উদ্বিগ্ন: নেলির আব্দুল হামিদ।
ফোনে বিলাপের মতো শোনাচ্ছিল তাঁর কথাগুলো। মরিগাঁও জেলার নেলি থেকে ৫৮ বছর বয়সি আব্দুল হামিদ বললেন, ‘‘আমি লেখাপড়া জানি না। যা টাকা ছিল, এত দিন ধরে নিজেকে ভারতীয় প্রমাণ করতে করতে শেষ হয়ে গিয়েছে। এত মামলা জেতার পরেও তালিকায় নাম নেই। জানি না, আর কী ভাবে নিজেকে ভারতীয় প্রমাণ করতে হবে!’’
অসম আন্দোলনের সময় ১৯৮৩ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি মরিগাঁও জেলার নেলিতে ছ’ঘণ্টার মধ্যে বাংলাদেশি সন্দেহে কয়েক হাজার মানুষকে খুন করা হয়েছিল। হামিদের পরিবারের ৬ জন সে-দিন নিহত হন। তার পর ২০১০, ২০১২, ২০১৬ সালে তাঁর নামে তিন বার ডি-ভোটারের (ডাউটফুল বা সন্দেহভাজন) নোটিস আসে। চলে তথ্যপ্রমাণের লড়াই। প্রৌঢ় জানান, মামলার জন্য উকিলকে টাকা দিতে হয়েছে। আবার প্রয়োজনীয় নথিপত্র জোগাড় করতেও টাকা দিতে হয়েছে বিভিন্ন দালালকে। তবে ভারতীয় হওয়ার পর্যাপ্ত প্রমাণ থাকায়, ফরেনার্স ট্রাইবুনাল প্রতি বারই তাঁকে ভারতীয় বলে রায় দিয়েছে। তার পরেও চূড়ান্ত খসড়ায় বাদ পড়েছে তাঁর নাম। নাম নেই স্ত্রী এবং চার ছেলেমেয়েরও। কেন? জবাব খুঁজছেন হামিদ। এনআরসি কর্তৃপক্ষের তরফে এখন যদি কোনও চিঠি আসে! তা কাউকে দিয়ে পড়িয়ে তিনি জানবেন, কেন নাগরিক পঞ্জির খসড়া থেকে তাঁদের পুরো পরিবার বাদ পড়ল! তার পর আবার আবেদনের পর্ব।
কিন্তু এই চিঠি আসা নিয়েও সংশয়। বঙাইগাঁও শহরের বাসিন্দা সম্রাট ভাওয়াল এবং স্ত্রী শুভ্রার নাম নেই তালিকায়। তবে রয়েছে পুত্র শৌভিত, মা, বাবা-ভাইয়ের নাম। স্থানীয় সেবাকেন্দ্রে যোগাযোগ করলে জানানো হয়েছে, বাদ পড়ার কারণ জানতে ৭ অগস্টের পরে এসে আবেদনপত্র জমা দিতে হবে। অথচ এনআরসি সমন্বয়রক্ষাকারী প্রতীক হাজেলা জানিয়েছিলেন, প্রথম তালিকা থেকে বাদ পড়া দেড় লক্ষ মানুষকে আলাদা আলাদা চিঠি পাঠিয়ে কারণ জানানো হবে। তা হলে?
গোলোকগঞ্জের কবিতা রায়।
শুভ্রাদেবীর বাবা বঙাইগাঁওয়ে রেশন দোকান খুলেছিলেন ১৯৬২ সালে। নথিপত্র সবই রয়েছে। কিন্তু প্রথম তালিকায় নাম এলেও সাম্প্রতিক তালিকায় শুভ্রাদেবীর নাম নেই। বলেন, ‘‘যদি জানতেও পারি কোন নথির জন্য নাম বাদ পড়েছে, কিছু করার নেই। যা ছিল, সবই জমা দিয়েছিলাম। নতুন কোনও প্রমাণপত্র দেওয়ার নেই।’’ আর সম্রাটবাবুর কথায়, ‘‘যদি পরের তালিকাতেও আমাদের নাম না থাকে, তা হলে কী হবে? ছেলেকে একা ফেলে ডিটেনশন শিবিরে থাকব?’’ পুত্রের মোবাইলেই তো এসেছে ভাইরাল হওয়া কবিতাটা— আমার সোনার সংসার/ এনআরসি করল ছারখার/ হাজার টাকা খরচ করিয়া/ দিলাম কাগজ খুঁজিয়া-খুঁজিয়া/ তার পরেও নাইরে শান্তি/ লাগল ঘরে এমন অশান্তি…
বঙাইগাঁওয়ের সম্রাট, শৌভিত ও শুভ্রা ভাওয়াল।
ধুবুড়ির গোলোকগঞ্জে সোনাখুলি গ্রামের বাসিন্দা কবিতা রায়ের আতঙ্ক আরও বেশি। কারণ, তাঁর নাম পরের তালিকাতেও ওঠার সম্ভাবনা দেখছেন না। গত দেড় দশক ধরে তাঁর নাম ‘ডি-ভোটার’ তালিকায় ফেলে রাখা হয়েছে। কোচ-রাজবংশী কবিতাদেবীর স্বামী পুলিশের এএসআই! বাবা প্রথমে ব্রিটিশ সেনায় ছিলেন। পরে ভারতীয় বাহিনীর জওয়ান হয়ে অবসর নেন। তার পরেও কবিতার নাম কী ভাবে ‘সন্দেহভাজন’ তালিকায় থাকে? সরকারি চাকুরে স্বামী মুখ বুজে রয়েছেন। শুধু ভাবছেন, তালিকা চূড়ান্ত হওয়ার পর কী হবে কবিতার?
আরও পড়ুন: পঞ্জি নিয়ে তৃণমূল থেকে দূরে কংগ্রেস
দোতারা বাজিয়ে এক বৃদ্ধের গান তাই এখন ভাইরাল। ‘যদি খুশি থাকতে চাও, যদি আসামে থাকতে চাও, প্রমাণপত্র জমা দিয়া এনআরসি বানাও। প্রমাণপত্র না থাকিলে বাংলাদেশে যাও।’
—নিজস্ব চিত্র।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy