ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়কে কাছে টানতেই কি ২৬ বছর পর অযোধ্যায় পদার্পণ গাঁধী পরিবারের কোনও প্রতিনিধির? রাজনৈতিক জল্পনা তেমনই।
দীর্ঘ ২৭ বছর ধরে শুধুই অসাফল্য। একের পর এক নির্বাচনে হার, ভোটব্যাঙ্কে শোচনীয় ধস। জনভিত্তি ক্ষইতে ক্ষইতে দলের দুর্গ শুধুমাত্র গাঁধী পরিবারের গড় অমেঠি-রায়বরেলীতে সীমাবদ্ধ এখন। কিন্তু এ বার মরিয়া ল়ড়াইয়ে গাঁধী পরিবার। গো-বলয়ের হৃদয়পুরে দলের জনভিত্তি পুনরুদ্ধারের লক্ষ্য নিয়ে ছুটতে শুরু করে দিয়েছেন গাঁধীরা। সে যাত্রাপথের প্রথম স্টপেজ বারাণসী হলে দ্বিতীয়টা ছিল দেওরিয়া। শুক্রবার সেই ‘পুনরুত্থান’ যাত্রা যে স্টপেজে পৌঁছল, সেই তৃতীয় স্টপেজ উত্তরপ্রদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের পাতায় ছোটখাটো একটা জায়গা পেয়ে যাবেই। কারণ ২৬ বছর পর অযোধ্যার মাটিতে পা রাখলেন কোনও গাঁধী। বাবরি ধ্বংসের পর এই প্রথম।
কংগ্রেস সহ-সভাপতি রাহুল গাঁধী শুক্রবার অযোধ্যায় পা রাখার পর থেকেই উত্তরপ্রদেশের রাজনৈতিক স্নায়ু আরও কিছুটা টানটান। ঘটনাপ্রবাহের কেন্দ্রবিন্দুতে যেহেতু অযোধ্যা, সেহেতু প্রতিক্রিয়ায় সংযত সব পক্ষই। কিন্তু আপাত-সংযমের আড়ালে রাজনৈতিক টানাপড়েনটা যে বেশ ঘনিয়ে উঠেছে, তা বেশ স্পষ্ট। রাহুলের সফর ঘিরে কটাক্ষ, উষ্মা, রাজনৈতিক খোঁচা ইতিউতি ছিটকে আসছে খাস অযোধ্যার মাটিতেই। অযোধ্যায় পৌঁছে প্রথমেই এ দিন হনুমানগড়ি মন্দিরে পুজো দিয়েছেন রাহুল। তার পর প্রধান পুরোহিত মহন্ত জ্ঞানদাসের সঙ্গে দেখা করে আশীর্বাদ চেয়ে নিয়েছেন। অমেঠির সাংসদ বেরিয়ে যাওয়ার পর মহন্ত বলেছেন, ‘‘রাহুল এসেছিলেন এবং আশীর্বাদ চাইলেন। আমি তাঁকে বলেছি, সাধু-সন্তদের কোনও জাত-ধর্ম হয় না, তিনি সব সময়েই আমাদের এখানে স্বাগত।’’ কিন্তু বিজেপির রাজনৈতিক উত্থানের ধাত্রীভূমি তথা ‘রামজন্মভূমি’তে কংগ্রেস সহ-সভাপতিকে এমন উদার ভঙ্গিতে স্বাগত জানানো যে অনেকেই মেনে নিতে পারছেন না, তা হনুমানগড়ি মন্দিরের বাইরে ফুলের পসরা সাজিয়ে বসে থাকা প্রাণনাথ সাইনির সঙ্গে কথা বললেই স্পষ্ট হয়। ৩০ বছর ধরে ওইখানেই ফুল বেচছেন সাইনি। রাহুলের সফর নিয়ে বেশি উচ্ছ্বাস দেখাতে নারাজ তিনি। বেশ গজগজ করতে করতেই বলছেন, ‘‘এ সবই রাজনীতি। গত ২৬ বছর ধরে গাঁধী পরিবারের কেউ এখানে পা রাখেননি কেন?’’ হনুমানগড়ির ফুল বিক্রেতার ভবিষ্যদ্বাণী, এ সব করে কোনও লাভ হবে না কংগ্রেসের।
হনুমানগড়ি মন্দিরে মহন্ত জ্ঞানদাসের সঙ্গে রাহুল গাঁধী। শুক্রবার।
রাহুলের এই অযোধ্যা সফর হঠাৎ করে উস্কে দিয়েছে ইতিহাসও। অযোধ্যা-ফৈজাবাদের আনাচে-কানাচে শুক্রবার যা কিছু রাজনৈতিক আলোচনা চলছে, তার অনেকটা জুড়েই চর্চায় ১৯৯০ সালের একটা দিন। সে দিন অযোধ্যা সফরে গিয়েছিলেন রাহুলের বাবা রাজীব গাঁধী। হনুমানগড়ি মন্দিরে পুজো দেওয়ার কথা ছিল তাঁরও। কিন্তু রাজনৈতিক কর্মসূচিতে এতটা সময় বেরিয়ে গিয়েছিল যে সে দিন আর পুজো দেওয়া হয়নি রাজীবের। তার পরের বছরই রাজীব গাঁধীকে বিস্ফোরণে হত্যা করা হয়। হনুমানগড়িতে পুজো দেওয়ার ইচ্ছা আর পূরণ হয়নি।
রাজীব হত্যাকাণ্ডে বেসামাল হয়ে পড়া সত্ত্বেও সহানুভূতির হাওয়ায় ভর করে ১৯৯১-তে কংগ্রেসই দেশের ক্ষমতায় ফেরে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী পদে পি ভি নরসিংহ রাও-এর অভিষেকের এক বছর কাটতে না কাটতেই অযোধ্যায় মাটিতে মিশে যায় বাবরি মসজিদ। বাবরি ধ্বংসের মূল অভিযুক্ত সঙ্ঘ পরিবার তথা বিজেপি হলেও, কংগ্রেসকেও দোষের ভাগীদার হতে হয়েছিল। নরসিংহ রাও কঠোর মনোভাব নেননি বলেই অযোধ্যায় বাবরি ভাঙতে পেরেছিল সঙ্ঘ পরিবার, অভিযোগ করেছিল অকংগ্রেসি-অবিজেপি শক্তিগুলি। সে অভিযোগ সংখ্যালঘু মানসে যথেষ্ট দাগও কেটেছিল। অতএব স্পর্শকাতর অযোধ্যায় আর পা রাখেননি কোনও গাঁধী। মাত্র ৭ কিলোমিটার দূরে ফৈজাবাদে একাধিবার সভা করে এসেছেন সনিয়া গাঁধী। অযোধ্যা যাননি।
অযোধ্যায় রোড শো কংগ্রেস সহ-সভাপতির। শুক্রবার।
রাহুল অযোধ্যায় গেলেন। তবে তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে বিতর্কিত রাম মন্দির তথা বাবরি মসজিদ চত্বর মাড়ালেন না। হনুমানগড়িতে পুজো দিয়ে এবং ছোটখাট রোড-শো সেরে তিনি সোজা চলে গেলেন ফৈজাবাদ। সেখানেও রোড শো করলেন।
আরও পড়ুন: লুঠ রুখে রাহুলের সওয়াল,‘চুরি নয়’
রাজনৈতিক শিবির বলছে, উত্তরপ্রদেশের লড়াইয়ে কংগ্রেসের ওয়ার-রুম ম্যানেজার যিনি, সেই প্রশান্ত কিশোরই নাকি ছকে দিয়েছেন এই সফরসূচি। নরম হিন্দুত্বের বার্তা দিতেই নাকি ‘অযোধ্যায় আছি, রামজন্মভূমিতে নেই’ নীতি কংগ্রেসের। গো-বলয়ের হৃদয়পুরে যে ব্রাহ্মণ, সংখ্যালঘু আর ওবিসি সম্প্রদায়ের মধ্যে দলের সমর্থনভিত্তি ছিল সবচেয়ে মজবুত, সেই অংশকেই আবার কাছে টানতে মরিয়া গাঁধী পরিবার। রাজ্যে সংখ্যালঘুদের সবচেয়ে ভরসার পাত্র ছিলেন যে মুলায়ম সিংহ যাদব, তাঁর দল সমাজবাদী পার্টির গত পাঁচ বছরের শাসনকালে উত্তরপ্রদেশে মোটেই নিরাপদ বোধ করেননি সংখ্যালঘুরা। অনেকগুলি দাঙ্গা হয়ে গিয়েছে রাজ্যজুড়ে। দাদরির মতো ঘটনাও ঘটেছে। সংখ্যালঘু মানসে এখন তাই মুলায়ম-অখিলেশের উপর ভরসা অনেকটাই কম। কংগ্রেস নেতৃত্ব ভালই জানেন, এই পরিস্থিতিতে উত্তরপ্রদেশে সংখ্যালঘুর স্বাভাবিক পছন্দ হয়ে উঠতে পারে হাত চিহ্নই। এর সঙ্গে ব্রাহ্মণ আর ওবিসি-দের কাছে পাওয়া গেলেই ঘুরে দাঁড়ানোর সম্ভাবনা প্রবল। ওই দুই সম্প্রদায়কে কাছে টানতে তাই উত্তরপ্রদেশে এখন নরম হিন্দুত্বের পথে কংগ্রেস। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, সেই পথে (নরম হিন্দুত্ব) হাঁটলেন বলেই কোনও এক গাঁধী ২৬ বছর পর পৌঁছতে পারলেন অযোধ্যায়। সেই পথে হাঁটলেন বলেই, রাজীব গাঁধীর অপূর্ণ ইচ্ছা পূরণ করে পুত্র রাহুল পুজো দিতে পারলেন হনুমানগড়ি মন্দিরে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy