Advertisement
১৭ এপ্রিল ২০২৪
Narendra Modi

মধ্য ভারতের এই পরাজয় কি ফাটল ধরাবে গেরুয়া দুর্গে?

২০১৯ লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেসের জন্য লড়াইটা আদৌ সহজ হল কি না তা বোঝা না গেলেও এটা স্পষ্ট আপাতত দিল্লির রাস্তা কিছুটা হলেও বন্ধুর হয়ে গেল মোদীর সামনে।  

অরুণাভ পাত্র
শেষ আপডেট: ১১ ডিসেম্বর ২০১৮ ২১:৪৩
Share: Save:

এলাম, দেখলাম, জয় করলাম। ভারতের জাতীয় রাজনীতিতে নরেন্দ্র মোদীর আবির্ভাবকে বোধহয় এই শব্দবন্ধেই ব্যাখ্যা করা যায়। সরাসরি প্রধানমন্ত্রিত্বের দাবি নিয়েই তাঁর উদয় হয়েছিল জাতীয় রাজনীতির ভাগ্যাকাশে। গুজরাতের বাইরে কোনও দিন না গেলেও নির্বাচনের বৈতরণী পেরোতে তাঁর কাঁধেই চেপেছিল গোটা বিজেপি। আর সুযোগ্য মাঝির মতো বিপুল ভোটে জিতিয়ে বিজেপিকে ক্ষমতায় ফিরিয়েছিলেন নরেন্দ্র মোদী। ২০১৪-র ২৬ মে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়েছিলেন গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী। নতুন অধ্যায় তৈরি হয়েছিল ভারতের ইতিহাসে।

সুযোগ্য সেনাপতির মতো মোদীর সঙ্গে জাতীয় রাজনীতিতে ঢুকে পড়েছিলেন তাঁর বিশ্বস্ত সেনাপতি অমিত শাহ-ও। ২০১৪-র লোকসভা নির্বাচনে নরেন্দ্র মোদীর টিমে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ কাজটা করেছিলেন অমিতই। উত্তরপ্রদেশে ভোটের দায়িত্ব নিয়ে ৮০টির মধ্যে ৭৩টি আসন দখল করে লোকসভা নির্বাচনের লড়াইটা একপেশে করে দিয়েছিলেন তিনি। দু-একটি আঞ্চলিক দল বাদ দিলে সারা দেশে কংগ্রেস-সহ বিরোধীদের অস্তিত্ব নিয়েই শুরু হয়েছিল টানাটানি। অমিত শাহ-র এই ভূমিকা মাথায় রেখেছিলেন নরেন্দ্র মোদী। মে মাসে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার ঠিক পরের মাসেই বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি পদে নিয়ে আসা হয়েছিল অমিত শাহকে। সেই শুরু। তার পর থেকেই সারা দেশে ছুটতে শুরু করেছিল মোদী-শাহ জুটির অশ্বমেধ যজ্ঞের ঘোড়া।

শুরু থেকেই নরেন্দ্র মোদীর বিজয়রথ সারা দেশে ছুটে চলেছিল অপ্রতিরোধ্য গতিতে। একই সঙ্গে ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর হয়ে উঠছিল ভারতীয় রাজনীতিতে কংগ্রেসের উপস্থিতি। ৫৪৩ সদস্যের লোকসভাতে কংগ্রেসের আসন ৪৪-এ বেঁধে দেওয়াতেই আটকে থাকেনি বিজেপি। ‘কংগ্রেস মুক্ত ভারত’ গড়তে একের পর রাজ্যে উড়তে শুরু করেছিল গেরুয়া জয়ধ্বজা। উত্তর থেকে দক্ষিণ, পূর্ব থেকে পশ্চিম— একের পর এক রাজ্য গিয়েছে বিধানসভা নির্বাচনে। আর ততই শক্ত হয়ে ভারতের মাটিতে চেপে বসেছে বিজেপির খুঁটি।

হরিয়ানা, অসম, জম্মু ও কাশ্মীর, উত্তরপ্রদেশ, উত্তরাখণ্ড, হিমাচল প্রদেশ, উত্তর-পূর্বের একের পর রাজ্য— মোদীর নেতৃত্বে দেশ জুড়ে ক্রমেই শক্ত হয়েছে বিজেপির হাত। পাঁচ রাজ্যের সাম্প্রতিক বিধানসভা নির্বাচনের আগে গোটা দেশে দু’টি মাত্র বড় রাজ্যে ক্ষমতায় ছিল কংগ্রেস। পঞ্জাব এবং কর্নাটক ছাড়া আর কোনও বড় রাজ্যে আক্ষরিক অর্থেই কোনও অস্তিত্ব ছিল না কংগ্রেসের। অনেকটাই সফল হয়ে উঠেছিল মোদীর ‘কংগ্রেস মুক্ত ভারত’ গড়ার স্বপ্ন।

আরও পড়ুন: প্রথম বড় সাফল্য, সভাপতিত্বের এক বছরেই লম্বা পথ পেরিয়ে এসে এক অন্য রাহুল

আর এই স্বপ্নের উড়ানের সঙ্গে সঙ্গেই আরও অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠছিলেন নরেন্দ্র মোদী। দল এবং সরকারে তিনিই হয়ে উঠেছিলেন একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী। এই সময়টাতেই বিজেপি থেকে সরে যেতে হয়েছে একের পর এক নেতাকে, যাঁরা বিভিন্ন সময় মোদীর সমালোচনা করেছিলেন। শত্রুঘ্ন সিংহ, অরুণ শৌরী, যশোবন্ত সিংহ, যশবন্ত সিন্‌হা, তালিকাটা নেহাৎ ছোট নয়। দল তো বটেই সরকারেরও একমাত্র মুখ হয়ে উঠেছিলেন তিনিই। বিদেশ হোক বা প্রতিরক্ষা বা অর্থ মন্ত্রক, অনেক সময়ই মন্ত্রীরা থাকতেন অন্ধকারেই। তাঁর অঙ্গুলিলেহনে চলতে রাজি না হওয়ায় সরে যেতে হয়েছে একের পর এক আমলা এবং সরকারের উচ্চপদস্থ কর্তাকে। সোমবারই রিজার্ভ ব্যাঙ্কের শীর্ষকর্তা পদে উর্জিত প্যাটেলের ইস্তফা সেই তালিকার নবতম সংযোজন। রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে, রাজধানীতে নরেন্দ্র মোদীর মতো ক্ষমতাশালী নেতৃত্বের নজির শুধু পাওয়া যায় ইন্দিরা জমানাতেই। সাম্প্রতিক কালে ক্ষমতার একমাত্র উৎস হয়ে ওটার এই রকম নজির আর নেই।

ধাক্কা যে একেবারে আসেনি তা নয়। বিহারে বিজেপি বিরোধী মহাজোটের কাছে হার প্রথম বারের মতো বুঝিয়ে দিয়েছিল মোদীর ম্যাজিকও কাজ না করতে পারে। যদিও পরে নীতিশের সঙ্গে সমঝোতা করে ক্ষমতায় এসে সেই ধাক্কা সামাল দিয়েছিল বিজেপি। দক্ষিণে বিজেপির একমাত্র ঘাঁটি কর্নাটকে সর্ববৃহৎ দল হিসেবে নির্বাচিত হলেও ক্ষমতায় আসতে পারেনি বিজেপি। অন্য দিকে পঞ্জাবেও সরে যেতে হয়েছিল বিজেপি-অকালি জোটকে। যদিও সামগ্রিক সাফল্যের নিরিখে এই দু’টি পরাজয় কোনও ভাবেই কমাতে পারেনি ভারতীয় রাজনীতিতে নরেন্দ্র মোদীর আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠার প্রবণতাকে।

আরও পড়ুন: সচিনের সোনালি ইনিংস, রাজস্থানে মসনদ খোয়াচ্ছেন রানি বসুন্ধরা

পাঁচ রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচন সেই কারণেই হয়ে উঠেছিল আসল পরীক্ষা। নরেন্দ্র মোদী নেতৃত্বাধীন বিজেপিও কী তাঁর শক্তির ভরকেন্দ্রে পরাজিত হতে পারে। রাজনৈতিক মহলে এই প্রশ্নটাই হয়ে উঠছিল সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ।কারণ রণক্ষেত্র ছিল হিন্দি বলয়, যা তাঁকে দু’হাত তুলে আশীর্বাদ করেছিল ২০১৪ লোকসভা নির্বাচনে। সেই নির্বাচনে হিন্দি বলয়ের ২২৫ আসনের মধ্যে ২০৩টি আসন নিজেদের দখলে নিয়েছিল। তাই হিন্দি বলয়ের তিন গুরুত্বপূর্ণ রাজ্য রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ এবং ছত্তীসগঢ়ে কী হয়, সেদিকে নজর ছিল সব পক্ষেরই। মনে রাখতে হবে এই তিনটি রাজ্যের ৬৫টি লোকসভা আসনের মধ্যে ৬২টি আসনই ছিল বিজেপির দখলে।

আরও পড়ুন: পাঁচ রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচন: কে কী বললেন?

আর ঠিক এই গুরুত্বপূর্ণ জায়গাতেই আটকে গেল নরেন্দ্র মোদীর বিজয়রথ। প্রথম বারের জন্য ভারতবর্ষ দেখল, নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বেও বিজেপি হারতে পারে হিন্দি বলয়ে। রাজস্থান, ছত্তীসগঢ়ে কংগ্রেসের সরকার গড়া নিশ্চিত। সরকার দখলের লড়াইতে মধ্যপ্রদেশেও এগিয়ে কংগ্রেস। হঠাৎ করেই মধ্য ভারতে ফ্যাকাশে হয়ে গেল গেরুয়া রং। মুখ থুবড়ে পড়ল কংগ্রেস মুক্ত ভারতের স্বপ্ন। উল্টে ভারতের রাজনীতিতে ফের ঘুরে দাঁড়াল কংগ্রেস।

২০১৯ লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেসের জন্য লড়াইটা আদৌ সহজ হল কি না তা বোঝা না গেলেও এটা স্পষ্ট আপাতত দিল্লির রাস্তা কিছুটা হলেও বন্ধুর হয়ে গেল মোদীর সামনে।

গ্রাফিক- শৌভিক দেবনাথ

(ভোটের খবর, জোটের খবর, নোটের খবর, লুটের খবর- দেশে যা ঘটছে তার সেরা বাছাই পেতে নজর রাখুন আমাদের দেশ বিভাগে।)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE