Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

অসন্তোষের আঁচ পাচ্ছেন ঘরবন্দি অমিত

হাওয়া খারাপ, অনেক আগেই বুঝেছিলেন। তাই বলে আসছিলেন, বিহার ভোটের ফলাফলের দায় নরেন্দ্র মোদী সরকারের উপর চাপানো ঠিক হবে না। ভোট শেষেও এড়িয়ে গিয়েছিলেন প্রশ্ন। বলেছিলেন, “৮ তারিখ যা বলার বলব।”

দিগন্ত বন্দ্যোপাধ্যায়
নয়াদিল্লি শেষ আপডেট: ০৯ নভেম্বর ২০১৫ ০৪:১১
Share: Save:

হাওয়া খারাপ, অনেক আগেই বুঝেছিলেন।

তাই বলে আসছিলেন, বিহার ভোটের ফলাফলের দায় নরেন্দ্র মোদী সরকারের উপর চাপানো ঠিক হবে না। ভোট শেষেও এড়িয়ে গিয়েছিলেন প্রশ্ন। বলেছিলেন, “৮ তারিখ যা বলার বলব।”

কিছুই বললেন না অমিত শাহ। নীতীশ কুমারের তৃতীয় বার মসনদে ফেরার দেওয়াল লিখন স্পষ্ট হতেই নিজেকে ঘরবন্দি করে ফেললেন বিজেপি সভাপতি।

সকালে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং সংগঠনের নেতা রামলালকে নিয়ে চলে গিয়েছিলেন লালকৃষ্ণ আডবাণীর বাড়িতে। দলের প্রবীণ নেতাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাতে গিয়ে পায়ে হাত দিয়ে প্রণামও করেছিলেন। টেলিভিশনের পর্দায় তখনও দেখাচ্ছিল, এগিয়ে বিজেপিই। দিনের শেষে অনেকেই বলছেন, ছবিটা যে বদলে যেতে পারে, সেই সকালেই আঁচ করেছিলেন অমিত। তাই আডবাণীর মতো বিরোধী গোষ্ঠীর নেতাকে আগেভাগেই পাশে পাওয়ার চেষ্টায় ছিলেন। যাতে হারের পরিস্থিতি তৈরি হলে তিনি আচমকা বেসুর গেয়ে সুষমা স্বরাজ, রাজনাথ সিংহ, নিতিন গডকড়ীদের বিদ্রোহ উস্কে না দেন।

মোদী অবশ্য সম্প্রতি ঘনিষ্ঠ মহলে স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন, বিহারে হার-জিতের উপরে অমিতের সভাপতি পদে থাকা-না-থাকা নির্ভর করছে না। তাঁর কাজে তিনি সন্তুষ্ট, সঙ্ঘও। কিন্তু প্রশ্ন উঠছে, গদি বাঁচলেও আজ কি মান বাঁচল অমিতের? বিহারে এমন বিপর্যয়ের পর নৈতিক কর্তৃত্ব কি আদৌ অটুট রইল তাঁর?

আজ বেলা গড়াতে না গড়াতেই হোয়াটসঅ্যাপে ছড়িয়ে পড়ল রসিকতা— ‘পাকিস্তানবাসীকে দীপাবলির আগাম অভিনন্দন!’ এই খোঁচার লক্ষ্যও তো সেই অমিত! দিন কয়েক আগে ভোটের প্রচারে যিনি বলেছিলেন, “বিহারে বিজেপি হারলে বাজি ফাটবে পাকিস্তানে!” দেশের সাম্প্রতিক অসহিষ্ণু আবহের প্রেক্ষিতে বিজেপি সভাপতির এই মন্তব্যের তীব্র প্রতিবাদ করেছিলেন বিরোধীরা। কিন্তু তার পরেও মেরুকরণের পথ থেকে সরে আসেননি অমিত।

বস্তুত, বিহার ভোটে এই মেরুকরণের স্লোগান থেকে শুরু করে মোদীকে তুরুপের তাস হিসেবে ব্যবহার করা, তাঁর উন্নয়ন মডেলকে তুলে ধরা--- গোটাটাই ছিল অমিতের মস্তিষ্কপ্রসূত। অরুণ জেটলি, রাজনাথ সিংহ, সুষমা স্বরাজ, নিতিন গডকড়ীদের মতো শীর্ষ নেতাদের দূরে রেখে গোটা নির্বাচন পরিচালনার ভার নিজের হাতেই তুলে নিয়েছিলেন তিনি। বিহারে ঘাঁটি গেড়ে বসে সংগঠনের যাবতীয় কৌশল তৈরি করেছিলেন। তারই একটি হল (বিশেষ করে শেষ দুই দফায়) ধর্মীয় মেরুকরণের চেষ্টা। গত লোকসভা নির্বাচনে উত্তরপ্রদেশের দায়িত্ব পেয়েছিলেন অমিত। সেখানে এই মেরুকরণের রাজনীতিতে সওয়ার হয়েই বাজিমাত করেছিলেন তিনি। মোদীর কাছে লোকসভার ‘ম্যান অব দ্য ম্যাচ’ শিরোপা পেয়ে দেশের শাসক দলের সভাপতির পদটি হাসিল করেছিলেন।

কিন্তু তার পর এই একই গতে বাঁধা কৌশল প্রয়োগ করতে গিয়ে পরপর দু’বার ধাক্কা খেলেন। প্রথমে দিল্লি, তার পর বিহার। সব নির্বাচনে জেতার ধারাবাহিকতা নিয়ে বড়াই করতেন প্রকাশ্যেই। দিল্লিতে হারের পর নিজের ওয়েবসাইটে অমিত লিখেছিলেন, ওই সময়ে দলের সদস্য সংগ্রহ অভিযান নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন তিনি। তাই ভোটে তেমন নজর দিতে পারেননি। কিন্তু এ বার সেই অজুহাত খাটবে না।

এখানেই প্রশ্ন, পরের বছর পশ্চিমবঙ্গ, অসম ও কেরল নির্বাচনে কী করবেন অমিত? সেখানেও কি একই ভাবে হিন্দুত্বের লাইন নেবেন?

এক বিজেপি নেতা বললেন, ‘‘অমিত শাহ যদি এত বড়ই রণনীতির কারিগর হন, তা হলে তাঁর বোঝা উচিত, একই সমীকরণ সর্বত্র চলে না। মোদীকে দিয়ে উন্নয়ন, আর নিজে হিন্দুত্ব-- এই প্যাকেজ খাটে না সব সময়। তা-ও আবার পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্যে। পশ্চিমবঙ্গে মেরুকরণ করার চেষ্টা হলে সেখানকার হিন্দুরাও তা ভাল চোখে নেবেন না। বরং নরেন্দ্র মোদী সরকার যদি হাতেকলমে উন্নয়ন করে দেখিয়ে দিতে পারে, তা হলে বিশ্বাস করতে পারে মানুষ। কারণ, সেই প্রত্যাশা নিয়েই মোদীকে ভোট দিয়েছিলেন তাঁরা।’’ বিজেপির রাজ্যসভার সাংসদ চন্দন মিত্র অবশ্য রাখঢাক না করেই বলছেন, “মহাজোট যে ভাবে নীতীশ কুমারের মতো এক জন মৃদুভাষী ব্যক্তিকে তুলে ধরেছিল, সেটা কাজে দিয়েছে। তুলনায় বিহারের মানুষ অমিত শাহের ‘হাই-পিচ’ প্রচারকে প্রত্যাখ্যান করেছেন।”

আজ দিনভর দলের নেতাদের নিয়ে নিজের বাড়িতে হারের কারণ বিশ্লেষণ করেছেন অমিত। মুখতার আব্বাস নকভি, অনন্ত কুমার, জে পি নাড্ডা, রামলালের মতো নেতারা ছিলেন সেই বৈঠকে। আগামিকাল সংসদীয় বোর্ডের বৈঠকে মোদী নিজেও থাকতে পারেন। হার বিশ্লেষণের পাশাপাশি বিহারে বিরোধী দলনেতার নাম নিয়েও হয়তো আলোচনা হবে বৈঠকে।

সেই বৈঠকে কি ক্ষোভের মুখে পড়বেন বিজেপি সভাপতি? তাঁর ঘনিষ্ঠ শিবির বলছে, অমিতকে একা দায়ী করা ঠিক নয়। কারণ, কেন্দ্রে বিজেপি সরকার আসার পিছনে তাঁর অবদান কম ছিল না। তিনি যাঁর ‘ডান হাত’, সেই মোদীর নামেই কেন্দ্রে ক্ষমতায় এসেছিল বিজেপি। বিহারেও হেরেও বিজেপি যে ক’টি আসন পেয়েছে, তা মোদীরই নামে। কারণ, মহাজোটের যেমন নীতীশ ছিলেন মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী, এনডিএ-র তেমন কেউ ছিলেন না। ‘মুখ’ বলতে ছিলেন মোদীই। আর অমিত ছিলেন কার্যত ‘সিইও’।

বিজেপি সভাপতির ঘনিষ্ঠ নেতা ও পশ্চিমবঙ্গের পর্যবেক্ষক কৈলাস বিজয়বর্গীয়র বক্তব্য, ‘‘যে কোনও নির্বাচনে জেতার জন্য তিনটি বিষয় প্রয়োজন। নেতৃত্ব, রণনীতি ও তার রূপায়ণ। আমাদের নেতৃত্ব সমর্থ। রণনীতিও ঠিক ছিল। কিন্তু এর রূপায়ণ করে কর্মীরা ভোটকেন্দ্র পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারেননি।’’ অর্থাৎ, দায় দলের নিচু তলার কর্মীদের! ঠিক যে যুক্তিটি দেখানো হয়েছিল দিল্লিতে হারের পর।

এখানেই ক্ষুব্ধ বিজেপি নেতাদের কেউ কেউ। তাঁরা প্রশ্ন তুলছেন, দলের শীর্ষ নেতাদের বাদ দিয়ে অনন্ত কুমার, ধর্মেন্দ্র প্রধান, ভূপেন্দ্র যাদবের মতো ‘অনভিজ্ঞ’ নেতাদের ভরসায় বিহারে ভোট করিয়েছেন অমিত। আজ বিজেপি জিতলে ফলাও করে সাংবাদিক বৈঠকটা তিনিই করতেন। তা হলে হারের দায় নিচু তলার কর্মীদের ঘাড়ে চাপানো হচ্ছে কেন? এক নেতার বক্তব্য, ‘‘লালকৃষ্ণ আডবাণীর মতো নেতাকে এত দিন ব্রাত্য করে রেখে আজ তাঁর জন্মদিনে একটি ‘হার’ উপহার দিলেন নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহ।’’ বিজেপি নেতা শত্রুঘ্ন সিনহা আবার নাম না করেই চাঁছাছোলা আক্রমণ করেছেন মোদী-অমিত জুটিকে। বলেছেন, “‌যোগ্য লোকেদের বাইরে রেখে দু’জন গুজরাতি নির্বাচন পরিচালনা করেছে। তালি ও গালি দু’টোই তাদের প্রাপ্য। এর জন্য আমার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয় তো নিক।” প্রাক্তন বিজেপি নেতা অরুণ শৌরি আবার স্পষ্টই বলেছেন, নরেন্দ্র মোদী, অমিত শাহ এবং অরুণ জেটলিই বিহারে বিজেপির বিপর্যয়ের জন্য দায়ী। এখন আর বিজেপির সদস্য নন শৌরি। কিন্তু বাজপেয়ী জমানায় আর্থিক নীতির অন্যতম রূপকার ছিলেন তিনি। ছিলেন দলের অন্যতম বুদ্ধিজীবী মুখও। তাই তাঁকে সহজে উড়িয়ে দিতে পারে না বিজেপি। শীর্ষ নেতৃত্ব জানেন, শৌরি দলের অনেকের মনের কথাই বলছেন।

তবে প্রকাশ্যে যতই ‘ড্যামেজ কন্ট্রোল’ আবহ থাক, বিজেপির অন্দরে মোদী-অমিতের বিরুদ্ধে অসন্তোষের চোরাস্রোত বইছে। দিল্লি বিধানসভার ভোটে ভরাডুবির পর এ ভাবেই দলের মধ্যে বিক্ষুব্ধ স্বর দানা বেঁধেছিল। অনেকে বলছেন, শত্রুঘ্ন বা প্রাক্তন স্বরাষ্ট্রসচিব রাজকুমার সিংহের মতো বিহারের নেতাদের অসন্তোষকে গোড়ার দিকে পাত্তাই দেননি বিজেপি শীর্ষ নেতৃত্ব। আজ তো তাঁরা মুখ খুলবেনই। ফলে নিঃসন্দেহে কঠিন পিচের সামনে অমিত। পরাজয়ের জল কত দূর গড়ায়, সেটাই এখন দেখার।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE