Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

দুই পরীক্ষায় ভিন্ন ফল, ম্যাগি-প্রশ্নে নয়া মোড়

সিসা-আজিনামোতো বিতর্কে ইতিমধ্যেই বাজারে নিষিদ্ধ হয়েছে ‘২ মিনিটের ম্যাজিক’! ভারতের বাজার থেকে ‘ম্যাগি’ তুলে নিয়েছে নির্মাতা সংস্থা নেসলেও। কিন্তু পণ্য তুলে নেওয়ার আগে তারা তৈরি করেছে আর এক বিতর্ক। কী সেই বিতর্ক? কেন্দ্রীয় খাদ্য পরীক্ষাগার (সেন্ট্রাল ফুড ল্যাবরেটরি বা সিএফএল) জানিয়েছিল, ম্যাগি নুডলসে মাত্রাতিরিক্ত পরিমাণে সিসা ও আজিনামোতো (মনোসোডিয়াম গ্লুটামেট) রয়েছে। কিন্তু একটি বেসরকারি পরীক্ষাগার থেকে ওই নুডলসের পরীক্ষা করিয়ে নেসলে দাবি করেছে, ম্যাগিতে মাত্রাতিরিক্ত ক্ষতিকারক রাসায়নিক নেই।

নিজস্ব সংবাদদাতা
কলকাতা শেষ আপডেট: ০৭ জুন ২০১৫ ০৩:৪৩
Share: Save:

সিসা-আজিনামোতো বিতর্কে ইতিমধ্যেই বাজারে নিষিদ্ধ হয়েছে ‘২ মিনিটের ম্যাজিক’! ভারতের বাজার থেকে ‘ম্যাগি’ তুলে নিয়েছে নির্মাতা সংস্থা নেসলেও। কিন্তু পণ্য তুলে নেওয়ার আগে তারা তৈরি করেছে আর এক বিতর্ক।

কী সেই বিতর্ক?

কেন্দ্রীয় খাদ্য পরীক্ষাগার (সেন্ট্রাল ফুড ল্যাবরেটরি বা সিএফএল) জানিয়েছিল, ম্যাগি নুডলসে মাত্রাতিরিক্ত পরিমাণে সিসা ও আজিনামোতো (মনোসোডিয়াম গ্লুটামেট) রয়েছে। কিন্তু একটি বেসরকারি পরীক্ষাগার থেকে ওই নুডলসের পরীক্ষা করিয়ে নেসলে দাবি করেছে, ম্যাগিতে মাত্রাতিরিক্ত ক্ষতিকারক রাসায়নিক নেই।

দু’টি পরীক্ষাগারের এই উল্টো রিপোর্টের ফলেই নতুন করে তৈরি হয়েছে বিতর্ক। এবং ঘটনাচক্রে তার সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছে পশ্চিমবঙ্গ-ও! কারণ, কেন্দ্রীয় খাদ্য পরীক্ষাগার এবং ওই বেসরকারি ল্যাবরেটরি, দু’টোই এ রাজ্যের।

প্রশ্ন উঠছে সরকারি পরীক্ষাগারের গুণগত মান নিয়ে। বিশেষজ্ঞদের অনেকেই বলছেন, সিএফএল দেশের অন্যতম প্রাচীন ল্যাবরেটরি। কিন্তু সেখানে উন্নত প্রযুক্তির যন্ত্রপাতি কতটা রয়েছে, তা নিয়ে সন্দেহ থেকে যায়। বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশে মোট পাঁচটি কেন্দ্রীয় পরীক্ষাগার আছে। ৬৮টি রাজ্যস্তরের পরীক্ষাগার রয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রের খবর, অধিকাংশ পরীক্ষাগারেই উন্নত পরিকাঠামো নেই। দক্ষ কর্মীরও অভাব রয়েছে। কলকাতার কেন্দ্রীয় পরীক্ষাগারের কর্মীদের দাবি, খাদ্যে কীটনাশক ও ধাতুর মাত্রা পরীক্ষা করার বিভাগ প্রায় অকেজো হয়ে পড়ে রয়েছে। অধিকাংশ পদই খালি। ফলে
কাজের মান যে মার খাচ্ছে তা জানান কর্মীদের একাংশই।

ফুড টেকনোলজি বিষয়ের সঙ্গে যুক্ত একাংশ জানাচ্ছেন, পরীক্ষার পদ্ধতি ও যন্ত্রপাতির জন্য রিপোর্টের রকমফের হতে পারে। তাঁদের বক্তব্য, সিসার পরিমাণ যাচাই করার জন্য প্রয়োজন মাইক্রোওয়েভ ডাইজেশন যন্ত্র। ৩০ লক্ষ টাকা দামের এই যন্ত্র হাতেগোনা কয়েকটি পরীক্ষাগারে রয়েছে। সিএফএল কর্মীদের একাংশ বলছেন, এই পরীক্ষাগারে মাইক্রোওয়েভ ডাইজেশন যন্ত্রের বদলে গ্রাইন্ডিং ইন সিলিকা ক্রুসিবল যন্ত্র ব্যবহার করা হয়। তার ফলে সিসার সঠিক মাত্রা না-ও ধরা পড়তে পারে বলে বিশেষজ্ঞদের একাংশের অভিমত।

একই ভাবে নাইট্রিক অ্যাসিড ও জলের মানের উপর নির্ভর করে পরীক্ষার ফল। বাজারে সাধারণ গোত্রের নাইট্রিক অ্যাসিডে অনেক সময় সিসা থাকে। আবার সিসামুক্ত নাইট্রিক অ্যাসিডও মেলে। কিন্তু সেই নাইট্রিক অ্যাসিডের ৫০০ মিলিলিটারের দাম ৫০০ টাকা। সাধারণ নাইট্রিক অ্যাসিড অর্ধেক দামে মেলে বলেই খবর। পরীক্ষাগারে কতটা বিশুদ্ধ জল ব্যবহার করা হচ্ছে, তার উপরও রিপোর্ট নির্ভর করে। ফুড টেকনোলজির এক শিক্ষক বলেন, ‘‘অতি-বিশুদ্ধ বা আল্ট্রা-পিওর জল ব্যবহারই উন্নত প্রযুক্তির লক্ষণ।’’

এই সব পদ্ধতি কি সিএফএল-এ মেনে চলা হয়? এ ব্যাপারে পরীক্ষাগারের অধিকর্তা অমিতাভ অধিকারীর প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়নি। তিনি মুখোমুখি দেখা করেননি। ফোনেও কথা বলতে চাননি।

সিএফএল-এর এমন দশা হলেও নেসলের পক্ষে রিপোর্ট দেওয়া ‘এডওয়ার্ড ফুড রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালিসিস সেন্টার লিমিটেড’ (ইএফআরএসি) নামে বারাসতের ওই গবেষণাগার অনেক বেশি উন্নত বলেই দাবি করেছেন তাঁরা। ওই ল্যাবরেটরি সূত্রের খবর, ৩৫ কোটি টাকা ব্যয়ে গড়ে তোলা ল্যাবরেটরিটি ভারতের খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ন্ত্রক সংস্থা ‘ফুড সেফটি অ্যান্ড স্ট্যান্ডার্ডস অথরিটি অব ইন্ডিয়া’ (এফএসএসআই) ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের খাদ্য নিয়ন্ত্রক সংস্থা ‘ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিসট্রেশন’ (এফডিএ), দু’টোরই অনুমোদন পেয়েছে।

গত পনেরো দিনে ম্যাগির ৮০০ প্যাকেট নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে দাবি করে ইএফআরএসি-র অধিকর্তা বলবিন্দর বাজওয়ার বলেন, ‘‘ওই নমুনায় নির্ধারিত মাত্রার অনেক কম পরিমাণ সিসা রয়েছে। অন্যান্য রিপোর্ট ভিন্ন আসার কারণ রয়েছে। কোন পদ্ধতিতে পরীক্ষা করা হচ্ছে, রিপোর্ট তৈরির ক্ষেত্রে তা জরুরি।’’

তবে উন্নত প্রযুক্তি না থাকলেই যে ম্যাগির পরীক্ষায় গলদ রয়েছে, তা মেনে নিতে নারাজ অনেকে। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ফুড টেকনোলজি বিভাগের শিক্ষক দীপঙ্কর হালদার বলছেন, খাদ্য পরীক্ষার ক্ষেত্রে কিছু ন্যূনতম যন্ত্রপাতি প্রয়োজন হয়। সেগুলি সিএফএল-এর নেই, এমনটা ভেবে নেওয়া উচিত নয়। তা ছাড়া, সরকারি পরীক্ষাগারে যে বিজ্ঞানীরা কাজ করেন, তাঁরাও এই ধরনের কাজে যথেষ্ট দক্ষ। দীপঙ্করবাবুর কথায়, ‘‘উন্নত যন্ত্রপাতি না থাকলে রিপোর্ট উনিশ-বিশ হতে পারে। কিন্তু একেবারে উল্টো রিপোর্ট বেরবে, এমনটা হতে পারে না।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE