রাজনীতির ময়দানে যে লড়াই-ই চলুক না কেন, ছত্তীসগঢ়ে আসল লড়াইটা বোধহয় মাওবাদীদের সঙ্গে বাকিদের।
মাঝে মাঝে ভুল হয়ে যাচ্ছে, এটা ছত্তীসগঢ়ের দক্ষিণ প্রান্তের নারায়ণপুর জেলা নাকি অশান্তকাশ্মীর উপত্যকা!
চতুর্দিকে জলপাইরঙা পোশাকের ভিড়। সে ভিড়েরহাতে হাতে অ্যাসল্ট রাইফেল আর কার্বাইন। জঙ্গলের দিকে তাক করা বন্দুকের নল…রাস্তার দু’ধার দিয়ে হেঁটে চলেছে সারিবদ্ধ সুঠাম চেহারা…সরকারি বাড়িগুলোয় অতন্দ্র প্রহরা…আতঙ্কের চোরাস্রোত!
রায়পুর শহর থেকে বস্তার জোনের এই নারায়ণপুরের দূরত্ব প্রায় ৩০০ কিলোমিটার। ধমতেরি ছাড়ানোর পর থেকেই গাড়ি থামিয়ে রুটিন তল্লাশি। নির্বাচনের আগে এটাই দস্তুর। কিন্তু নারায়ণপুর যত এগোতে থাকে, তল্লাশির বহরও ততই পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে।
আরও পড়ুন: পশ্চিমবঙ্গের মতো পরিবর্তনের মেঘ ছত্তীসগঢ়ের আকাশেও!
আর কয়েক দিন পরেই গণতন্ত্রের পরীক্ষা হতে চলেছে ছত্তীসগঢ়ে। সে পরীক্ষার প্রধান কুশীলব অবশ্যই রাজনৈতিক নেতা ও প্রার্থীরা।কিন্তু নারায়ণপুরের চেহারা দেখলে কে এ কথা বলবে! কে-ই বা বলবে, এই কেন্দ্রে লড়াই করছেন রাজ্যের মন্ত্রী, বিজেপির কেদার কাশ্যপ! তাঁর বিপক্ষে আর এক কাশ্যপ, কংগ্রেসের চন্দন। লড়াইয়ের ময়দানে আছেন একদা কংগ্রেসে থাকা, পরে ছত্তীসগঢ় জনতা কংগ্রেস গড়া অজিত যোগীর প্রার্থীও।
অবুঝমাড়ে এমন বেশ কিছু এলাকা রয়েছে যেখানে নিরাপত্তা বাহিনীর পায়ে হেঁটে পৌঁছনোর খবরও মাওবাদীদের কাছে এক দিন আগে পৌঁছে যায়।
রাজনীতির ময়দানে যে লড়াই-ই চলুক না কেন, আসল লড়াইটা বোধহয় মাওবাদীদের সঙ্গে বাকিদের। আতঙ্কের এই চোরাস্রোত না থাকলে নারায়ণপুরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আপনাকে মুগ্ধ করবেই। তার আসল কারণ, অবুঝমাড়!
চতুর্দিকে পাহাড় আর ঘন জঙ্গলে ঘেরা অবুঝমাড়ের অপার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখলে মন ভাল হয়ে যায়। অন্তত কিছু ক্ষণের জন্যও আঘাত আর প্রত্যাঘাতের নিয়মিত অনুশীলনের কথা ভুলে যেতে ইচ্ছে করে।
কিন্তু ভুলতে দেবে কে!
নারায়ণপুর থেকে পাহাড়ে ঘেরা সোনপুরের দিকে যেতে ধরতে হয় জঙ্গল চেরা রাস্তা। গাড়ির চাকা গড়াতে থাকে বটে, কিন্তু আটকে যায় কুষনার থানার কাছে ব্যারিকেডে। ক্যামোফ্লেজ পোশাক পরা চেহারা খুব বিনীত ভাবে ডিকি খুলতে বলেন। আরও বিনীত ভাবে নিজের হাতে ব্যাগ খুলতেও বলেন। তত ক্ষণে গাড়ি ঘিরে ইন্দো টিবেটান বর্ডার পুলিশের (আইটিবিপি) আরও কয়েক জন। বিনীত চেহারার স্বর ভেসে আসে, ‘‘আপনি আরও কত দূর যেতে চান?’’ এ হেন দার্শনিক সুলভ প্রশ্নের চটজলদি কোনও উত্তর হয় না। তবু বলতে হয়, ‘‘আরও কিছু দূর যাওয়া যাক।’’
আরও পড়ুন: কর্নাটক উপনির্বাচনেও ধাক্কা বিজেপির, ৫টির মধ্যে ৪টিতেই জয়ী কংগ্রেস-জেডিএস
প্রশ্নের কারণও আছে অবশ্য। এই অবুঝমাড়কে বলা হয় মাওবাদীদের দুর্গ। পুলিশপ্রশাসনের দৃঢ় বিশ্বাস, অবুঝমাড়ের কার্যত দুর্ভেদ্য জঙ্গল-পাহাড়ে ঘেরা এলাকায় ঘাঁটি গেড়ে রয়েছেন বেশ কয়েক জন মাওবাদী নেতা। অস্ত্র প্রশিক্ষণ থেকে শুরু করে যাবতীয় কর্মকাণ্ড চলে সেখানে। এমন বেশ কিছু এলাকা রয়েছে যেখানে নিরাপত্তা বাহিনীর পায়ে হেঁটে পৌঁছনোর খবরও মাওবাদীদের কাছে এক দিন আগে পৌঁছে যায়। মাওবাদীদেরও রয়েছে নিজস্ব সুরক্ষা বলয়। এ হেন জায়গায় কার্যত প্রাণ হাতে করে ডিউটি দেওয়ার সময় প্রশ্ন করতেই হয়, ‘‘আরও কত দূরে যেতে চান?’’
এমনকি, জওয়ানদের নিজেদের সুরক্ষার জন্যও জেলা প্রশাসন অত্যন্ত চিন্তিত। এতটাই যে, জেলার পুলিশ আধিকারিকরা রীতিমতো প্রশিক্ষণ শিবির করে তাঁদের ‘ক্লাস’ নিচ্ছেন। নারায়ণপুরের এডুকেশন হাব-এ পড়ুয়াদের জন্য বানানো হস্টেলকে পরিণত করা হয়েছে ট্রানজিট হস্টেলে। সেখানে গিয়ে দেখা গেল, বিহার থেকে আসা তিনটি ব্যাটালিয়নের জওয়ানদের প্রোজেক্টরের মাধ্যমে ম্যাপ দেখিয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে নারায়ণপুরের ভৌগোলিক অবস্থান বোঝানো হচ্ছে।
অবুঝমাড়ের ভোটারের সংখ্যা কত? মাত্র ১৪ হাজার!
নারায়ণপুরের পুলিশ সুপার জিতেন্দ্র শুক্ল মাইকের মাধ্যমে বোঝাচ্ছেন, মাওবাদী নিয়ন্ত্রিত এলাকায় কী ভাবে কাজ করতে হবে, জরুরি পরিস্থিতিতে মাথা ঠান্ডা রেখে কী ভাবে নিজেদের নিরাপদে রাখতে হবে প্রভৃতি। গত কয়েক দিন ধরেই দফায় দফায় এ কাজ চলছে।
জিতেন্দ্র আনন্দবাজার ডিজিটালকে বললেন, ‘‘নির্বাচন প্রক্রিয়া সুষ্ঠু ভাবে করানোর জন্যই এই ইন্ডাকশন ট্রেনিং করাতে হচ্ছে। মাওবাদী ক্যাডারদের চেনানো হচ্ছে। গোটা এলাকার ভৌগোলিক অবস্থান বুঝিয়ে তাদের দায়িত্ব ভাগ করে দেওয়া হচ্ছে। এই এলাকায় নির্বাচন করানোটা একটা পরীক্ষা তো বটেই!’’
অবুঝমাড় এলাকায় জওয়ানদের সুরক্ষার জন্যও জেলা প্রশাসন অত্যন্ত চিন্তিত।
মস্ত বড় পরীক্ষা! এই কেন্দ্রের ১২২টি বুথের মধ্যে প্রায় সবগুলিই স্পর্শকাতর। তার মধ্যে অবুঝমাড় এলাকার ১৮টি বুথ অতি স্পর্শকাতর।এর উপর মাওবাদীদের ভোট বয়কটের ডাক তো আছেই।
মাওবাদীদের প্রভাব এতটাই যে, নারায়ণপুর থেকে মাড়োরা পর্যন্ত প্রায় ১০৮ কিলোমিটার রাস্তা প্রশাসন তৈরি করে উঠতে পারেনি। নারায়ণপুর থেকে মাত্র ১৭-১৮ কিলোমিটার রাস্তা এ পর্যন্ত তৈরি হয়েছে। মাওবাদীদের বাধায় বাকিটা হয়নি। কবে হবে কেউ জানে না।
নারায়ণপুরের ভৌগোলিক অবস্থান বোঝানো হচ্ছে জওয়ানদের।
গণতন্ত্র রক্ষায় এত চেষ্টা হয়, অথচ এখনও অবুঝমাড়ের কোকামাটার গ্রামের যুবক রামকে প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যেতে গেলে পাড়ি দিতে হয় ৪০ কিলোমিটার পথ!
আলো পড়ে আসে অবুঝমাড়ের আকাশে। শাল-সেগুন-মহুয়ার গন্ধ মাখা রহস্যময় অবুঝমাড় কিসের প্রতীক্ষায় থাকবে?
বিনীত কণ্ঠে গণতন্ত্র কি তাকে প্রশ্ন করবে, আরও কত দূরে যেতে চায় সে?
—নিজস্ব চিত্র।
গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ।
(ভোটের খবর, জোটের খবর, নোটের খবর, লুটের খবর- দেশে যা ঘটছে তার সেরা বাছাই পেতে নজর রাখুন আমাদের দেশ বিভাগে।)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy