Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪

অনাথের স্কুল গড়তে স্টেশনেই বাসা

ঘাড় ছোঁয়া রুক্ষ চুল। গালে অযত্নের দাড়ি। হাতে গুচ্ছ রিস্ট ব্যান্ড। বছর পঁচিশের ছেলেটির কাছে হাওড়া স্টেশনে ২৩ নম্বর প্ল্যাটফর্মের ২১ নম্বর পিলারটাই ছিল এক সময়ের ঘরবাড়ি।

রাঁচীর স্কুলে সোনুর সঙ্গে এক ছাত্রী। নিজস্ব চিত্র

রাঁচীর স্কুলে সোনুর সঙ্গে এক ছাত্রী। নিজস্ব চিত্র

চন্দ্রপ্রভ ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ০২:১৫
Share: Save:

ঘাড় ছোঁয়া রুক্ষ চুল। গালে অযত্নের দাড়ি। হাতে গুচ্ছ রিস্ট ব্যান্ড। বছর পঁচিশের ছেলেটির কাছে হাওড়া স্টেশনে ২৩ নম্বর প্ল্যাটফর্মের ২১ নম্বর পিলারটাই ছিল এক সময়ের ঘরবাড়ি। অনেক রাতেই ঘুম ভাঙত রেল পুলিশের তাড়ায়। তা-ই সই।

অনাথ শিশুদের ভবিষ্যৎ গড়ার টাকা জোগাড় করতে হবে তো! তাই প্রায় একটা বছর সোনুর ঠিকানা ছিল ‘কেয়ার অব প্ল্যাটফর্ম’। আর এখন সেই ‘ভবিষ্যৎ’ ঝাড়খণ্ডের প্রত্যন্ত লোধমা গ্রামের স্কুলে ক্লাস ফোরের ছাত্রী দীপিকা মিনঝ বলে, “সোনু স্যর বহত হাসাতে হ্যায়। পড়নেমে ডর নেহি লাগতা।”

সোনু— কেন্দ্রীয় সরকারের কর্পোরেট বিষয়ক মন্ত্রকের গ্রুপ-বি অফিসার।

জন্মের পরেই ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন মা-বাবা। নিজেকে কার্যত অনাথ ভাবা ছেলেটি তাই পদবি ব্যবহার করেন না। পোশাকি নাম থাকলেও মুখে আনেন না। শুধু বলেন, ‘‘ছোট থেকে যে মানসিক যন্ত্রণা, ব্যঙ্গবিদ্রুপের মধ্যে বেড়ে উঠেছি, প্ল্যাটফর্মে থাকার কষ্ট তার কাছে কিছুই নয়। বরং বেতনের যত টাকা বাঁচাতে পেরেছি, ততটাই আমাদের সংস্থা, স্কুলের কাজে লেগেছে।’’

বাড়ি রাঁচী শহরের প্রায় শেষপ্রান্তে। প্রথমে দাদু-দিদিমাকেই বাবা-মা বলে জানতেন সোনু। তবে বেশিদিন নয়। ছোটবেলাতেই বুঝে যান সত্যিটা। অবসরপ্রাপ্ত ইঞ্জিনিয়ার দাদু নাতিকে বড় স্কুলে ভর্তি করেন। সমস্যা বাড়ে। মা-বাবা না থাকা নিয়ে তির্যক প্রশ্ন শুনতে হত প্রতিবেশী, সতীর্থ এমনকি, তাদের অভিভাবকদের কাছ থেকে। সনুর কথায়, ‘‘বহুবার নানা-নানির কাছে জানতে চেয়েছিলাম, আমার মা-বাবা কোথায়। সদুত্তর কখনও পাইনি। বয়স আর একটু বাড়লে বুঝলাম, যতটা অস্বস্তি আমার, তার থেকে অনেক বেশি নানা-নানির। কারণ, আমার তথাকথিত মা তো তাঁদেরই মেয়ে!’’

দশম শ্রেণি পাশ করার পরে রাঁচীতে আর থাকতে পারেননি সোনু। একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণি দিল্লিতে। তবে দাদু-দিদার একাকিত্ব দূর করতে স্নাতক স্তরে পড়াশোনার জন্য ফিরে আসেন রাঁচীর সেন্ট জেভিয়ার্সে। স্নাতকোত্তরের পড়াশোনার জন্য পাড়ি দেন মুম্বই। বলেন, ‘‘টাকা না থাকায় হস্টেল-মেস থেকে আমাকে বের করে দেওয়া হয়েছিল। কয়েক জন বন্ধুর অনুগ্রহে তাদের সঙ্গেই ভাগ করে থাকা-খাওয়া সারতাম। পরীক্ষার ফি দিতে পারিনি বলে স্নাতকোত্তরের রেজাল্ট হাতে পাইনি।’’

পড়া শেষে রাঁচীতে ফিরে অনাথ-দুঃস্থ শিশুদের নিয়ে কাজ শুরু করেন সোনু। এদিক-ওদিক থেকে টাকা জোগাড় করে লোধমা এলাকার প্রান্তিক পরিবারের শিশুদের পড়াশোনার ব্যবস্থা করেন। কিন্তু টাকার অভাবে সেই কাজ চালানো অসম্ভব হয়ে ওঠে। সেই সময়েই চাকরি। কলকাতায় আরওসি (রেজিস্ট্রার অফ কোম্পানিজ) কার্যালয়ে জুনিয়র টেকনিক্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট।

তবে কেন্দ্রীয় সরকারের পাকা চাকরির পরেও কলকাতায় বাড়ি ভাড়া করেননি সোনু। আস্তানা পাতেন হাওড়া স্টেশনে। রেল পুলিশের তাড়ায় ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের আশপাশের ফুটপাত বা রাস্তার ধারেও রাত কেটেছে তাঁর। সোনুর প্ল্যাটফর্ম-বাড়ির কথা পরে অফিসে জানাজানি হয়ে গিয়েছিল। কর্তৃপক্ষের সহযোগিতায় লিলুয়ার রেল কোয়ার্টার্সে থাকার সুযোগ পান কিছুদিনের জন্য। সোনুর কথায়, ‘‘কোয়ার্টার ভর্তি থাকায় ঘরে মাটিতে মাদুর বিছিয়ে শুয়ে পড়তাম। আমার কিছুতেই সমস্যা হয় না।’’

সহকর্মীরা তো মুগ্ধ। কলকাতা রেজিস্ট্রার অব কোম্পানিজের সহকারী রেজিস্ট্রার অব কোম্পানিজ (এআরওসি) বিনীত রাই বলেন, “অনেকদিন থেকে সোনুকে দেখছি। পরিশ্রমী। ওর স্কুলেও আমাকে নিয়ে গিয়েছিল। দারুণ কাজ করছে।” এক সহকর্মীর কথায়, “ওর অতীতটা জানতাম। এই জায়গায় যে নিজেকে আনতে পেরেছে... ভাবা যায় না।”

কলকাতা থেকে সোনু সম্প্রতি বদলি হয়েছেন রাঁচীতে। বন্ধু অজয় কুমারের সঙ্গে গত বছর থেকে স্কুল চালাচ্ছেন লোধমার চাঁদপাড়া গ্রামে। মাওবাদী প্রভাবিত ওই এলাকায় স্কুলের জমি দিয়েছেন গ্রামবাসীরা। গত বছর ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ছিল ৪০। এ বছর ৮০-র বেশি। পড়ানো হয় প্রথম থেকে চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত। স্কুলের অধ্যক্ষ অজয় বলেন, ‘‘ইংরেজিতে জোর দিচ্ছি। এলাকার মানুষদের সহযোগিতায় লাইব্রেরি তৈরি করা গিয়েছে। সাক্ষরতা প্রসারের কাজও হচ্ছে।’’ বন্ধুকে নিয়ে তিনি উচ্ছ্বসিত। বলেন, “কলেজে পড়ার সময়েই সোনুর সঙ্গে আলাপ। আমি বছর খানেকের বড় ওর থেকে। কিন্তু ওর সারল্য, সামাজিক কাজ করার আগ্রহ আমাকে বরাবর টানত।”

সোনুর এখন লক্ষ্য পিএইচডি করা। বলেন, ‘‘মা-বাবাকে খোঁজার চেষ্টা অনেক করেছি। মানসিক সমস্যায় নষ্ট হয়েছিল স্কুল জীবনের একটা বছর। মনোবিদদের সহযোগিতায় ফিরেছি। একটা কথা বুঝেছি, নিজের পরিচয়ই আসল। যে সমাজ আমাকে অচ্ছুৎ করে দিয়েছিল, সেই সমাজেরই এখন আমাকে দরকার।’’

প্রেমও এসেছিল সোনুর জীবনে। পূর্ণতা পায়নি। শান্তভাবে যুবকটি বলেন, ‘‘জীবনে ফের প্রত্যাখ্যাত হয়ে ভেঙে পড়েছিলাম। কিন্তু এত শিশুর ভালবাসা আমার কাছে অনেক। মা-বাবা না থাকাটা দুর্বলতা নয়। এই কথাটাই বাচ্চাদের বোঝাতে চাই।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Spiritual Youth School Orphan Education
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE