তিন মাস আগে বিধানসভা ভোটে বিজেপির প্রচারের প্রধান ‘অস্ত্র’ ছিল রাস্তাঘাট। বরাক উপত্যকার ১৫ আসন জুড়ে একই স্লোগান শোনা যায় তখন— ‘রাস্তার হাল ফেরাতেই চাই সরকারের পরিবর্তন।’ শহর কী গ্রাম, অন্যতম বক্তা ছিলেন পরিমল শুক্লবৈদ্য। এমনকী, পূর্ত বিভাগের প্রতীকী শবদাহ নিয়েও ভোটের আগে শিলচর শহর পরিক্রমা করে বিজেপি। পরিমলবাবু নিজে তার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। বিভাগীয় এগজিকিউটিভ ইঞ্জিনিয়ারকে বাইরে ডেকে শবদেহ হস্তান্তর করেছিলেন সে দিন।
ভোটের তিন মাস পর আজ সেই পরিমলবাবু পূর্তমন্ত্রী হিসেবে বিধানসভার অধিবেশনে লিখিত ভাবে জানিয়েছেন— ‘‘বরাকের ৮ নম্বর জাতীয় সড়কের (চুরাইবাড়ি-বদরপুরঘাট) ৮২ শতাংশই যাতায়াতের উপযোগী। ৬ নম্বর জাতীয় সড়কের (মালিডহর থেকে বদরপুরঘাট, ধলেশ্বরী হয়ে মিজোরাম সীমানা পর্যন্ত) অবস্থা তো আরও ভাল। ৮৭ শতাংশ। বদরপুরঘাট থেকে শিলচর তারাপুর হয়ে মণিপুর সীমা পর্যন্ত গিয়েছে যে ৩৭ নম্বর জাতীয় সড়ক, তারও ৭৬.৩৫ শতাংশ রাস্তা যাতায়াতের উপযুক্ত।
বরাক উপত্যকার রাস্তাঘাট কি সত্যিই খারাপ? পূ্র্তমন্ত্রীর আজকের লিখিত বক্তব্যের পর বিধানসভার ভেতরে-বাইরে ওই একই প্রশ্ন। অনেকে টেনে আনছেন, এই বিষয়ে ভোটের আগে দিলীপকুমার পালের (বর্তমানে ডেপুটি স্পিকার) আমরণ অনশনে বসে অসুস্থ হওয়ার কথা। কেউ কেউ জানতে চান, তবে আর হাতি দিয়ে লরি ঠেলার দরকার পড়ে কেন। ত্রিপুরা সরকারই-বা কেন বরাক উপত্যকার রাস্তাঘাট নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে দরবার করলেন। কেন তাদের মুখ্যসচিব দু’দিন আগে করিমগঞ্জে এসে রাস্তার হাল দেখলেন। কেন কয়েক দিন পর-পর কাটিগড়ায় রাস্তা অবরোধ হয়। কেন কাশীপুরে দিনদশেক আগেও রাস্তা নিয়ে উত্তেজনা ছড়ায়।
গত মাসে আদালতে হলফনামা দিয়ে পূর্ত বিভাগ জানিয়েছিল, বরাক উপত্যকায় জাতীয় সড়কের ৮৬ শতাংশই ভাল। তা জেনে প্রতিবাদে সরব হয়েছিলেন বরাক উপত্যকার মানুষ। হলফনামা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন পূর্তমন্ত্রী পরিমল শুক্লবৈদ্যও। আজ অবস্থান বদলে ওই হলফনামার হিসেবই বিধানসভা অধিবেশনে পেশ করলেন তিনি।
উত্তর করিমগঞ্জের কংগ্রেস বিধায়ক কমলাক্ষ দে পুরকায়স্থ জাতীয় সড়কের দুরবস্থা নিয়ে লিখিত প্রশ্ন পাঠিয়েছিলেন সরকারের কাছে। তার জবাব আজ অধিবেশনে পেশ করা হলেও প্রশ্নোত্তর পর্বে সময়ের অভাবে আলোচনা হয়নি। তবে মন্ত্রীর জবাব শুনে অধিবেশনের বাইরে প্রচণ্ড ক্ষোভ প্রকাশ করেন কমলাক্ষবাবু। তিনি বলেন, ‘‘পূর্তমন্ত্রী হয়েই যে পরিমল শুক্লবৈদ্য বরাকের সঙ্গে সম্পর্ক রাখছেন না, এটি হল তার সব চেয়ে বড় প্রমাণ। সম্পর্ক রাখলে কেউ এমন বলতে পারতেন না।’’ তাঁর মন্তব্য, ‘‘মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণের জায়গায় পরিবর্তন না এলেও মন্ত্রীদের মধ্যে দ্রুত পরিবর্তন এসেছে।’’ তাঁর বক্তব্য, জাতীয় সড়কের করিমগঞ্জ-বদরপুর অংশে বাঁশ বেঁধে মানুষ চলাচলের পরও যদি ৮২ আর ৮৬ শতাংশ রাস্তা ভালো থাকে, তবে কংগ্রেস ভালই কাজ করছিল। ভোটের সময় মানুষকে কেন বিভ্রান্ত করা হয়েছিল, জানতে চান তিনি।
পরিমলবাবুর জবাবে ক্ষুব্ধ শিলচর জেলা কংগ্রেস কমিটির সভাপতি, প্রাক্তন সাংসদ কর্ণেন্দু ভট্টাচার্যও। তাঁর প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া, ‘‘মানুষ শিলচর থেকে করিমগঞ্জ যেতে পারেন না, করিমগঞ্জের কেউ জরুরি প্রয়োজনেও ঘর থেকে বের হতে পারেন না। আর মন্ত্রী বলেন, ৮২ শতাংশ!’’ তিনি এই সরকারি তথ্য মানেন না বলে জানিয়ে দ্রুত সমস্ত রাস্তাঘাট মেরামতের দাবি করেন।
জেলা কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক রাজেশ দেব পরিমলবাবুর পদত্যাগ দাবি করেন। তাঁর যুক্তি, ‘‘৮২ শতাংশ রাস্তা ভাল হলে তিনি মিথ্যে বলে ভোট নিয়েছেন, মন্ত্রী হয়েছেন। তাই তাঁর ইস্তফা দেওয়া উচিত।’’ সঙ্গে যোগ করেন, ‘‘দু’দিন আগেও ত্রিপুরার মুখ্যসচিব এসে করিমগঞ্জের রাস্তা ঠিক করলেন, পরিমলবাবুর কি লাজলজ্জা বলতে কিছু নেই!’’
অল বরাক ইয়ুথ স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের মুখ্য আহ্বায়ক বাহারুল ইসলাম বড়ভুইয়া বিধানসভার এই তথ্যকে ‘ভয়ঙ্কর অসত্য’ বলে মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, ‘‘যাঁরা পরিবর্তনের স্লোগান দিয়ে ক্ষমতায় এলেন, তাঁরাই এখন বিগত সরকারের বুলি আউড়াচ্ছেন।’’
সিপিএম নেতা দুলাল মিত্রও ত্রিপুরা থেকে মুখ্যসচিব এসে রাস্তা দেখে যাওয়ার প্রসঙ্গ উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, ‘‘প্রতিটি রাস্তা খারাপের চূড়ান্ত সীমায়। সে জন্য ত্রিপুরায় বেশ কিছু দিন ধরে পণ্যসঙ্কট দেখা দিয়েছে। পেট্রোল-ডিজেলের রেশনিং করতে হচ্ছে।’’
এসইউসিআই নেতা প্রদীপকুমার দেবের মন্তব্য, ‘‘পরিমলবাবুর এমন হিসেবের পর কী প্রতিক্রিয়া দিই। এ তো বিভাগীয় অফিসারের কথার প্রতিধ্বনি।’’ একে বাস্তবের পুরোপুরি বিপরীত বলেই জানান প্রদীপবাবু। তাঁর আক্ষেপ, নতুন সরকারও আগের মতোই উদাসীন। জনগণ থেকে তাঁরা যে এরই মধ্যে বহু দূরে অবস্থান করছেন, তাতেই স্পষ্ট।
তবে বিজেপির জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক রূপম সাহার বক্তব্য, ‘‘বহু জায়গাতেই রাস্তা ভাল। মাঝেমধ্যে খারাপ। ওই খারাপটুকুর জন্যই চলাচলের বড় সমস্যা। হিসেব টানলে দেখা যায়, মন্ত্রী যথার্থই বলেছেন।’’
উদাহরণ দিয়ে রূপমবাবু বলেন, ‘‘শিলচর-আইজল রোডের সবটাই এখন ভাল। শুধু সোনাই রোড খারাপ। ত্রিপুরার দিকে চুরাইবাড়ির একাংশ খুব খারাপ।’’ তবে আর ভোটের আগে রাস্তা নিয়ে এত শোরগোল করা কেন, জবাবে তিনি গ্রামীণ রাস্তার কথা টেনে আনেন। বলেন, ‘‘গ্রামীণ রাস্তাগুলি ঠিকই খারাপ। জাতীয় সড়ক ততটা নয়। এর উপর় সব রাস্তায় কাজ চলছে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy