Advertisement
১৮ এপ্রিল ২০২৪
বৃষ্টি নেই। ঋণের দায়ে আত্মহত্যা ছাড়া পথ নেই কৃষকের। বাঁচার রাস্তা?

জমি ফালাফালা, তবু লড়াইয়ে ‘মানাভূমি’!

কিছু দিন আগে জেলা কালেক্টর অফিস থেকে যে বাবুরা এসেছিলেন, তাঁরাও তো একই কথা জিজ্ঞেস করেছিলেন। কত বছর ধরে চাষ করছেন, কী করতে চাইছেন, এমন হাজারো সব।

হার-না-মানা: মানাভূমিতে লক্ষ্মীদেবী, আলিভালাম্মা ও আরাম্মা। নিজস্ব চিত্র

হার-না-মানা: মানাভূমিতে লক্ষ্মীদেবী, আলিভালাম্মা ও আরাম্মা। নিজস্ব চিত্র

দেবাশিস ঘড়াই
কুরুগুন্টা (অন্ধ্রপ্রদেশ) শেষ আপডেট: ২৩ জুন ২০১৯ ০২:১৯
Share: Save:

মুখের বলিরেখাগুলোয় যে কত বছরের রোদ লেগে রয়েছে, তার কি আর হিসেব রেখেছেন লক্ষ্মীদেবী! হাতের চেটো উপুড় করলে তা থেকে শুধু মাটির গন্ধ বেরোয়। লক্ষ্মীদেবী মাঝেমধ্যেই সে গন্ধ নেন প্রাণভরে। হোক না সে রুক্ষ, শুষ্ক, প্রাণহীন মাটি। তবু তো মাটি! শুধু কত বছর ধরে চাষ করছেন, এ প্রশ্নটার সামনে কেমন যেন থতমত খেয়ে যান।

কিছু দিন আগে জেলা কালেক্টর অফিস থেকে যে বাবুরা এসেছিলেন, তাঁরাও তো একই কথা জিজ্ঞেস করেছিলেন। কত বছর ধরে চাষ করছেন, কী করতে চাইছেন, এমন হাজারো সব। আরে, কত বছর ধরে চাষ করছেন, সে কি আর খেয়াল আছে! পাশে দাঁড়ানো বান্ধবী আরাম্মা তখন কনুই দিয়ে গুঁতো মারছেন। ফিসফিস করে বলছেন, ‘‘বল না, ছোটবেলা থেকে।’’ ‘‘হ্যাঁ সেই ছোটবেলা থেকে। অনেক বছর আগে থেকে।’’ বান্ধবী আরাম্মার কথাটাই আওড়ান তিনি। হাত থেকে আবার মেঠো গন্ধটা বেরোচ্ছে, লক্ষ্মীদেবী টের পাচ্ছেন! সেই গন্ধটা প্রাণ ভরে নিতে-নিতে বললেন, ‘‘তবে এই চাষটা আলাদা। এই চাষটা কিন্তু শুধু আমরা মেয়েরা করি। এখানে আমরাই দিনমজুর। আমরাই মালিক।’’ একটু থেমে বললেন, অন্ধ্রপ্রদেশের এই কুরুগুণ্টা গ্রামের আট একর জমি লিজও নিয়েছেন তাঁরা।

‘তাঁরা’ মানে?

মানে তিনি, আরাম্মা, আলিভালাম্মার মতো দশজন মহিলা-চাষি, জানালেন লক্ষ্মীদেবী। আরাম্মা জানালেন, তাঁরা প্রত্যেকেই একা মহিলা। কারও স্বামী মারা গিয়েছেন, কারও স্বামী আবার চাষের জন্য দেনা শোধ করতে না পেরে আত্মহত্যা করেছেন। কিন্তু চাষের মাঠে যখন ঢোকেন, প্রত্যেকেই ব্যক্তিগত বিষাদ ছাপিয়ে ফসল ফলানোর আপ্রাণ চেষ্টা করেন। যেমন আলিভালাম্মার স্বামী দেনা শোধ করতে না পেরে আত্মহত্যা করেছিলেন। আলিভালাম্মা বলছেন, ‘‘এক বছর ঘরে চুপচাপ বসেছিলাম। ভেবেছিলাম, আত্মহত্যা করব। কিন্তু ছেলেমেয়েদের দেখবে কে? তাই ঠিক করলাম, চাষটাই করব।’’ তাই খাঁ খাঁ রোদ হোক, বৃষ্টি না হোক, রোজ মাঠে আসেন লক্ষ্মীদেবী, আলিভালাম্মারা। নিজেদের আট একর জমির নামও দিয়েছেন তাঁরা—‘মানাভূমি’। তেলুগুতে যার অর্থ ‘আমাদের জমি’!

অথচ এমন এক সময়ে চাষের স্বপ্ন দেখছেন তাঁরা, যখন গোটা অন্ধ্রপ্রদেশের প্রায় সাড়ে পাঁচ লক্ষ হেক্টর জমিকে খরা-কবলিত বলে ঘোষণা করা হয়েছে, যখন প্রায় সাড়ে ১০ লক্ষ চাষির জীবন সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত। যখন নিরাপত্তা কী, সন্তানের ভবিষ্যৎ কী—কোনও বিষয়েই সঠিক উত্তর নেই চাষিদের কাছে। যেমন লক্ষ্মীদেবীদের কুরুগুণ্টা গ্রাম থেকে প্রায় ১৭০ কিলোমিটার দূরে কুর্নুলের চানুগোন্ডলা গ্রামের কৃষক বয়া প্রতাপ বলছিলেন, ‘‘ছোট ছেলেমেয়েদেরও কাজে লাগিয়ে গিয়েছি। সকলে মিলে খাটি। না হলে খাব কী? জমি থাকলেও ফসল হয় না!’’ জি রাঙ্গাইয়া বলছিলেন, ‘‘দু’টো ছেলে পড়াশোনায় ভালই ছিল জানেন। কিন্তু পেটের খাবার জুটলে তো পড়াশোনা! এখন সকলে মিলে দিনমজুরির কাজ করি।’’ আবার কার্নুলেরই পোনাকলাডিন্নে গ্রামের নাগাম্মা বললেন, ‘‘সরকার বিনা মূল্যে বীজ দিয়েছে। কিন্তু বৃষ্টি না হলে বীজ পুঁতে কী হবে?’’

লক্ষ্মীদেবী, আরাম্মারাও দেখছেন, রোদে কী ভাবে ফালাফালা হয়ে যাচ্ছে জমি! জল থাকলেও তা পর্যাপ্ত নয়। লক্ষ্মীদেবী, আরাম্মাদের এক জায়গায় সংগঠিত করার কাজটা যিনি করেছেন, সেই চেরেভু ভানুজা বলছিলেন, ‘‘খরা সমস্যাটা অনেক বড়। কৃষকদের আত্মহত্যা, কৃষকদের দুরবস্থা একটা বড় অংশ ঠিকই, কিন্তু খরাকে কেন্দ্র করে মহিলা-শিশু পাচারের পরিধিও কিন্তু বাড়ছে। কাজের লোভ দেখিয়ে তাঁদের অন্যত্র নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।’’ চিন্তিত দেখায় ভানুজার মুখ।

এরকম চিন্তা অবশ্য আরও রয়েছে! একা মহিলাদের চাষের খবর শুনে জেলা কালেক্টর কিছুদিন আগে এসেছিলেন ‘মানাভূমি’তে। খরাদীর্ণ এলাকায় চাষ চালানোর জন্য গভীর নলকূপ বসানোরও মৌখিক আশ্বাস দিয়েছেন তিনি। কিন্তু যতক্ষণ না তা পাওয়া যাচ্ছে, চিন্তা থাকছেই।

যদি না পাওয়া যায়, তা হলে কী করবেন? এ প্রশ্নের সামনে আর থমকালেন না লক্ষ্মীদেবী। বললেন, ‘‘কী আবার করব। চাষটাই করব। এবার না পাওয়া গেলে পরের বার নিশ্চয় পাওয়া যাবে। পাওয়া যাবেই।’’ দীর্ঘ প্রতীক্ষার পরে চাষের জমিতে ফসল ফললে যে ভাবে দপদপ করে করে ওঠে চাষির মুখ, তেমনই দেখাল লক্ষ্মীদেবীকে। পিছনে আট একর মাঠ। ঝাঁ-ঝাঁ করছে রোদ। ছাউনির ছায়ার আশ্রয় ছেড়ে মাঠের দিকে ফের চলে যাচ্ছেন লক্ষ্মীদেবীরা। মেঠো গন্ধটা আবার ছড়াতে শুরু করেছে। আস্তে-আস্তে তা ছড়িয়ে পড়ছে চারপাশে।

‘‘এই দেখুন, বৃষ্টি হলে এখানে বীজ বুনব।’’ দূর থেকে মাঠের এক জায়গায় হাত দিয়ে দেখালেন লক্ষ্মীদেবী।

খরা আছে তার নিজস্ব হাহাকার নিয়ে। সমস্ত কিছু ছারখার করে দেওয়ার দার্হ্য নিয়ে। কিন্তু লক্ষ্মীদেবী, আরাম্মা, আলিভালাম্মারাও আছেন চাষের নাছোড় জেদ নিয়ে। সেই জেদের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে অন্ধ্রপ্রদেশের সেই সমস্ত চাষিদের হার-না-মানা মনোভাব, যাঁরা রোজ খরাকে উপেক্ষা করে ফসল ফলানোর জন্য মাঠে যান, মাঠে পড়ে থেকে বীজ বোনার অক্লান্ত পরিশ্রম করতে থাকেন। গ্রামের পরে গ্রামে খরার বিরুদ্ধে এ লড়াই চলতেই থাকে।

এ ‘মানাভূমি’ যে হারতে জানে না!

এবার শুধু খবর পড়া নয়, খবর দেখাও।সাবস্ক্রাইব করুনআমাদেরYouTube Channel - এ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE