পাঁচ রাজ্যে ভোটের ফল জানতে এখনও দেড় সপ্তাহ বাকি। বিভিন্ন সূত্রে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ও দলের সভাপতি অমিত শাহের কাছে যে সব তথ্য ও বার্তা এসে পৌঁছেছে তাতে এখনই বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্বের কাছে একটি বিষয় স্পষ্ট। তা হল, এই ভোটে বিজেপির চেয়ে মোদী-বিরোধী শক্তির লাভ তোলার সম্ভাবনা বেশি।
বিজেপির শীর্ষনেতারা আঁচ পাচ্ছেন, পশ্চিমবঙ্গে কংগ্রেস-সিপিএমের মমতা-বিরোধী জোট যে ফলই করুক, আগামীতে কেন্দ্রে তাদের জোটবদ্ধ বিজেপি-বিরোধিতার সুর চড়বে। এ ব্যাপারে রাজ্যে এক সঙ্গে চলার কৌশল ও অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগাতে চাইবেন বাম ও কংগ্রেসের নেতারা। চাইবেন মোদী-বিরোধী মঞ্চের পরিসরটি আরও বড় করতে। মোদী, অমিত শাহরা বুঝতে পারছেন, পাঁচ রাজ্যের ভোট-পর্ব মিটতেই ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনকে সামনে রেখে মোদী-বিরোধী মঞ্চ গড়ার চেষ্টা জোর পাবে। সেই চেষ্টা ভেস্তে দেওয়ার লক্ষ্যে এখন থেকেই পাঁচ রাজ্যের জমি মেপে দেখার কাজে নেমেছে বিজেপি।
তাতেই উঠে আসছে পশ্চিমবঙ্গের বিরোধী জোটের প্রসঙ্গ। বাংলায় কারা সরকার গড়বে তা নিয়ে কোনও ভবিষ্যৎবাণী না করলেও অরুণ জেটলি, রাজনাথ সিংহ থেকে শুরু করে পীযূষ গয়াল বা নিতিন গডকড়ীর মতো নেতারা মনে করছেন, জোট গড়ার কৌশলই সিপিএম ও কংগ্রেসের পক্ষে সবচেয়ে লাভজনক পরিস্থিতি তৈরি করেছে। জেটলির কথায়, ‘‘২০১১-তে রাজ্য জুড়ে সিপিএম হঠাও পরিস্থিতি ছিল। এ বারে সেটা মমতা হঠাও স্লোগানে পরিণত হয়েছে। তখন বিরোধী নেত্রী হিসেবে মমতার জনপ্রিয়তা ছিল তুঙ্গে। সে সময় জোট ছিল কংগ্রেস ও মমতার। চলতি নির্বাচনে আমি নিজে হাওড়ায় সভা করতে গিয়ে দেখেছি বিজেপি কর্মীরা সিপিএম-বিরোধী বক্তব্যের চেয়ে মমতা-বিরোধী বক্তব্যেই বেশি হাততালি দিচ্ছেন।’’
এতে বিজেপির লাভ কতটা?
অরুণ-রাজনাথদের বক্তব্য, বাংলার বর্তমান রাজনৈতিক আবহে বিজেপি শতকরা ভোট ও আসন কতটা বাড়াতে পারে— রাজ্য স্তরে সেটাই হবে দলের প্রাপ্তি। এই রাজ্যের দায়িত্বপ্রাপ্ত বিজেপি নেতা সিদ্ধার্থনাথ সিংহ কলকাতা থেকে ফিরে প্রধানমন্ত্রী ও অমিত শাহকে রিপোর্ট দিয়েছেন যে, বাংলায় যারাই সরকার গড়ুক, বিজেপির আসনসংখ্যা কম হবে না। গত বিধানসভায় যা ছিল ১।
তামিলনাড়ুতে জয়ললিতার সামনে লড়াইটা কঠিন। পীযূষ গয়াল তামিলনাড়ু থেকে ফিরে রিপোর্ট দিয়েছেন, এডিএমকে নেত্রী কোনও ভাবে ক্ষমতায় টিকে গেলেও ডিএমকে-কংগ্রেস বড় রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হিসেবে মাথা চাড়া দেবে। আর কেরলে কংগ্রেসই থাক বা সিপিএম ফিরুক, বিজেপির কাছে দুই-ই এক। হাতে রইল শুধু অসম। এই রাজ্যে বিজেপি সরকার গড়তে না পারলে মোদী-বিরোধী রাজনীতি জাতীয় প্রেক্ষাপটে আরও উত্তাল হয়ে উঠবে।
বিজেপি সভাপতি বলছেন, পাঁচটি রাজ্যই হিন্দি বলয়ের বাইরে। এবং এর সব ক’টিই তাঁদের অগ্রাধিকারের রাজ্য নয়। অমিতের বিশ্লেষণ, বাংলার ভোটে এক সঙ্গে চলার অভিজ্ঞতা জাতীয় স্তরেও কাজে লাগাতে চাইবে কংগ্রেস ও বামেরা। কারণ কংগ্রেস-কমিউনিস্ট জাতীয় রাজনীতিতে বিজেপি-বিরোধী মিত্র শক্তি। একমাত্র অসমেই বিজেপির খানিকটা আশা রয়েছে। এ ক্ষেত্রেও কংগ্রেসের বাড়তি সুবিধে হল, ভোটের পর মুসলিম নেতা বদরুদ্দিন আজমলের দল এআইইউডিএফ-এর সঙ্গে জোট বাঁধতে তাদের বাধা নেই। অন্য দিকে আরএসএসের স্পষ্ট নির্দেশ, বদরুদ্দিন চাইলেও ভোটের পর বিজেপি যেন মুসলিম গোষ্ঠীর সঙ্গে মিলে সরকার গড়ার চেষ্টা না করে। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহ বলেন, ‘‘কাশ্মীরে অখণ্ড ভারত রক্ষার স্বার্থে মুফতি সরকারে সামিল হওয়া আর বদরুউদ্দিনের সঙ্গে জোট বাঁধা এক বিষয় নয়।’’ অসমে বাংলাদেশি অনুপ্রবেশ বড় সমস্যা। সেখানে বদরুদ্দিনের সঙ্গে হাত মেলানো বিজেপির পক্ষে হারাকিরি হবে বলে মনে করে সঙ্ঘ পরিবার।
ফলে কোনও রাজ্যই তেমন স্বস্তিতে রাখছে না বিজেপিকে। বরং আগামীতে কংগ্রেসের নেতৃত্বে মোদী-বিরোধী রাজনীতির ঝড় ওঠার আশঙ্কাতেই ১৯মে-র বেশ আগে, ১৩ তারিখই সংসদ অধিবেশন শেষ করে দেওয়া হচ্ছে। এর মধ্যে এক দিন রাজ্যসভায় আচমকাই পিছন থেকে এসে সীতারাম ইয়েচুরিকে জড়িয়ে ধরেছিলেন প্রধানমন্ত্রী। পরিবেশটা খানিকটা সহজ করতে। সীতারাম তখনই তাঁর কাছে আবেদন জানান, সংসদ আরও কয়েকটা দিন বেশি চলতে দিন। প্রধানমন্ত্রী সংসদীয় মন্ত্রী বেঙ্কাইয়া নায়ডুকে বিষয়টি দেখতে বলেন। যদিও শেষ পর্যন্ত সরকার ওই প্রস্তাবে রাজি হয়নি।
বিরোধিতার ঝড় রুখতে মোদীর রণকৌশল হল, অগুস্তাওয়েস্টল্যান্ড হেলিকপ্টার ঘুষ-কাণ্ড নিয়ে আরও আক্রমণাত্মক হওয়া। বিজেপি নেতা সুব্রহ্মণ্যম স্বামীকে সামনে রেখে দুর্নীতির প্রশ্নে সরাসরি সনিয়া গাঁধী ও রাহুল গাঁধীকে আক্রমণ করা। সঙ্ঘ ও দলের অন্য নেতাদের মতো মোদী নিজেও সরব এ নিয়ে। জেটলি বলছেন, ‘‘বিষয়টি নিয়ে তদন্ত চলছে। ইতালির আদালতের কাছ থেকে কিছু তথ্য ও কাগজপত্র পাওয়া গিয়েছে।’’ মোদী-অমিত শাহের রাজনৈতিক লক্ষ্য একটাই। তা হল দুর্নীতির প্রসঙ্গ তুলে অ-কংগ্রেসি দলগুলির কাছে সনিয়া-রাহুলদের ‘অস্পৃশ্য’ করে তোলা। যাতে মায়াবতী, নীতীশ কুমার, জয়ললিতা, মমতা, নবীন পট্টনায়ক, চন্দ্রবাবু নায়ডু, কে চন্দ্রশেখর রাও, এইচ ডি দেবগৌড়া, ফারুক আবদুল্লা— কেউই কংগ্রেসের পাশে না দাঁড়াতে পারেন।
কিন্তু এই চেষ্টায় বিজেপি আদৌ কতটা সফল হবে, প্রশ্ন রয়েছে তা নিয়েও। নীতীশ-লালুপ্রসাদ, বাম-কংগ্রেস আগামী বাদল অধিবেশনে মোদী-বিরোধী রাজনীতির মহড়া শুরু করে দিয়েছেন এখন থেকেই। মোদী-বিরোধী এই মঞ্চে কংগ্রেস-সিপিএম থাকায় মমতার পক্ষে তাতে সরাসরি সামিল হওয়া সম্ভব নয়। মমতার পক্ষে এনডিএ-তে যোগ দেওয়াও আর সম্ভব নয় বলে মনে করেন বিজেপি নেতারা। তা ছাড়া, মোদীর সনিয়া-বিরোধী অভিযানে অরুণ শৌরির মতো অনেক বিজেপি নেতাই জল ঢেলে দিয়েছেন, বিষয়টিকে পর্বতের মূষিক প্রসব অ্যাখ্যা দিয়ে।
কংগ্রেস মনে করছে, তাদের একঘরে করার চেষ্টা ব্যুমেরাং হবে বিজেপির। জয়রাম রমেশের যুক্তি, ‘‘কংগ্রেসকে একঘরে করতে গিয়ে বিজেপিই বিরোধীদের ঐক্যবদ্ধ করার কাজটি করে দিচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গে জোট গঠন লোকসভা নির্বাচনের আগে সেই প্রক্রিয়াকেই আরও তরান্বিত করল।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy