Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

ভোট দেবে কে? যুদ্ধক্ষেত্রে আজ পরীক্ষায় গণতন্ত্র

জেলা কংগ্রেস সভাপতি রজনু নেতাম আঙুল দেখিয়ে বললেন, “ভোটের বাবুরা যাচ্ছেন। ইভিএম নিয়ে।”

ভোট দিয়ে কী উপকার হবে, সিনেমার নিউটনও জঙ্গলের আদিবাসীদের বুঝিয়ে উঠতে পারেননি। ‘নিউটন’ ছবির একটি দৃশ্যে অভিনেতা রাজকুমার রাও এবং গ্রামবাসীরা।

ভোট দিয়ে কী উপকার হবে, সিনেমার নিউটনও জঙ্গলের আদিবাসীদের বুঝিয়ে উঠতে পারেননি। ‘নিউটন’ ছবির একটি দৃশ্যে অভিনেতা রাজকুমার রাও এবং গ্রামবাসীরা।

প্রেমাংশু চৌধুরী 
নারায়ণপুর (ছত্তীসগঢ়) শেষ আপডেট: ১২ নভেম্বর ২০১৮ ০১:৪৬
Share: Save:

নিউটন কুমাররা শুধু সিনেমাতেই থাকেন!

অবুঝমাঢ়ের দিকে সশব্দে উড়ে গেল একটা। গোটা নারায়ণপুরের চোখ আকাশে। জেলা কংগ্রেস সভাপতি রজনু নেতাম আঙুল দেখিয়ে বললেন, “ভোটের বাবুরা যাচ্ছেন। ইভিএম নিয়ে।”

সেই অবুঝমাঢ়। মাওবাদীদের সদর দফতর। বলা ভাল দুর্গ। হলই বা ভারতের ছত্তীসগঢ় রাজ্যের নারায়ণপুর বিধানসভা কেন্দ্রের এলাকা। স্বাধীনতার ৭১ বছর পরেও সেখানে সরকার-পুলিশ-প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণ নেই। মাওবাদীদের শাসনই শেষ কথা।

এখান থেকে অবুঝমাঢ় কত দূর?

আর ২২ কিলোমিটার। তার পরে আরও কিছুটা গাড়ি চলার রাস্তা রয়েছে। তার পরে আর কিছু নেই। ভোটের বাবুদের তাই কপ্টারই ভরসা।

কতখানি এলাকা? তা প্রায় চার হাজার বর্গ কিলোমিটার। কত জন ভোটার? ১৬ হাজার মতো হবে। কত ভোট পড়ে? গত বারের ভোটে ওই ৭০০-৮০০ ভোট পড়েছিল।

মাওবাদীরা এ বার ভোট বয়কটের ডাক দিয়ে হুমকি দিয়েছে, ভোট দিলে হাতের আঙুল কেটে নেওয়া হবে। দন্তেওয়াড়া-সুকমার রাস্তার ধারে পোস্টারও মেরেছে। এ বার অবুঝমাঢ়ে কত ভোট পড়বে?

আরও পড়ুন: ফের বিস্ফোরণে মৃত্যু, আজ ভয় নিয়েই ভোট ছত্তীসগ়ঢ়ে

ঢোঁক গিললেন নেতাম। তা কী করে বলব? অবুঝমাঢ়ের লোকে আর ক’টা ভোট দেয়!

তা হলে কারা ভোট দেয়? নেতাম মুখে কুলুপ আঁটলেন।

নিউটন কুমার কিন্তু উত্তরটা জেনে ফেলেছিলেন। ‘নিউটন’ সিনেমার নায়ক নিউটন কুমার। সরকারি কেরানি নিউটন প্রিসাইডিং অফিসারের দায়িত্ব পেয়ে এমন হেলিকপ্টার চড়েই এই ছত্তীসগঢ়ের মাওবাদী অধ্যুষিত এলাকায় পৌঁছেছিলেন। জঙ্গলের মধ্যে এক গ্রামে প্রথম বার পোলিং বুথ খুলতে।

দন্তেওয়াড়ার কাতেকল্যাণের তালেম গ্রাম যেমন। এই প্রথম সেখানে ভোটকেন্দ্র খুলছে। কিন্তু ভোট পড়বে? নির্বাচন কমিশন কোমর বেঁধে নেমেছে। ভোটার নিয়ে এলে মহিলাদের স্বনির্ভর গোষ্ঠী ঋণ শোধে ছাড় পাবে। ভোট দিয়ে আঙুলের কালি দেখিয়ে নিজস্বী তুললে পুরস্কার মিলবে।

মাওবাদীদের আঙুল কেটে নেওয়ার হুমকির পরে নির্বাচন কমিশনে আর্জি গিয়েছিল, যদি এ বার আঙুলে কালি না লাগানো হয়? কমিশন রাজি হয়নি। কে আঙুলের ছবি তুলে বিপদে পড়বে?

সিনেমার নিউটনকে সিআরপি-র কম্যান্ডান্ট প্রস্তাব দিয়েছিলেন, জঙ্গলে গিয়ে বিপদ বাড়িয়ে লাভ নেই। ভোট তাঁর জওয়ানরাই ‘করিয়ে’ দেবেন।

নারায়ণপুরের কংগ্রেস-বিজেপি নেতারা জানেন, অবুঝমাঢ়ের ভোটও সে ভাবেই হয়। একেকটা ভোট কেন্দ্রে ২০০-২৫০ ভোটার। চার-পাঁচটা করে ভোট পড়ে। কোথাও তিনটে বিজেপি, দুটো কংগ্রেস। কোথাও দুটো বিজেপি, তিনটে কংগ্রেস। ভোটের বাবু, সিআরপি জওয়ানরা ছাড়া বিশেষ কেউ ভোটকেন্দ্র-মুখো হয় না।

২০১৩-র বিধানসভা ভোটে বস্তার ডিভিশনের তিন জেলা, দন্তেওয়াড়া, কোন্টা, বিজাপুরের ৬০টি পোলিং বুথে কোনও ভোটই পড়েনি। বস্তার ডিভিশনে মাত্র ৪৮ শতাংশ ভোট পড়েছিল। এ বার পুলিশ-প্রশাসন-কমিশন ভোটের হার বাড়াতে মরিয়া।

নারায়ণপুরের এক বিজেপি নেতা বললেন, “শুধুই মাওবাদীদের ভয় নয়। অবুঝমাঢ়, দন্তেওয়াড়া-সুকমার গোন্ডি আদিবাসীদের সিংহভাগ এখনও এতটাই অনগ্রসর যে ভোট দিয়ে কী হবে, সেটাই বোঝে না। ভোটার কার্ড রয়েছে। না হলে রেশন মেলে না। ওই পর্যন্তই।”

আরও পড়ুন: মাওবাদী চ্যালেঞ্জের সামনে দাঁড়িয়ে আজ প্রথম দফার ভোটে ছত্তীসগঢ়

ভোট দিয়ে কী উপকার হবে, সিনেমার নিউটনও জঙ্গলের আদিবাসীদের বুঝিয়ে উঠতে পারেননি। কিন্তু ঘড়ি ধরে বিকেল তিনটে পর্যন্ত ইভিএম নিয়ে আদিবাসীদের ভোটের জন্য যুদ্ধ করেছিলেন। আদিবাসীদের হয়ে জওয়ানদের বোতাম টিপতে দেননি।

সোমবার নারায়ণপুর, দন্তেওয়াড়া, সুকমার ভোটগ্রহণও সকাল ৭টায় শুরু হয়ে বেলা ৩টেয় শেষ হয়ে যাবে। তার মধ্যে মাওবাদী হামলায় ভোট বানচাল হয়ে গেলে ফের হবে ভোটগ্রহণ। ফের ইভিএম নিয়ে দুর্গম জঙ্গলে ভোটকেন্দ্র খোলা হবে।

অবুঝমাঢ়ের জঙ্গলে কেন্দু পাতা কুড়োনো নিরক্ষর আদিবাসীরা ভোট দেওয়ার উপকারিতা বুঝে ইভিএম-এ বোতাম টিপতে যাবেন? তাঁদের জন্য কোনও প্রিসাইডিং অফিসার ইভিএম আগলে অপেক্ষা করবেন?

নিউটন কুমাররা শুধু সিনেমাতেই থাকেন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE