Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

দুমড়ে যাওয়া বাসের পাশে ছড়িয়ে লাশ

অসম-মেঘালয় সীমান্তে বাড়ি। তাই জয়ন্তিয়া পাহাড়ে সড়ক দুর্ঘটনার খবর পেলেই ঘটনাস্থলে যাওয়ার তাগিদ বোধ করি। গাড়ি খাদে পড়ার খবরে স্থির থাকতে পারি না। প্রতি বছর একাধিক দুর্ঘটনা ঘটছে।

চলছে উদ্ধারকাজ। হাত লাগিয়েছেন স্থানীয়রাও। —নিজস্ব চিত্র

চলছে উদ্ধারকাজ। হাত লাগিয়েছেন স্থানীয়রাও। —নিজস্ব চিত্র

প্রণয় রায় (প্রত্যক্ষদর্শী)
শেষ আপডেট: ১৬ জুন ২০১৬ ১০:১৫
Share: Save:

অসম-মেঘালয় সীমান্তে বাড়ি। তাই জয়ন্তিয়া পাহাড়ে সড়ক দুর্ঘটনার খবর পেলেই ঘটনাস্থলে যাওয়ার তাগিদ বোধ করি। গাড়ি খাদে পড়ার খবরে স্থির থাকতে পারি না। প্রতি বছর একাধিক দুর্ঘটনা ঘটছে। কিন্তু আজ সকালে গিয়ে যে অবস্থা দেখলাম, তা আমার দেখা দুর্ঘটনাগুলির মধ্যে সব চেয়ে মারাত্মক।

ঘটনাস্থলে পৌঁছেই মনটা খারাপ হয়ে যায়। যাত্রীদের আত্মীয়স্বজন সেখানে জড়ো হয়েছেন। কাছেই একটি দুর্গামন্দির। সামনে-পিছনে শুধুই পাহাড়-জঙ্গল। উপর থেকে উঁকিঝুঁকি করেও গাড়িটি কোথায় পড়েছে, বোঝা যায় না। খাদ কতটা গভীর, সে আন্দাজ করাও মুশকিল। উদ্বিগ্ন মানুষ নিজের পরিজনের সন্ধানে নীচে নেমে পড়তে চান। বিএসএফ জওয়ানদের বারবার আর্জি জানাচ্ছেন, আমরা একবার নেমে চেষ্টা করে দেখি, পাই কি-না। চারদিকে কান্নাকাটি। কিন্তু উদ্ধারে ব্যাঘাত ঘটবে বলেই নয়। নীচে নামতে গিয়ে যে কোনও সময় আরেক দুর্ঘটনা ঘটতে পারে, এই আশঙ্কায় পুরো খাদের পাশ ঘিরে রেখেছেন ১৯০ নম্বর ব্যাটেলিয়নের রক্ষীরা।

দুর্ঘটনার খবর পেয়ে তাঁরাই প্রথম আসে সোনাপুরের দুর্গামন্দির সংলগ্ন এলাকায়। পরে দমকল বাহিনী। মেঘালয় পুলিশের সন্ধান মেলে অনেক দেরিতে, এমনটাই বলছিলেন সেখানে জড়ো হওয়া মানুষেরা।

কাউকে নামতে না দেওয়া যে কতটা যুক্তিযুক্ত, তা আমি বুঝতে পারি, একটু নীচে গিয়েই। বহু কষ্টে অনুমতি আদায় করি। কিন্তু সামান্য যেতেই খেই হারিয়ে ফেলার অবস্থা। কোথায় পা রাখব, কোথায় ধরব। বুঝে উঠতে পারছিলাম না। প্রায় অর্ধেক যখন নেমে গিয়েছি, আমার বলতে গেলে কাঁদো কাঁদো অবস্থা। আর নামার সাহস পাচ্ছিলাম না। উপরে তাকাতে গিয়ে নিজেকে আরও অসহায় মনে হল। এখন তো ওঠাও যাবে না।

সাহস জোগালেন সঙ্গে থাকা বিএসএফ জওয়ান। বললেন— ‘‘ওঠার সময় কষ্ট হবে না। রশি ধরে ওঠা যাবে।’’ হল-ও তাই। পাথর পিছলে প্রাণ যায়-যায় অবস্থায় শেষ পর্যন্ত নেমে গেলাম। যত নীচে এগোচ্ছিলাম, ততই নজরে পড়ে মৃতদেহ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে রয়েছে। জিনিসপত্র এখানে আটকে, ওখানে ঝুলছে। ভাঙা বাসের তলায় যে কত মৃতদেহ, কে জানে!

ভেঙে-গুড়িয়ে, দুমড়ে-মুচড়ে কোনও কাঠামোই আর অবশিষ্ট নেই। চালক নগাঁওয়ের জাকির হোসেনের কোনও খোঁজ নেই। আরও তিন জন কর্মী ছিলেন বাসে। তাঁরাও উধাও। আসলে কোনটি যে কী, তা বোঝাই দুষ্কর। একে একে ১১ জনের মৃতদেহ উদ্ধার করা হল। এক জনকেও শনাক্ত করা যায়নি। তাদের উপরে তোলাও কম কষ্টকর নয়। বিএসএফ ও দমকল বাহিনী প্রথমে জখমদের উদ্ধারে গুরুত্ব দেন। তা করতে গিয়েই ৫০ সদস্যের উদ্ধারকারী দলকে হিমসিম খেতে হয়। পাহাড়ের গায়ে কারও পা রাখার জায়গা নেই। রশি ধরে নিজেরা উঠলেও আহতের পক্ষে রশি ধরা সম্ভব নয়।

এক জনের পেছনে দশ জন জওয়ান লেগে থেকে উপরে তোলা হল ৯ জনকে। পরে মৃতদেহ টেনে তোলার পরিকল্পনা বাতিল করা হল। কাছেই রয়েছে লোভা নদী। দেহগুলি নদীর ধারে নিয়ে গিয়ে নৌকোয় তুলে দেওয়া হল। সেখান থেকে কুলিয়াং বর্ডার আউটপোস্টে। পরে সড়কপথে ক্ল্যারিয়েট হাসপাতালে। আজ কোনও মৃতদেহের ময়না তদন্ত হয়নি। অনুমান, আগামী কালও সারাদিন উদ্ধারকার্য চালাতে হবে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Accident Bus
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE