Advertisement
২৪ এপ্রিল ২০২৪

‘হঠাৎই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে খুনের ছক কষে ফেলল মা?’

সোমা সেনের মেয়ে কোয়েলের প্রশ্ন, “নাগপুরের সবাই তো মাকে চেনে। হঠাৎ আমার মা মাওবাদী হয়ে গেল? হঠাৎই মা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে খুনের ছক কষে ফেলল?”

সোমা সেন। নিজস্ব চিত্র

সোমা সেন। নিজস্ব চিত্র

প্রেমাংশু চৌধুরী
নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ২৫ জুন ২০১৮ ০৪:১৪
Share: Save:

গোটা নাগপুর এক ডাকে চেনে বাঙালি অধ্যাপিকাকে। কারণ সোমা সেন শুধু ইংরেজি পড়িয়েই বসে থাকতেন না। জুনি মগলওয়াড়ির বস্তিতে ঘুরে বেড়াতেন। কোন মহিলাকে তাঁর স্বামী নেশা করে পেটাচ্ছে। কার বাপের বাড়ি থেকে পণ দিতে পারেনি বলে শ্বশুরবাড়ির লোকেরা নির্যাতন করছে। দলিত বলে কাকে অত্যাচারিত হতে হচ্ছে সে সব খোঁজ নিয়ে রুখে দাঁড়াতেন। কাউকে নিজেই বাড়িতে এনে তুলতেন। আশ্রয়ের খোঁজে কেউ নিজেই তাঁর বাড়িতে চলে আসত।

সোমা সেনের মেয়ে কোয়েলের প্রশ্ন, “নাগপুরের সবাই তো মাকে চেনে। হঠাৎ আমার মা মাওবাদী হয়ে গেল? হঠাৎই মা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে খুনের ছক কষে ফেলল?”

নাগপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজির বিভাগীয় প্রধান সোমা সেনের বিরুদ্ধে এই অভিযোগই এনেছে মহারাষ্ট্র পুলিশ।

আগামী ১ অগস্ট ষাট বছরে পা দেবেন। ৩১ জুলাই তাঁর অবসর নেওয়ার কথা ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকর্মী, ছাত্রছাত্রীরা তাঁর বিদায় সংবর্ধনার আয়োজন করেছিলেন। তার আগেই, ৬ জুন নানা শহর থেকে সোমাদেবী-সহ পাঁচ জনকে গ্রেফতার করা হল। বাকিরাও বিভিন্ন সামাজিক কাজকর্মেই যুক্ত। প্রথমে পুলিশের অভিযোগ ছিল, ওই পাঁচ জন ভীমা কোরেগাঁওয়ে দলিতদের অনুষ্ঠান ঘিরে হিংসায় যুক্ত। তাঁদের পিছনে মাওবাদীদের মদত ছিল।

মোদী জমানায় দলিতদের উপর নির্যাতনের প্রতিবাদে ভীমা কোরেগাঁওয়ে পেশোয়াদের বিরুদ্ধে দলিতদের যুদ্ধ জয়ের ২০০ বছর উদ্‌যাপন হয়েছিল। জিগ্নেশ মেবানী, রোহিত ভেমুলার মায়ের মতো গোটা দেশের প্রতিবাদী দলিত মুখেরা সেখানে হাজির হন।

পরে বিজেপি-শাসিত মহারাষ্ট্রের পুলিশ অভিযোগ আনে, সোমারা রাজীব গাঁধী-হত্যার মতো প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে খুনের ছক কষছিলেন। পুলিশি অভিযানে উদ্ধার চিঠিতে ‘কমরেড সোমা’-কে মাওবাদীদের অর্থ জোগান দেওয়ার কথাও রয়েছে। ভারতীয় দণ্ডবিধির নানা ধারার সঙ্গে কঠোর ইউএপিএ-তে মামলা হয়েছে সোমাদের বিরুদ্ধে।

মুম্বই থেকে ফোনে কোয়েল বলেন, “সবটাই মিথ্যে আর বানানো। পুরোপুরি জরুরি অবস্থা চলছে।”

ইদানীং বাতের ব্যথাটা বেশিই ভোগাচ্ছিল সোমাদেবীকে। হাঁটু মুড়ে মাটিতে বসতে পারতেন না। গ্লকোমার জন্য রাতে দেখতেও অসুবিধা হত। এক মাত্র মেয়ে মুম্বইয়ে থাকেন। সিনেমা তৈরি করেন। অবসরের দিনটায় মেয়েকে নাগপুরে আসতে বলেছিলেন। কোয়েল বলেন, “মায়ের জন্মদিনটা এ বার পালন করার কথা ভাবছিলাম। হঠাৎ এক দিন সকালে শুনলাম, মাকে পুলিশ গ্রেফতার করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ও সাসপেন্ড করেছে তাঁকে।”

প্রথমে ১৫ দিন পুলিশি হেফাজতে রেখে জেরা করা হয় সোমাদেবীকে। কোয়েল বলেন, “বাতের ব্যথা নিয়েই মাটিতে শুতে হয়েছে। সপ্তাহে মাত্র এক বার আমাদের দেখা করতে দিয়েছে।” ২১ জুন আদালত সোমাদের ৪ জুলাই পর্যন্ত জেল হেফাজতের নির্দেশ দেয়। এখন তিনি পুণের ইয়েরওয়াড়া জেলে।

সোমাদেবীর পূর্বপুরুষরা আদতে ময়মনসিংহের মানুষ। ছোটবেলা কেটেছে মুম্বইয়ের বান্দ্রায়। কিন্তু মুম্বইয়ে থেকে দলিত, গরিব, পিছিয়ে পড়া মানুষের জন্য কাজ করার সুযোগ কম বুঝেই নাগপুরে চলে যান সোমা। বিয়ের পর সাড়ে তিন দশক সেখানেই কাটিয়েছেন।

পুলিশের অভিযোগ, সোমার স্বামী তুষারকান্তি ভট্টাচার্য সিপিআই (মাওবাদী)-র কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিলেন। ২০০৭-এ গ্রেফতারও হয়েছিলেন তিনি। গত বছরও তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। নাগপুর থেকে ফোনে তুষারকান্তি বলেন, “দু’বারই পুলিশ কিছু প্রমাণ করতে পারেনি। আমি বৈপ্লবিক মতাদর্শে বিশ্বাস করি। কিন্তু সেটা তো কোনও আইনি অপরাধ নয়! আমার স্ত্রীর কী দোষ?”

বাষট্টি বছরের তুষারকান্তির আশঙ্কা, পুলিশ যে কোনও দিন ফের তাঁকে গ্রেফতার করবে। তাঁর যুক্তি, “ওঁরা কম্পিউটারের হার্ড ডিস্ক নিয়ে গিয়েছে। আমি মাওবাদীদের জাতপাত সম্পর্কে চিন্তাভাবনা নিয়ে লিখছিলাম। সেই সংক্রান্ত অনেক নথি ছিল। সোমাকে যদি মিথ্যে চিঠির ভিত্তিতে গ্রেফতার করতে পারে, ওই সব নথির ভিত্তিতে আমাকে তো গ্রেফতার করা আরও সহজ।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE