অলঙ্করণ শৌভিক দেবনাথ।
ফেসবুক-হোয়াটসঅ্যাপে মাঝেমধ্যেই একটা মেসেজ ঘোরাফেরা করে। তার সারকথা, র্যাঙ্ক করা বা সবচেয়ে ভাল ছাত্ররা ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার হবে। দ্বিতীয় বিভাগ বা কম মেধাবীরা বিবিএ-এমবিএ-র মতো পেশাদার কোর্স করে এই ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ারদের মাথায় বসে পরিচালনা করবে। আর ফেল করা ছাত্রছাত্রীরা নেতা হয়ে সবাইকে নিয়ন্ত্রণ করবে। এই মেসেজের মধ্যে কোথাও কোথাও সত্যের অপলাপ থাকতে পারে। অতিরঞ্জনও হতে পারে। কিন্তু বিধায়কদের গড় আয়ের পরিসংখ্যান কার্যত সেদিকেই ইঙ্গিত দিল। একটি সমীক্ষায় উঠে এসেছে, অষ্টম শ্রেণির গণ্ডি পেরনো বিধায়কদের বাৎসরিক গড় আয় সবচেয়ে বেশি। আর এই তালিকায় সবেচেয়ে নীচের এক ধাপ উপরে ডক্টরেট বিধায়করা।
ন্যাশনাল ইলেকশন ওয়াচ এবং অ্যাসোসিয়েশন ফর ডেমোক্র্যাটিক রিফর্মস (এডিআর) সোমবারই সারা দেশের বিধায়কদের গড় আয়ের একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। বর্তমানে দেশে বিধায়ক সংখ্যা ৪০৮৬। নির্বাচন কমিশনে বিধায়করা যে হলফনামা পেশ করেন তার ভিত্তিতেই এই রিপোর্ট তৈরি করা হয়েছে। তবে ৯৪১ জন বিধায়ক তাঁদের হলফনামা কমিশনে জমা দেননি। তাই এই বিধায়কদের বাদ দিয়ে ৩১৪৫ জন বিধায়কের তথ্য-পরিসংখ্যানই বিশ্লেষনে আনা হয়েছে এবং তার ভিত্তিতেই তৈরি হয়েছে এই রিপোর্ট। রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে বিধায়কদের বাৎসরিক গড় আয় ২৪.৫৯ লক্ষ টাকা। এছাড়াও শিক্ষাগত যোগ্যতা, পেশা, অঞ্চল, পুরুষ-মহিলা প্রভৃতি বিভাগে ভাগ করে কোন ক্যাটাগরির বিধায়কের বাৎসরিক আয় কত, তার বিস্তারিত হিসাব রয়েছে এই রিপোর্টে।
রিপোর্ট প্রকাশ্যে আসতেই রাজনৈতিক মহলে শুরু হয়েছে চর্চা। সবচেয়ে বেশি আলোচিত শিক্ষাগত যোগ্যতার বিভাগ। এই ক্যাটেগরিতে অষ্টম শ্রেণি পাশ বিধায়কদের বাৎসরিক গড় আয় সবচেয়ে বেশি ৮৯.৯ লক্ষ টাকা(বিধায়কের সংখ্যা ১৩৯)। তাঁদের ধারে কাছে কেউ নেই। দ্বিতীয় স্থানে থাকা অন্যান্যদের আয় ২৮.৫ লক্ষ। এরপর ক্রমান্বয়ে রয়েছেন স্নাতক পেশাদার, স্বাক্ষর, দ্বাদশ শ্রেণি, মাধ্যমিক, স্নাতক, স্নাতকোত্তর, পঞ্চম শ্রেণি। সবচেয়ে কম আয় নিরক্ষরদের ৯.৩০ লক্ষ। তার উপরেই রয়েছেন ডক্টরেট ডিগ্রিধারী বিধায়করা। তাঁদের বাৎসরিক গড় আয় ১২.৪০ লক্ষ টাকা।
রিপোর্টে আরও বলা হয়েছে, কর্ণাটকের বিধায়কদের বাৎসরিক আয় সবচেয়ে বেশি। এই রাজ্যের ২০৩ জন বিধায়কের বাৎসরিক আয়ের গড় ১১১.১ লক্ষ টাকা। তারপরই রয়েছে মহারাষ্ট্র (৪৩.৪)। তালিকায় সবচেয়ে নীচে ছত্তিসগড়। এই রাজ্যের ৬৩ জন বিধায়কের গড় আয় বছরে ৫.৪ লক্ষ টাকা। তার উপরে ঝাড়খণ্ডের বিধায়কদের আয়ের গড় ৭.৪ লাখ।
আরও পডু়ন: ত্রিপুরায় পঞ্চায়েতে ৯৬% আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়, বেকায়দায় বিজেপি
অঞ্চল ভিত্তিক রিপোর্টে উঠে এসেছে, তামিলনাড়ু, কেরলের মতো দক্ষিণের রাজ্যগুলির বিধায়কদের আয় সবচেয়ে বেশি, বছরে গড়ে ৫২ লক্ষ টাকা। তারপরেই রয়েছেন পশ্চিমাঞ্চলের বিধায়করা। তাঁদের আয় ২৮.৪ লক্ষ টাকা। আর পূর্বাঞ্চলের বিধায়কদের সবচেয়ে কম ৮.৫ লক্ষ টাকা।
দেশের বিধায়কদের ৮ শতাংশ মহিলা (২৫৮ জন)। পুরুষ বিধায়কদের তুলনায় মহিলাদের আয়ও কম। পুরুষরা যেখানে বছরে গড় আয় করেন ২৫.৮৫ লক্ষ, মহিলা বিধায়কদের বাৎসরিক গড় আয় সেখানে ১০.৫৩ লক্ষ।
ব্যক্তিগত ভাবে সবচেয়ে ধনী বিধায়ক ব্যাঙ্গালোর গ্রামীণের এন নাগরাজু। বাৎসরিক গড় আয় ১৫৭.০৪ কোটি। মাত্র ১৩০১ টাকা বাৎসরিক আয় করা অন্ধ্রপ্রদেশের বি যামিনী বালা সবচেয়ে গরিব বলে উল্লেখ করা হয়েছে রিপোর্টে। আরও উল্লেখযোগ্য, হলফনামা জমা দেওয়া বিধায়কদের মধ্যে ৩৩ শতাংশের (১০৫২ জন) শিক্ষাগত যোগ্যতা পঞ্চম শ্রেণি থেকে দ্বাদশ শ্রেণি। ৬৩ শতাংশ (১৯৯৭ জন) বিধায়ক নিজেদের স্নাতক বলে দাবি করে হলফনামা জমা দিয়েছেন নির্বাচন কমিশনে।
আরও পড়ুন: মাল্যকে আটক করতে নিষেধ করেছিল সিবিআই!
কিন্তু সেসব ছাড়িয়ে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে অষ্টম শ্রেণি পাশ করা বিধায়কদের গড় আয়। কেন এই শ্রেণির আয় সবচেয়ে বেশিই শুধু নয়, দ্বিতীয় স্থানে থাকা বিধায়কদের আয়ের তিন গুণেরও বেশি। কেন? এই প্রশ্নের উত্তরে রিপোর্ট প্রস্তুতকারী এডিআর-এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য জয়দীপ ছোকার বলেন, আয় করতে হলে উচ্চ শিক্ষিত হতেই হবে, এমন কোনও সূত্র নেই। তাছাড়া এই ক্যাটেগরিতে এমন অনেক বিধায়ক আছেন, যাঁরা আয়ের উৎস দেখিয়েছেন কৃষিকাজ। আর কৃষিকাজ থেকে উপার্জনের উপর কর ছাড় রয়েছে। সেটা এই শ্রেণির বিধায়কদের আয় বেশি হওয়ার একটা কারণ হতে পারে।
আরও পড়ুন: প্রধানমন্ত্রীর জন্মদিনে মোদীর ‘সদা সুখ’ চাইলেন রাহুল
১৯৯৯ সালে ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্টের আমদাবাদ ও বেঙ্গালুরুর এক দল অধ্যাপক দিল্লি হাইকোর্টে একটি জনস্বার্থ মামলা দায়ের করেন। তাঁদের দাবি ছিল, ভোটে দাঁড়াতে হলে প্রার্থীদের শিক্ষাগত যোগ্যতা, ক্রিমিনাল রেকর্ড এবং সম্পত্তির হিসাব কমিশনে জমা দিতে হবে। সেই মামলার সময়ই এই সংস্থা আত্মপ্রকাশ করে। দিল্লি হাইকোর্ট এডিআর-এর পক্ষে রায় দেয়। কেন্দ্র সুপ্রিম কোর্টকে বিষয়টিতে হস্তক্ষেপের আর্জি জানায়। শীর্ষ আদালত হস্তক্ষেপ করলেও ২০০২ সালে সেই রায়ই বহাল রাখে। তারপর থেকেই মূলত নির্বাচনী ও রাজনৈতিক সংস্কারের পক্ষে সওয়াল করে মতামত ও পরামর্শ দেয় এই সংস্থা। প্রায় একই কাজ করে দেশের ১২০০-রও বেশি সংস্থার যৌথ সংগঠন ন্যাশনাল ইলেকশন ওয়াচ (নিউ)। স্বাভাবিকভাবেই এই দুই সংস্থার যৌথ রিপোর্টের আলাদা গুরুত্ব রয়েছে রাজনৈতিক মহল এবং নির্বাচন কমিশনের কাছেও।
গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ
(ভারতের রাজনীতি, ভারতের অর্থনীতি- সব গুরুত্বপূর্ণ খবর জানতে আমাদের দেশ বিভাগে ক্লিক করুন।)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy