জমি বিল নিয়ে হিমশিম খাচ্ছে বিজেপি। তার মধ্যেই দলের জমি হারানো নিয়ে বিজেপি সভাপতি অমিত শাহকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাল সঙ্ঘ। সঙ্ঘের সতর্কবাণীর পর দলের জমি ফিরে পেতে তৎপর হলেন বিজেপি সভাপতি। এবং পরিস্থিতি মোকাবিলায় আজ পাঁচ দফা কর্মসূচিও ঘোষণা করেছেন তিনি।
গত কিছু দিন ধরেই নরেন্দ্র মোদী ও তাঁর সরকারের তরফে একটা বার্তা দেওয়া হচ্ছিল যে, সঙ্ঘ ও সঙ্ঘ-ঘনিষ্ঠ নেতাদের মন্তব্য ও ধর্ম-কেন্দ্রিক কর্মসূচি সরকারকে বিপাকে ফেলছে। সংসদে বিরোধীদের একজোট করে তুলছে। সঙ্ঘ যেন এ সবে রাশ টানে। গত কাল কিন্তু উল্টো চাপ এল সঙ্ঘ-বিজেপির বৈঠকে। যথেষ্ট সাংগঠনিক শক্তি ও বিপুল গরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় আসার পরেও দল কেন জমি খোয়াচ্ছে, কেন জমি বিল নিয়ে সাধারণ মানুষকে, এমনকী শিবসেনা অকালির মতো শরিক দলকেও বুঝিয়ে উঠতে পারছে না সেই সব প্রশ্ন তুললেন সঙ্ঘ-নেতারা।
বিজেপির শীর্ষ সূত্রের খবর, গত কালের ওই বৈঠকে আরএসএস কাল রীতিমতো সতর্ক করেছে দলকে। সঙ্ঘের বক্তব্য, দলের কর্মীদের সঙ্গে মানুষের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হচ্ছে। গোবলয়ে উত্তরপ্রদেশ, বিহারের মতো রাজ্যে যেখানে দলের প্রভাব ছিল, সেখানেও ধীরে ধীরে জমি হারাচ্ছে বিজেপি। দলের নেতৃত্বের সঙ্গে কর্মীদের ও কর্মীদের সঙ্গে আম জনতার যোগাযোগ হারিয়ে যাচ্ছে। যার প্রভাব স্পষ্ট দেখা গিয়েছে দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনে। জমি বিলের সদর্থক দিকগুলি তুলে ধরার ক্ষেত্রেও ব্যর্থ হয়েছে দল। আর এই পরিস্থিতিরই পুরো সুযোগ নিচ্ছে বিরোধীরা। দলের উঁচু থেকে নিচু তলা পর্যন্ত এই বিচ্ছিন্নতার খেসারত আগামী নির্বাচনগুলিতেও দিতে হতে পারে বলে আশঙ্কা জানিয়েছে সঙ্ঘ।
এই হুঁশিয়ারির পরে ২৪ ঘণ্টা পেরনোর আগেই অমিত শাহ দলের কাজকর্মে বদল আনতে ৫টি কর্মসূচি ঘোষণা করেছেন।
• জমি বিলের পক্ষে প্রচার চালাতে পথে নেমে আন্দোলন।
• দলের নিচু তলার কর্মীদের আরও গুরুত্ব, উঁচু তলার নেতাদের সঙ্গে তাঁদের যোগাযোগ বাড়ানো।
• দলের প্রবীণদের ক্ষোভ প্রশমণ।
• রাজ্যে-রাজ্যে দলীয় সভাপতির সফর।
• সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে দলের সম্পর্ক বাড়ানো।
এই পাঁচ দাওয়াইয়ে দলকে এ বার একটা ঝাঁকুনি দিতে চান অমিত শাহ। গত কাল সঙ্ঘ-নেতাদের কাছে তিনি কবুল করেছেন, জমি বিল নিয়ে বিরোধীরা যে ভাবে সক্রিয় হয়ে মানুষের কাছে মোদী সরকারের নেতিবাচক ভাবমূর্তি তৈরি করতে পেরেছে, তুলনায় বিজেপি বিলের ভাল দিকগুলি নিয়ে মানুষের কাছে পৌঁছতে পারেনি। তাই বেঙ্গালুরুতে দলের কর্মসমিতির বৈঠকে আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণার প্রস্তুতি নিচ্ছেন বিজেপি সভাপতি।
সঙ্ঘের অভিযোগ, দলের নেতা-কর্মীরা দিল্লিতে সভাপতির সঙ্গে দেখা করতে গেলে সময় পাওয়াই শক্ত হচ্ছে। তাঁদের সঙ্গে ভাল ব্যবহারও করা হয় না। নিজের দিকে আঙুল ওঠায় অমিত শাহ আজই দলের কর্মসমিতির সব সদস্যকে, এমনকী, নিতিন গডকড়ী ও রাজনাথ সিংহ সভাপতি থাকার সময় যাঁরা কর্মসমিতির সদস্য ছিলেন, তাঁদেরও চিঠি লিখে জানিয়েছেন প্রতি মাসের প্রথম ও তৃতীয় সোমবার দিল্লিতে সরাসরি দেখা করা যাবে তাঁর সঙ্গে। আগে থেকে সময় চাইতে হবে না। ঘনিষ্ঠ মহলে বিব্রত অমিত বলেছেন, “আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, আমি নাকি দেখা করি না। তাই সকলের জন্য দরজা খুলে দিলাম।”
দলের কাজকর্মে খুশি নন লালকৃষ্ণ আডবাণী, মুরলীমনোহর জোশীর মতো প্রবীণ নেতারাও। আডবাণী তো প্রকাশ্যেই জম্মু-কাশ্মীরে পিডিপির সঙ্গে মিলে সরকার গড়া নিয়ে আপত্তি জানিয়েছিলেন। বিশেষ করে কট্টর বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা মাসারাত আলমকে ছেড়ে দেওয়ার পর আডবাণী দলের নেতাদের জানিয়েছিলেন, এখনই সরকার ছেড়ে বেরিয়ে আসা উচিত। প্রবীণদের ক্ষোভ প্রশমণে খোদ অমিত শাহ আজ অরুণ জেটলিকে নিয়ে পৌঁছে যান আডবাণী ও জোশীর বাড়িতে। শিবসেনা, অকালির মতো শরিক দলগুলির ক্ষোভ সামলাতেও তাদের সঙ্গে আলোচনা করতে চান বিজেপি সভাপতি।
সংগঠন বাড়ানোর জন্য শুধু নয়, মোদী সরকারের সব উন্নয়নমূলক কাজ সম্পর্কে দলের সব প্রান্তের ও সব স্তরের নেতা-কর্মীদের সচেতন করতে এ বার নিজেও রাজ্যে-রাজ্যে সফর করবেন অমিত শাহ। এই পর্বে আগামী ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত চলবে এই সফর। রাজ্য সভাপতি থেকে শুরু করে সব জেলা সভাপতির সঙ্গেও দেখা করবেন। যে সব রাজ্যে কেন্দ্রের বিষয় জড়িত, সেগুলিও নিষ্পত্তির চেষ্টা চালাবেন তিনি। যেমন, অসমে গিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে স্থলসীমান্ত চুক্তির বাধা দূর করার চেষ্টা করবেন। পশ্চিমবঙ্গ সবুজ সঙ্কেত দিলেও এখনও অসম থেকে ছাড়পত্র আসেনি। আগামী বছর সেখানে বিধানসভা ভোট। দলের একটি অংশ চাইছে ভোটের আগে যেন এই চুক্তি না হয়।
প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর থেকেই নরেন্দ্র মোদী নিজে সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে কিছুটা দূরত্ব বজায় রাখছেন। বিরোধী দল হিসেবে বিজেপিও সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে যতটা তৎপর ছিল, এখন তা দেখা যাচ্ছে না। এই দূরত্ব ঘোচাতেই আজ নিজে সংবাদমাধ্যমের মুখোমুখি হন বিজেপি সভাপতি। দিল্লিতে পরাজয়ের পরে এই প্রথম। তিনি বোঝানোর চেষ্টা করেন, মোদী সরকার কৃষি ও উন্নয়নের মধ্যে ভারসাম্য রেখেই জমি বিল তৈরি করেছে। বিরোধীরা স্রেফ রাজনীতি করার জন্য বিরোধিতা করছে। প্রধানমন্ত্রী আকাশবাণীর ‘মন কি বাত’ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে জমি বিল নিয়ে বিভ্রান্তি দূর করার চেষ্টা চালিয়েছেন। দল এ বার মাঠে নেমে সেটা করবে।
অনেক দিন ধরেই বিজেপি শিবিরে কানাঘুষো চলছে, অমিত শাহের কাজে খুশি নন সঙ্ঘ নেতৃত্বের একাংশ। রাজনাথ সিংহকে ফের সভাপতি করার জল্পনাও চলছে। কয়েক ঘটনা উস্কে দিয়েছে সেই জল্পনা। যেমন, দলের গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক সাধারণত হয় সভাপতির বাড়িতে। কিন্তু সম্প্রতি জমি বিল নিয়ে বৈঠকটি হয়েছে রাজনাথের বাড়িতে। সভাপতি অমিত শাহ গিয়েছিলেন সেখানে। গত কাল সঙ্ঘের সঙ্গে বৈঠকও অমিত শাহের বাড়িতে নয়, হয়েছে সরসঙ্ঘচালক মোহন ভাগবতের ঘনিষ্ঠ নিতিন গডকড়ীর বাড়িতে। দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনের সময় থেকেই নরেন্দ্র মোদী ও অমিত শাহের বিরুদ্ধে ক্ষোভ জমা হতে শুরু করেছিল। যে নরেন্দ্র মোদীর জাদুকে সামনে রেখে লোকসভার পরেও হই হই করে একের পর এক রাজ্য জিতছিল বিজেপি, দিল্লিতেই তা ধাক্কা খায়। তার কারণ বিশ্লেষণ করে এ বারে অমিত শাহকে সতর্ক করাও শুরু করল সঙ্ঘ।
জমি বিল নিয়ে মোদীর বৈঠক
জমি বিলে আরও সংশোধন করতে প্রস্তুত সরকার। তবে বিলের মূল চরিত্র অটুট রেখে। বর্তমান বিলের চরিত্রটিকে আমূল বদলে নয়। তবে তাতেও বিরোধীরা সন্তুষ্ট না হলে যৌথ অধিবেশনে কী করে বিলটি পাশ করানো যায়, তা নিয়ে মঙ্গলবার রাতে বৈঠক করলেন নরেন্দ্র মোদী। প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে এই বৈঠকে ছিলেন অমিত শাহ, অরুণ জেটলি, সুষমা স্বরাজ, রাজনাথ সিংহ, নিতিন গডকড়ীরা। ৫ এপ্রিল জমি অধ্যাদেশের মেয়াদ শেষ হবে। এর পরে নতুন করে অধ্যাদেশটি জারি করতে পারে সরকার। তাতে লোকসভায় পাশ হওয়া ন’টি সংশোধনীও সামিল করার ভাবনা রয়েছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy