Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
Asembly Election 2018

রাজনীতি আর বুলেট, দুই লড়াই দেখার প্রতীক্ষায় সুকমা

আসন দখলের একটা লক্ষ্যমাত্রাও স্থির করে দিয়েছে বিজেপি।

দোরনাপাল কি এ বার মুখ ফিরিয়ে নেবে?

দোরনাপাল কি এ বার মুখ ফিরিয়ে নেবে?

তাপস সিংহ
সুকমা (ছত্তীসগঢ়) শেষ আপডেট: ০৯ নভেম্বর ২০১৮ ১৪:০৮
Share: Save:

যে দোরনাপালের মাটিতে দাঁড়িয়ে বিধানসভার নির্বাচনী প্রচার শুরু করেছিলেন ছত্তীসগঢ়ের মুখ্যমন্ত্রী রমন সিংহ, সেখানে দাঁড়িয়েই যে তাঁর সরকারের নামে এত বিষোদ্গার শুনব, সে কথা আগে ভাবিনি!

দোরনাপাল। ছত্তীসগঢ়ের সুকমা জেলার কোন্টা বিধানসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত এই দোরনাপালে প্রথম নির্বাচনী জনসভায় কয়েক দিন আগেই রমন সিংহ বলেছিলেন, এখানেউন্নয়নের ছাপ স্পষ্ট। উন্নয়নের স্বার্থেই বিজেপিকে ভোট দিন। আসন দখলের একটা লক্ষ্যমাত্রাও স্থির করে দিয়েছে বিজেপি। ওই জনসভাতেই মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছিলেন, তাঁদের লক্ষ্য এ বার ৬০টির বেশি আসন দখল করার।

‘‘উন্নয়ন মানে কি শুধু কয়েকটা রাস্তা করে দেওয়া? শুধু খবরের কাগজে আর চ্যানেলে চ্যানেলে প্রচার করলেই বুঝি উন্নয়ন হয়ে যায়?’’ দোরনাপাল বাজারে স্টেশনারি দোকানে বসে প্রবীণ মানুষ ফতে বাহাদুর সিংহ পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে দেন। বলেন, ‘‘আর রাস্তার কথাও যদি ধরেন, তা হলে এই দোরনাপাল-জগরগুন্ডা রাস্তার কথাই ধরুন। এত গুরুত্বপূর্ণ একটা রাস্তা, গত দু’-তিন বছর ধরে সরকার বলে চলেছে রাস্তা হচ্ছে। অথচ হালটা গিয়ে দেখুন। বার বার টেন্ডার বদল হচ্ছে, ঠিকাদার পাল্টাচ্ছে, অথচ রাস্তা যেখানে ছিল সেখানেই রয়েছে।’’

দোরনাপালেরই আর এক যুবক নীরজের কথায়: ‘‘এই সরকার শিক্ষার কথা বলে। আদিবাসীদের উন্নয়নের কথা বলে। শিক্ষা কাকে বলে বলুন তো? এখানকার বহু আদিবাসীকে ডাক্তাররা অসুখের জন্য টনিক লিখে দিলে অনেকে একেবারে গোটা শিশি গলায় ঢেলে দেয়। বোঝালেওবুঝতে পারে না, টনিক চামচে মেপে খেতে হয়। দোষটা কি শুধু আদিবাসীদের? স্রেফপ্রচারের জন্য বলা হচ্ছে, আদিবাসীদের জন্য অনেক কিছু করা হচ্ছে।’’

অবশ্য নির্বাচনী প্রচারে এসে রমন নিজেও বলেছেন, এই অঞ্চলের আদিবাসীদের জন্য গত পঞ্চাশ বছরে কংগ্রেস কিছুই করেনি। তা হলে করল কারা? সুকমার বিজেপি কর্মী রামশরণের কথায়: ‘‘যা করার বিজেপি-ই করেছে। এত এডুকেশন হাব হয়েছে, ঘুরে দেখুন। আদিবাসীরা সস্তায় চাল পাচ্ছে, গম পাচ্ছে। কে দিয়েছে এ সব? রমন সরকার দিয়েছে!’’

আরও পড়ুন: পশ্চিমবঙ্গের মতো পরিবর্তনের মেঘ ছত্তীসগঢ়ের আকাশেও!

বিজেপি কর্মী হয়ে রামশরণ এ কথা বলতেই পারেন। কিন্তু খাস সুকমা শহরের মধ্যেই সুকমা নগরপালিকার অন্তর্গত ৮ নম্বর ওয়ার্ডে এক বার উঁকি মেরে দেখতে গিয়ে যা চোখে পড়ল তা কার্যত অকল্পনীয়। এই এলাকাও শহরের মধ্যে! বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে খেত। স্রেফ পাথরের উপর সুরকি ফেলা কাঁচা রাস্তার দু’পাশে টিন, বাঁশ আর অ্যাসবেস্টসের বাড়ি। কোনও কোনও বাড়ি পাকা। নিকাশি বলতে বাড়ির পাশে নালা কাটা। সেখানে হাঁস-মুরগি-শুয়োরঘুরে বেড়াচ্ছে। বিদ্যুৎ আছে বটে, তবে সব পাড়ায় নয়।

সে বিদ্যুতের হাল কেমন? ‘‘অনেকটা বাড়ির বকাটে ছেলের মতো। এক দিন বাড়ি ফেরে তো পরের দিন ফেরে না,’’এলাকার যুবকহিতেশ সোরির চমৎকাররসিকতা! সুকমা জেলারইকোররাগাঁও থেকে এই এলাকায় এসে উঠেছেন হিতেশ। বাড়িতে তিন ছেলে, এক মেয়ে আর স্ত্রী।যেমন, হাড়মা মারকাম। এই এলাকাতেই চার একরের মতো জমি তাঁর। এ ছাড়া মুদির দোকানও আছে। বাড়িতে মা-বাবা-স্ত্রী ও এক মেয়ে। তাঁরা যেখানে থাকেন, সেই পুরনো পাড়ায় জলকষ্ট রয়েছে। পুরনো ও নতুন পাড়া মিলিয়ে প্রায় ৮৫ ঘরের বাস।

প্রকৃত শিক্ষা আর উন্নয়ন কাকে বলে, জানে কি সুকমা?

অথচ, শহরের কেন্দ্রস্থল থেকে এই কোট্টিগুড়া এলাকা মাত্র চার কিলোমিটার দূরে। মাওবাদী প্রভাবিত সুকমা ঘুরতে এসে কোট্টিগুড়া এলাকার প্রসঙ্গ টানা কেন? কারণ, এখানেও জড়িয়ে রয়েছে উন্নয়ন বনাম অনুন্নয়নের প্রশ্ন। নগরপালিকার অন্তর্ভুক্ত এলাকা হলেও স্থানীয়েরা প্রশ্ন ছুড়ে দিচ্ছেন, শহরের মধ্যে থেকেই যদি উন্নয়নের এই হাল হয় তা হলে গ্রামীণ এলাকার হাল কেমন, তা সহজেই বোঝা যায়।

আরও পড়ুন: কার্বাইনের নল উঁচিয়ে অবুঝমাড় পরীক্ষা নিচ্ছে গণতন্ত্রের

কোন্টা বিধানসভা কেন্দ্র বর্তমানে কংগ্রেসের দখলে। স্থানীয় বিধায়ক কওয়াসি লখমা গত চার বারের বিধায়ক। এ বারেও জিতলে পঞ্চম বার বিধায়ক হবেন তিনি। কোন্টা কেন্দ্রের মানুষজনই বলছেন,কওয়াসির সব থেকে বড় গুণ হল, যে কোনও কাজে তিনি স্থানীয় মানুষের পাশে থাকেন। যে কোনও অনুষ্ঠানে যান তাঁর পাশের কেন্দ্রের কংগ্রেস প্রার্থী দেবতী কর্মার মতোই। তাঁর জনসংযোগ অননুকরণীয়। সাধারণ মানুষ থেকে সরকারি অফিসার, তাঁর কুশলবার্তা বিনিময় চলে সব সময়েই। তাঁরই মূল্য তিনি পাচ্ছেন একের পর এক নির্বাচনে।

দুর্গম সুকমা দিন-রাত শোনে ভারী বুটের আওয়াজ।

২০১৩-য় সুকমারই দরভা ঘাঁটিতে কংগ্রেসের ‘পরিবর্তন যাত্রা’র উপরে মাওবাদীদের যে প্রাণঘাতী হামলা হয়, সেখান থেকে বরাত জোরে প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন এই কওয়াসি লখমা। তাঁকে তুলে নিয়ে গেলেও মাওবাদীরা ছেড়ে দেয়।

কওয়াসির মূল প্রতিদ্বন্দ্বী বিজেপির ধনীরাম বারসে। ২০১৩-র বিধানসভা নির্বাচনে ধনীরাম মাত্র ৬ হাজার ভোটের ব্যবধানে পরাস্ত হয়েছিলেন কওয়াসির বিরুদ্ধে।বিজেপি এ বারেও তাঁকেই আরও এক বার সুযোগ দিয়েছে প্রার্থী করে। কিন্তু আরও একটা রাজনৈতিক সমীকরণ কিছুটা হলেও চিন্তার ভাঁজ ফেলছে কংগ্রেস মহলে। এই কেন্দ্র থেকে এ বারেও দাঁড়িয়েছেন সিপিআই প্রার্থী, প্রাক্তন বিধায়ক মণীষ কুঞ্জম। স্বচ্ছ ভাবমূর্তির এই কমিউনিস্ট নেতাকে নিয়ে এমনিতে বড় একটা চিন্তা ছিল না কংগ্রেসের। কিন্তু এ বার কংগ্রেস ছেড়ে অজিত যোগীর নতুন দল ছত্তীসগঢ় জনতা কংগ্রেসের সঙ্গে সমঝোতা করে ভোটে লড়ছে সিপিআই। ফলে কিছুটা হলেও কংগ্রেসের ভোট কাটতে পারেন মণীষ। তাঁর কথায়: ‘‘এ বারে জোর লড়াই হবে। আমি আশাবাদী।’’

গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগের অপেক্ষায় কোন্টা।

এক দিকে রাজনৈতিক লড়াই, অন্য দিকে মাওবাদীদের ভোট বয়কটের ডাকের ও হিংসার বিরুদ্ধে প্রশাসনিক স্তরের লড়াই। কোন্টা কেন্দ্রের ২১২টি বুথের মধ্যে সব ক’টিকেই অতি সংবেদনশীল আখ্যা দিচ্ছে জেলা প্রশাসন। সুকমার যে দিকেই তাকাই না কেন, নিরাপত্তার চাদরে মুড়ে ফেলা হয়েছে গোটা তল্লাট। আগে থেকেই এই জ‌েলায় মোতায়েন ছিল সিআরপিএফ, আইটিবিপি এবং স্পেশাল টাস্ক ফোর্সের প্রায় ২০ হাজার জওয়ান। এসে পড়ছে আরও ৬ হাজার জওয়ান। ভোটারের সংখ্যা প্রায় এক লক্ষ ৭৫ হাজার।

কিন্তু নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা বলে কি কিছু হয়? এই সুকমাই তো বার বার ভুল প্রমাণ করেছে সে কথা!

দোরনাপাল থেকে সুকমা শহরে ফেরার পথে চোখে পড়ে, গভীর জঙ্গলের ফাঁক দিয়ে অস্ত যাচ্ছে সূর্য। অস্তগামী সূর্য যেন ঘন সবুজে দীপাবলির রঙ্গোলির কমলা রং ছড়িয়ে দিচ্ছে! প্রকৃতি তার সৌন্দর্য ছড়ানোয় বড়ই অকৃপণ!

এত সৌন্দর্যের মধ্যেও লাইট মেশিনগান, অ্যাসল্ট রাইফেল আর ভারী বুটের এত দাপাদাপি থাকে!

গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ

(ভোটের খবর, জোটের খবর, নোটের খবর, লুটের খবর- দেশে যা ঘটছে তার সেরা বাছাই পেতে নজর রাখুন আমাদেরদেশবিভাগে।)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE