Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

পাতালে উথালপাথাল তুঙ্গে, কাঁটা বিজ্ঞানীরা

সাকুল্যে সতেরো দিন। তারই মধ্যে হিমালয়ের ইউরেশীয় প্লেট টালমাটাল হল ছ’-ছ’বার! ভূমিকম্পে কাঁপিয়ে দিল উপমহাদেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চল, যার দু’‌টোর মাত্রা রিখটার স্কেলে সাতের উপরে! আর সব ক’টিরই উৎস হিমালয় লাগোয়া নেপাল-ভারত-চিন-পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের চৌহদ্দি ঘিরে।

দেবদূত ঘোষঠাকুর
কলকাতা শেষ আপডেট: ১৩ মে ২০১৫ ০৩:০৯
Share: Save:

সাকুল্যে সতেরো দিন। তারই মধ্যে হিমালয়ের ইউরেশীয় প্লেট টালমাটাল হল ছ’-ছ’বার! ভূমিকম্পে কাঁপিয়ে দিল উপমহাদেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চল, যার দু’‌টোর মাত্রা রিখটার স্কেলে সাতের উপরে! আর সব ক’টিরই উৎস হিমালয় লাগোয়া নেপাল-ভারত-চিন-পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের চৌহদ্দি ঘিরে।

একই ভাবে অস্ট্রেলিয়া লাগোয়া প্রশান্ত মহাসাগরের পাপুয়া-নিউগিনি দ্বীপও গত এক মাসে অন্তত পাঁচ বার কেঁপে উঠেছে। তার তিনটির তীব্রতা ছিল সাত রিখটারের বেশি! ইদানীং মাটির নীচে এত উথালপাথাল কেন?

ভূ-বিজ্ঞানীদের ব্যাখ্যা: প্রাকৃতিক বিবিধ ঘাত-প্রতিঘাতে হিমালয় অঞ্চলের ইউরেশীয় প্লেট এই মুহূর্তে এতটাই অস্থির যে, তা ঘনঘন ভূমিকম্পের প্রভূত সম্ভাবনা জিইয়ে রাখছে। পাপুয়া-নিউগিনির ভূস্তরে অবস্থিত অস্ট্রেলীয় প্লেটেরও একই হাল। কাজেই ওই তল্লাটও মহা দুর্বিপাকের মুখে বসে আছে।

ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করে খড়্গপুর আইআইটি’র ভূ-পদার্থবিদ শঙ্করকুমারনাথ মঙ্গলবার বলেন, হিমালয় অঞ্চলে ভারতীয় প্লেটটি ফি বছরে গড়ে চল্লিশ মিলিমিটার করে ঢুকে যাচ্ছে ইউরেশীয় প্লেটের ভিতরে। তারই জেরে দু’প্লেটের জোড়ে বিস্তর বাঁক (হিঞ্জ) ও চ্যুতি (ফল্ট) হয়েছে, যেখানে জমা হচ্ছে শক্তি। সঞ্চিত শক্তির পরিমাণ বাড়লে বাঁক-চ্যুতিগুলো অস্থির হয়ে ওঠে। এক সময় শক্তির পরিমাণ ধারণক্ষমতা ছাপিয়ে গেলে খাঁজ দিয়ে ভারতীয় প্লেটটি ইউরেশীয় প্লেটের নীচে ঢুকে যায়। মাথা চাড়া দেয় ভূমিকম্প।

সতেরো দিনে ছ’টি ভূমিকম্পের প্রেক্ষাপটও তা-ই। সেটি ভবিষ্যতে আরও বড় বিপর্যয়ের ইঙ্গিতবাহী বলেও সতর্ক করছেন বিশেষজ্ঞেরা।

সোমবারই আফগানিস্তানের ফারখারে ৪.১ মাত্রার ভূকম্পন হয়েছে। এ দিনও সেখানে ইয়াংবি-ইয়ালার কাছে ৪.৭ মাত্রার একটি ভূমিকম্প হয়, বেলা এগারোটা নাগাদ।ভূ-বিজ্ঞানীরা যখন তার ক্ষয়ক্ষতি খতিয়ে দেখতে ব্যস্ত, তখনই নেপাল-চিন সীমান্তে নতুন বিপর্যয় দেখা দেয়। ভূ-বিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন, এ দিন কাঠমান্ডুর ৮৩ কিলোমিটার পূর্বে নেপাল-চিন সীমান্তের ঝামে ভারতীয় প্লেটটি অনেকটা ঢুকে যায় ইউরেশীয় প্লেটের ভিতরে। ভারতীয় সময় দুপুর ১২টা ৩৫ মিনিটে ভূপৃষ্ঠের সাড়ে আঠারো কিলেমিটার গভীরে ঘটে যাওয়া ওই কাণ্ডেই ৭.৪ রিখটারের মতো বড় মাপের ভূকম্পে বেসামাল হয়ে পড়ে চিনের বড় অংশ, নেপাল এবং পূর্ব, উত্তর-পূর্ব ও উত্তর ভারত।

গত ২৫ এপ্রিল কাঠমান্ডুর ৭০ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে কেন্দ্রীভূত ৭.৯ মাত্রার ভূমিকম্পটির তুলনায় এ দিনের কম্পনের তীব্রতা (৭.৪) কম। কিন্তু স্থায়িত্ব ছিল প্রায় একই— ১২ থেকে ১৩ সেকেন্ড। এ দিনও মাটি আড়াআড়ি কাঁপায় মাথা ঘুরেছে, গা গুলিয়েছে। ‘‘ভূমিকম্পের তরঙ্গ এগিয়েছে ভূপৃষ্ঠ বরাবর। তাই মানুষের মনে হয়েছে, কেউ যেন তাদের ঘুরিয়ে দিচ্ছে।।’’— পর্যবেক্ষণ শঙ্করবাবুর।

এ দিন কলকাতা কেঁপেছে দু’বার।প্রথমে মূল ভূমিকম্পে— বেলা ১২টা ৩৫ মিনিটে। ফের ১টা ৯ মিনিটে, যেটি ভূকম্পোত্তর কম্পন (আফটারশক) হিসেবে চিহ্নিত করছেন বিশেষজ্ঞেরা। খড়্গপুর আইআইটি-র সিসমোগ্রাম বলছে, দুপুর সাড়ে বারোটা থেকে আড়াইটে— এই দু’ঘণ্টায় মোট সাতটি আফটারশকের জন্ম দিয়েছে এ দিনের ভূমিকম্প। আফটারশকগুলোর মধ্যে তৃতীয়টির তীব্রতা ছিল সর্বাধিক (৬.৩)। তারই আঁচ কলকাতায় এসে লেগেছে, যদিও অনেক কম মাত্রায়। একই ভাবে এ দিনের মূল ভূমিকম্পের কেন্দ্রস্থলে (নেপাল-চিন সীমান্তে) কম্পনের তীব্রতা ৭.৪ থাকলেও কলকাতায় পৌঁছতে পৌঁছতে তা ৪ রিখটারে নেমে আসে।

কিন্তু সেটুকুতেই কলকাতা যে ভাবে কাঁপল, তা দেখে রীতিমতো প্রমাদ গুনছেন ভূ-বিজ্ঞানীরা। তাঁরা বলছেন, ৬ রিখটারের কোনও ভূমিকম্প কলকাতায় হলে কী সাংঘাতিক পরিস্থিতি দেখা দেবে, সেটা মাথায় রেখে নাগরিক ও প্রশাসনের এখনই সতর্ক হওয়া জরুরি। ওঁদের তথ্যানুযায়ী, সতেরো দিন আগের ভূকম্পটির সময়ে ভারতীয় প্লেট যখন প্রবল শক্তি নিয়ে ইউরেশীয় প্লেটের নীচে ঢুকে যায়, তখন ১০২০ জুল (এক কোটি টন টিএনটি) শক্তি নির্গত হয়েছিল। এ দিনের কম্পনে নির্গত হয়েছে ১০১৫ জুল, যা কি না ছোটখোটো পরমাণু বোমার সমান!

এমতাবস্থায়, বিশেষত সিকিম-নেপাল অঞ্চলে বড় বিপর্যয়ের আশঙ্কায় কাঁটা হয়ে আছেন বিজ্ঞানীরা। ‘‘ওই তল্লাটে ইউরেশীয় প্লেট এতটাই অস্থির যে, অদূর ভবিষ্যতে ৯ রিখটারের ভূমিকম্প হওয়াও আশ্চর্য নয়।’’— মন্তব্য শঙ্করবাবুর।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE