমিয়া শব্দ। শাহানারা তো কথাই শিখেছে অসমিয়া শুনে শুনে। পড়েছেও অসমিয়া মাধ্যমে। শিলচর জেলে বাংলা বর্ণপরিচয় হয়েছে তার।

শাহানারার নাগরিকত্বের সমস্যা নেই। তার জন্মের সংশাপত্র যত্ন করে রেখেছেন বাবা রহিমুদ্দিন বড়ভুঁইয়া। তাঁর নিজেরও ভারতীয় নাগরিকত্বের নথি আছে। মিনারা বলেন, “কোনও কারণে মার খেলে মেয়ে আমাকে দোষ দেয়। বলে, ভারতীয় হয়েও তোমার জন্য দশটা বছর জেল খাটলাম!” চোখের জল মুছে প্রশ্ন মিনারা বিবির— “কিন্তু আমারই বা অপরাধটা কী? কেন এ ভাবে চোরের মতো থাকতে হবে আমাকে?”

কোর্টের নির্দেশে জামিনের শর্ত হিসেবে এখন প্রতি বুধবার থানায় হাজিরা দিতে হয় তাঁকে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Foreigners Tribunal Assam NRC Detention Camp
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE